জেএনইউ ও জেইউ: অলীক কু-নাট্যরঙ্গ

কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনকিলাব’-এর স্লোগানের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না-যেতেই খবরের শিরোনামে আবার চলে এল দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। জেএনইউ-এ পড়াশোনার খরচ কিছু বেড়েছে বলে কিছুদিন আগেও আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমে রাস্তা অবরোধ করেছিলেন জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা এবং অনেকে প্রহৃতও হয়েছিলেন দিল্লি পুলিশের হাতে। গত ৩ ও ৪ জানুয়ারি সেই ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদেই বিদ্যালয়ের সেমেস্টার পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনে বাধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিন ব্লকে অবস্থান ধর্মঘটে বসেন জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্ররা, বলেন, ফি-বৃদ্ধি প্রত্যাহার না করলে তাঁরা সেমেস্টার পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে দেবেন না কাউকেই এবং পরীক্ষায় বসতেও দেবেন না। এর অর্থ হল, যে সব ছাত্রছাত্রীর বর্ধিত ফি’তে আপত্তি নেই, তাঁরা ইচ্ছে থাকলেও পরীক্ষা দিতে পারবেন না। আন্দোলনের স্বার্থে। প্রশ্ন হল, আন্দোলনের স্বার্থ কি আন্দোলনের আদত উদ্দেশ্যের চেয়েও বড়?

জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্ররা রেজিস্ট্রেশন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। এবিভিপি ছাত্র সংসদের দাবি ছিল, যারা বয়কট করতে চাইছেন তারা বয়কট করুন, কিন্তু যাদের রেজিস্ট্রেশন করার ইচ্ছে, তাদের পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে দেওয়া হোক। রেজিস্ট্রেশন হয় অনলাইনে এবং জেএনইউ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ইন্টারনেট সাধারণত তেমনভাবে পাওয়া যায় না। ভরসা ক্যাম্পাসের ওয়াইফাই। বামপন্থী ছাত্ররা তাই ক্যাম্পাসের ওয়াইফাই কন্ট্রোল রুমকে টার্গেট করে ওয়াইফাই সিস্টেম বন্ধ করে দিয়ে ধর্নায় বসে পড়েন, যাতে ক্যাম্পাসের কোনও ছাত্রই রেজিস্ট্রেশন করাতে না পারেন।

একদল ছাত্রের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের অধিকার যদি আর একদল ছাত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা বজায় রাখার অধিকার কেড়ে নেয়, তবে তা যে অগণতান্ত্রিকতা এবং অসংবেদনশীলতা, সেইটি ভাবার ক্ষমতা কি জেএনইউ-এর মেধাবী ছাত্রদের নেই? বোধ ও সংবেদনশীলতা কি মেধার সঙ্গে সহাবস্থান করে না? না কি এই পরমত-ঔদাসীন্য, অগণতান্ত্রিকতা এবং যেনতেনপ্রকারেণ নিজেদের মতামত অপরের ওপর চাপিয়ে দিতে চাওয়াই বাম ও অতিবাম ছাত্র-আন্দোলনের বিশেষত্ব? ৩ জানুয়ারি থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জেএনইউ যেভাবে ধাপে ধাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠল, দলমত নির্বিশেষে ছাত্ররা যেভাবে প্রহৃত হলেন মুখঢাকা গুন্ডাদের হাতে, তার সম্যক নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই, যদিও, ছাত্রদের আন্দোলন প্রতিটি ছাত্রের ঐচ্ছিক বিষয় কেন হবে না, কেন কেউ আন্দোলন করতে না চাইলে তার আন্দোলন না-করার স্বাধীনতাও থাকবে না, কেন সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে এক দাবি সমর্থন করতে হবে, কেন পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক ছাত্রদের রেজিস্ট্রেশন করতে বাধা দেবে ছাত্র ইউনিয়ন, সে প্রশ্নও এইমুহূর্তে না তুললেই নয়। প্রশ্নটি গণতান্ত্রিকতার।

বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের চেনা ছকটি গত পাঁচ দশকে বোধ করি একটুও বদলায়নি। সময়ের সঙ্গে যা বদলায় না, সেটি নিজেই কি একটি অচলায়তন নয়? ১৯৭০ সালেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিবামপন্থী ছাত্র সংগঠন দাবি তুলেছিল যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়া চলবে না। ডাক দিয়েছিল পরীক্ষা বয়কটের। কেন? কারণ ওই ছাত্রদের মতে, ভারতের স্বাধীনতা নাকি ছিল মিথ্যা, তাই পরীক্ষা নেওয়াও নিরর্থক। গোপালচন্দ্র সেন, ছাত্রদরদী প্রফেসর ও যাদবপুরের তৎকালীন কার্যনির্বাহী উপাচার্য তাদের এমন উদ্ভট দাবি মেনে পরীক্ষা বাতিল করতে রাজি হননি। ঘোষণা করেছিলেন, পরীক্ষা হবে, যাদের ইচ্ছা, তারা দিতে পারেন। পরীক্ষা হয়েছিল এবং মার্কশিট দেওয়া হয়েছিল পুজোর ছুটিতে। বিষয়টি অতিবামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ভালভাবে নেয়নি। মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সেই ঋষিতুল্য প্রফেসর গোপালচন্দ্র সেনকে ক্যাম্পাসের মধ্যে পিছন থেকে হত্যা করেছিল অতিবামপন্থী ছাত্র সংগঠনের রানা বসু, সেই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে। অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী বাবার সহায়তায় রানা তার পর পালিয়ে যায় কানাডায়। ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে’। আজও একইভাবে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন, তাদের জোর করছে একটি বিশেষ ছকের আন্দোলনে তারা না-চাইলেও সামিল হতে, অগ্নিগর্ভ করে তুলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি। কেন? কারণ, অন্যকে পরীক্ষা দিতে দিলে তাদের নিজেদের অ্যাকাডেমিক ইয়ারটি নষ্ট হবে, অথচ যারা পরীক্ষা দেবেন, তাদের কোনও ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ আন্দোলন এরা করতে চান নিজেদের মতে, কিন্তু তার জন্য কোনও মূল্য দিতে নিজেরাই রাজি নন। আন্দোলনে অনিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের ওপর নিজেদের মতামত জোর করে চাপিয়ে দিয়ে তাদের কেরিয়ার বাজি রাখতে পিছপা নন বামপন্থী ছাত্ররা। এই মূল্যবোধহীনতা, নিজেদের আন্দোলনের অধিকারের নামে অন্যের মৌলিক অধিকার (পার্সোনাল লিবার্টি) কেড়ে নেওয়া বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের বিশেষত্ব। বামপন্থীরা বলছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন লেজিসলেশন হল ‘ফ্যাসিস্ট’। তারা অন্য কারুর কথা শোনেন না। প্রশ্ন হল, ‘ফ্যাসিস্ট’ কে বা কারা? ‘ফ্যাসিস্ট’ কি যাদবপুরের সেই একজন জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ছাত্র সুরঞ্জন সরকার, যাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ বামপন্থী নয় বলে একক্লাস বামপন্থী ছাত্র তাঁর সঙ্গে ক্লাস করতে চান না? আর সেই একক্লাস বামপন্থী ছাত্র, যারা তাদের ক্লাসে একজনমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্র আছেন বলে তার সঙ্গে ক্লাস করতে চান না, তারা কি উদারমনা? একক্লাস বামপন্থী ছাত্র যখন একজন এবিভিপির ছাত্রকে বলেন যে, এবিভিপির মতাদর্শে বিশ্বাস করাই তার দিক থেকে অপরাধ, তখন প্রশ্ন কি স্বভাবতই ওঠে না যে, বামপন্থী ছাত্ররা কি তবে পুরোনো ‘একঘরে করা’র কালচারকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন? তা হলে ‘ফ্যাসিস্ট’ কারা? এরা বলছেন, বর্তমান ভারতবর্ষে গণতন্ত্র বিপন্ন এবং সংখ্যার জোরে বিজেপি চাইছে বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ করতে। প্রশ্ন হল, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরুদ্ধ মত ও গণতান্ত্রিকতার অধিকার খর্ব করছেন কারা? বামপন্থীরা। সেক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযোগ মান্যতা পাবে কেমন করে? ‘আপনি আচরি ধর্ম, অপরে শিখাও’— তত্ত্বটি কি তারা মানেন না?

কিছুদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশের সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়া আইনের প্রতিলিপি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রী দেবস্মিতা। আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। দেবস্মিতার মুখে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শুনে অনেকেরই মনে পড়ে গিয়েছিল যে, প্রফেসর সেনকে হত্যা করার সময় রানা বসুর মুখেও শোনা গিয়েছিল এই একই স্লোগান। পিতৃতুল্য প্রফেসরকে হত্যা করতে শেখায় যে ‘ইনকিলাব’, সেই ‘ইনকিলাব’ আমাদের কোন কাজে লাগবে?

যে বিল সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে বর্তমানে দেশের আইনে পরিণত হয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সেই আইনটি দেশের সমষ্টিসত্তার বানানো। ইনকিলাবের নামে তার বিরুদ্ধে এমত প্রতিবাদের অধিকার কোনও ব্যক্তিবিশেষের নেই। এমন প্রতিবাদের অর্থ দেশের সমগ্র জনসাধারণের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের তথা সংসদীয় গণতন্ত্রের অবমাননা। তৎসত্ত্বেও যদি ধরে নেওয়া যায় যে, আইনটি পাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ মানুষ আইনটি সম্বন্ধে জানতেন না, পাশ হওয়ার পর জেনেছেন এবং তার বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিবাদের অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্বীকৃত। কিন্তু প্রতিবাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকেই বয়কট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিরই অবমাননা করা কি আবশ্যক ছিল? আচার্য অর্থাৎ গুরু। গুরুর আশীর্বাদ বিনে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না, এ আমাদের সনাতন সংস্কৃতি। কিন্তু রাজ্যের রাজ্যপালই যে পদাধিকারবলে যাদবপুরের আচার্য, এই সাংবিধানিক প্রাতিষ্ঠানিকতাটিকে মানতে বোধ করি যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা ছিল। তাই গুরুর মান রাজ্যপালকে দিতে তারা রাজি হননি। আচার্য তথা রাজ্যপালকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই দেননি। প্রশ্ন হল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যদি তরুণ প্রজন্মের মননকে এমত নেতিবাচক সংঘর্ষময়তার অভিঘাতে আচ্ছন্ন করে তোলে, তবে তার পরিণাম যে বৃহত্তর সমাজের পক্ষে ইতিবাচক হয়, তার কি কোনও প্রামাণ্য নিশ্চয়তা আছে? প্রতিবাদের কি অবশ্যম্ভাবীভাবে ধ্বংসাত্মক হওয়ারই কথা? গঠনমূলক হতে পারে না?

যাদবপুরের একদল ছাত্র যখন আচার্যকে আটক করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটেই, তখন উপাচার্য মহাশয়কেই বা কোন অদৃশ্য শক্তির দাপটে এতখানি অসহায় হতে দেখা গেল যে, ছাত্রছাত্রীদেরকে নিয়ন্ত্রণ বা শাসন করতে তাঁকে দেখা গেল না বিন্দুমাত্র? বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র একদল ছাত্রছাত্রী মিলে যখন আচার্যের প্রবেশপথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন এইটি ভেবে নেওয়ার কি যথেষ্ট কারণ ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীই উক্ত অভব্যতায় তাদের নৈতিক সহযোগী ছিলেন? অথচ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রের এমত অভব্যতার নীরব দর্শক। বরং ছাত্রছাত্রীদের আপত্তিকে কারণ হিসেবে দর্শিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উপাচার্য এবং সেই সিদ্ধান্ত তিনি আচার্যকে জানান সরাসরি নয়, বরং রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পদের একজন আমলা, শ্রীমনীশ জৈনের মাধ্যমে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য কেন সরাসরি মতবিনিময় করতে পারবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের সঙ্গে, একথা গণতন্ত্রবোদ্ধা মানুষজন অনুধাবন করতে পারছেন কি? একটি শিক্ষাক্ষেত্রের উপাচার্যের সঙ্গে আচার্যের মতবিনিময় যদি হতে হয় সরকারি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে, তবে তাতে কি শিক্ষাক্ষেত্রের সহজ, মানবিক ও নিরপেক্ষ অ্যাকাডেমিক পরিবেশ বজায় থাকে? তা যদি না থাকে, তবে শিক্ষার গুণগত মান কি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা নয়? এ প্রশ্ন বারংবার তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও এ রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়।

