বিশিষ্ট বিদ্যাবিদ অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ লিখেছিলেন, “ঋগ্বেদের কোন স্থানে এমন উক্তি নাই যাহা দিয়া দেখানো যাইতেছে যে, সরস্বতী নদী দেবতা ব্যতীত আর কিছু।” বরং বেদে পাওয়া যায়, “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।” সরস্বতী অষ্টাদশ বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, তন্ত্র ও মন্ত্রে কীর্তিতা এবং নৃত্যগীত ইত্যাদি সকল কলাবিদ্যার দেবীরূপে চিহ্নিতা হলেও আদিতে তিনি ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা।
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার পূর্বে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ-মনন করেছিলেন। একটি কবিতায় (গাই গীত শুনাতে তোমায়) তিনি লিখেছিলেন,
“বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী। “
আমেরিকার নরনারী তো ভেসেই গিয়েছিলেন, যখন স্বামী বিবেকানন্দ সম্ভাষণ করলেন, “Sisters and brothers of America.”
কাব্য-সাহিত্যের মুখবন্ধতে, শিক্ষা আলোচনা ও শিক্ষাদানের শুরুতে, লোকসংস্কৃতির আসরবন্দনায় সরস্বতী বন্দনা একেবারেই অসাম্প্রদায়িক রূপে বিবেচিত হত। তার দু-একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
১. কাজী নজরুল ইসলাম একটি লেটো গানের আসরবন্দনায় সরস্বতীকে ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিত করেছিলেন।
“এসো গো মা সরস্বতী সর্বমঙ্গলা।
তোমার আসরে বাজে হারমনি বেহালা।।”
২. মহম্মদ কবীরের লেখা ‘মধুমালতী’ কাব্যের সূচনায় সরস্বতী বন্দনা রয়েছে।
“সরস্বতীর পদে করম নমস্কার।
পৃথিবী হইল নৌকা সংসার অপার।।
শির রাখি প্রণমি এ পদে করতার।
গোপত থাকিয়া কর মহিমা তোমার।”
অর্থাৎ মুসলমান কবিরাও সংস্কৃতির এই রীতিকে মেনেই কাব্য রচনা করেছেন। বিদ্যা নিকেতনে সরস্বতীপূজাও সেই আবহমান কাল ধরে প্রচলিত সংস্কৃতির এক পরম্পরা, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যোগ আনাটাই এক সাম্প্রদায়িক কাজ হবে। সরস্বতী নদীর তীরে পাললিক মৃত্তিকায় উর্বর কৃষি ও উন্নত জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি ও সংস্কৃতিতে একটি নদী হয়ে গেল দেবী। এটি একটি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।
সুতরাং, সরস্বতী বন্দনা ধর্মীয় যত না, তার চাইতেও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
অন্নদামঙ্গল কাব্যে সরস্বতীবন্দনায় বলা হয়েছে,
“তোমার করুণা যারে/সবে ধন্য বলে তারে/গুণিগণে তাহার গণন।”
শিল্পী ও বিদ্যাবিদরা চান তাদের জীবনের দুঃখনিবৃত্তি। শিল্পজীবনে ও বিদ্যার জগতে আপাত প্রতিষ্ঠাই এই দুঃখ নিবারণ করতে সক্ষম, লাভ হতে পারে জীবনে চলার পাথেয়। তাই কাব্য-সাহিত্যের জগতে, লোকসঙ্গীত ও লোকনাট্যের আসর-বন্দনায় সরস্বতীর স্তব-স্তুতি করা হয়। প্রাচীন কাল থেকেই এই রীতি মানা হচ্ছে, আধুনিক লোককবিরাও তা অনুসরণ করে থাকেন। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে সরস্বতীর উপর এত বিক্ষোভ?
মঙ্গলকাব্যে সরস্বতীবন্দনা তো আছেই, মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সরস্বতীবন্দনায় ব্রতী হয়েছিল! কেউ আপত্তি করতে আসে নি, বন্দনার জন্য কেউ মারধোর খেয়েছেন এমন কথা শোনা যায় নি। পুরো বিষয়টিই যে অসাম্প্রদায়িক ছিল, এই সহজ সত্যটা যেন আজকের বিদ্যাবিদরা মনে রাখেন, দেবীকে না মানলেও লোকসংস্কৃতির আঙ্গিকটাকে যেন মান্যতা দেন।
ওঝাদের মন্ত্রে বাদ যান না দেবী সরস্বতী; কখনো দেখা যায় এই ঝাড়ফুঁক -এর মন্ত্র মুসলমানী লোক-চিকিৎসকও ব্যবহার করেন। অক্ষয় কুমার কয়াল সংগৃহীত একটি ঝাড়ফুঁক মন্ত্র এই রকম —
“আকর্ণ পূরি এ জুড়ি বাল্মীকির বাণ।
দেবতা অসুর কাঁপে নাহি সহে টান।।
ইন্দ্রের ঘরনি কাঁপে পাতালে বসুমতী।
চৌষট্টি ভৈরবী কাঁপে লক্ষ্মী-সরস্বতী।।”
একটি মুসলমানি ছড়ায় সরস্বতীর কথা আছে; লোকবৃত্তের বাসিন্দারা তার মধ্যে কোনো ভেদবুদ্ধি রাখতেন না, আজ কেন সরস্বতী নিয়ে এত ভেদবুদ্ধি রচনা করে বুদ্ধিজীবীরা সরস্বতীকে ব