আইনটি নিজে পড়ে দেখেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রী দেবস্মিতা আইনটি প্রত্যাখ্যান করেছেন, এমন ভাবতে মন চায় না। কারণ তা হলে তার চিন্তনক্ষমতা, বোধশক্তি ও মেধা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়তে হবে। তাই যদি ধরে নেওয়া হয় যে, আইনটি না-পড়েই তার প্রতিলিপি ছিঁড়ে ফেলার মত অভব্যতা প্রদর্শন দেবস্মিতা করেছেন, তবে একজন প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রী এমন উদ্ধত আচরণ করেন কেন বা কারা তার ব্যবহারিক চরিত্রকে এমন অপরিশীলিত করে তুলছেন— এই সব প্রশ্ন যদি আজও নাগরিক সমাজকে না ভাবায় তা হলে ধরে নিতে হবে বাঙালি আর বেঁচে নেই।

যে আইনের প্রতিলিপি ছিঁড়ে বামপন্থী প্রতিবাদের উচ্চকিত প্রদর্শন হল, সোয়া একপাতার সেই আইন কোনও বৈষম্যের আইন না। বরং নিপীড়িত মানুষের জন্য সাম্যপ্রতিষ্ঠার আইন। ২০১৪ সালের শেষদিন পর্যন্ত যে সমস্ত মানুষ ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে চলে এসেছেন এবং পরিচয়হীনতার অন্ধকারে দেশের সীমানার বেড়াজালে আটকে গিয়ে অসহায় কালাতিপাত করছেন ভারতবর্ষেই, তাদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্বের পরিচয় দিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়ার বিরুদ্ধে সভ্য, সংবেদনশীল নাগরিক সমাজের কোনও প্রতিবাদ কি আদৌ থাকতে পারে? যারা ‘ইনকিলাব’ বা বিপ্লব চান, তাদের ‘ইনকিলাব’ যদি অসহায় মানুষকে সহায়তা প্রদান করতে না পারে, তবে সেই বিপ্লবও কি ব্যর্থ হবে না?

যাদবপুরকে তার জাতীয়তাবাদী সৃষ্টি-ঐতিহ্যের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে, তার গুণমানকে অধোগামী করতে পারলে বাংলার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের অগ্নিযুগের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার যে প্রয়াস স্বাধীনতোত্তর কাল থেকে নিরন্তর চলেছে এ রাজ্যে, তাকে একধাপে এগিয়ে দেওয়া যায় অনেকখানি আর বাঙালির উৎকর্ষ-সাধনার অন্যতম পীঠস্থানটিকেও নষ্ট করে দেওয়া যায়। ভুললে চলবে না, গবেষণা ক্ষেত্রে যাদবপুর কাজ করত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিশ্বখ্যাত অধ্যাপকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।‌ ভারতের প্রথম ওয়েল্ডেড ব্রিজ ‘ব্রহ্মপুত্র সেতু’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রদের তৈরি। যাদবপুরের ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের ফার্মাসিউটিকস ল্যাবে তৈরি হয়েছিল নাইট্রাজেপাম প্যাচ সেই আশির দশকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলো শিল্পজগতেরও পরীক্ষানিরীক্ষার এক অতিনির্ভরযোগ্য স্থান। কিন্তু আজকের দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যেন পাল্লা দিচ্ছে শুধু ‘ন্যুইসেন্স ভ্যালু’ ক্রিয়েট করার প্রতিযোগিতায়। এ বিষয়ে যাদবপুরের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বোধ করি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। সন্দেহ হয়, এই ধরনের ন্যুইসেন্স ভ্যালু ক্রিয়েট করার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হল, এ রাজ্যের শাসকপদে তৈলমর্দনকারী সংবাদপত্রগুলির হেডলাইন ম্যানেজমেন্ট। সমাবর্তন মঞ্চে দেবস্মিতাকে ‘বোড়ে’ বানিয়ে প্রতিবাদের চিত্রনাট্য অন্যত্র রচিত হয়েছে বলেই মনে করেন বিদগ্ধ মহলের এক বৃহৎ অংশ।

এমন চলতে থাকলে স্বল্পখরচে মেধাচর্চার এই অন্যতম পীঠস্থানটি অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ মেধাবী বাঙালির আর কোনও কাজে আসবে না। মধ্যমেধার গণ্ডিতে মানুষকে আটকে রাখার চারদশকের বামপন্থী নীতি মেধার জগতে ইতিমধ্যেই বাঙালিকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। যাদবপুরকে এইভাবে উৎক্ষিপ্ত করে নষ্ট করে দিলে বাঙালি-মেধাকে গুণগত দিক থেকে পঙ্গু করে দেওয়া যাবে আরও অনেকখানি।

যে CAA নিয়ে তথাকথিত প্রতিবাদ হচ্ছে, সেই রকম একটি আইনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন, সেই প্রেক্ষাপট বর্ণনারও প্রয়োজন আছে। পশ্চিমবঙ্গ একটি উদ্বাস্তু অধ্যুষিত রাজ্য। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভাজনের পর পার্শ্ববর্তী ইসলামিক পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শতকরা উপস্থিতি কীভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা দেখলে বোঝা যায় যে, কোনও এক কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমে গিয়েছে ক্রমশ। কোথায় গেলেন এই মানুষগুলি? এবং আরও বড় প্রশ্ন হল, কেন গেলেন? নিজের দেশে নিজের বাড়িঘর, জমিজমা ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশে কি কেউ ভাগ্যান্বেষণে যান? বহু বাঙাল বাড়ির ছেলে, যারা ওপার থেকে এপারে চলে এসেছিলেন, তারা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের বাড়িঘর রেখেই নিয়মিত পাড়ি জমিয়েছেন পশ্চিমী দেশগুলিতে। সেই যাওয়াকে বলে ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালির ওপার থেকে এপারে আসা ভাগ্যান্বেষণ নয়, বরং ভাগ্যহত হয়ে, যবনের হাতে সব হারিয়ে প্রাণ ও মান বাঁচাতে ধুলোপায়ে, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসা। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত কমেছে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা, সেই কারণটি একটি ওপেন সিক্রেট। ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ২০১৯-এর এই সংশোধনী বিষয়টিকে আর ওপেন সিক্রেট হিসেবে রাখতে দিচ্ছে না। সরাসরি সরকারিভাবে ডকুমেন্টেড তথ্যে পরিণত করছে। প্রতিবাদ কি তবে সেই কারণে?

দশকপ্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা উপস্থিতি:
১৯৪১— ২৯.৬১৩%
১৯৫১— ২২.৮৯১%
১৯৬১— ১৯.২৭৮%
১৯৭১— ১৪.৩০২%
১৯৮১— ১৩.০৩৭%
১৯৯১— ১২.৩৭০%
২০০১— ১০.১%
২০১১— ৯.৩%
(Ref: Esamskriti & Bangladesh Bureau of Statistics, Population Monograph of Bangladesh vol 9, table 5.8)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবুল বরকত ৫০ বছর ধরে একটি পরীক্ষা চালিয়েছেন, যাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, যে হারে হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বাংলাদেশে, সেভাবে চলতে থাকলে ২০৫০-এ আর একজন হিন্দুও থাকবেন না সে দেশে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হল, হিন্দু বাঙালির এতখানি হতভাগ্য হওয়ার কি কোনও সঙ্গত কারণ আছে যে, তাদের হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকে গড়ে ওঠা গৌরব-প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পর্যন্ত তাদের এথনিক ক্লেনজিং-এর বিরুদ্ধে সরব হবেন না? হিন্দু বাঙালি এতখানি অনাদরণীয় হওয়ার মত কী করেছে?

দেবযানী ভট্টাচার্য

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির প্রাক্তনী, বহুজাতিক সংস্থার এক্সিকিউটিভ, বর্তমানে পেশায় ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট।

মতামত লেখকের নিজস্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.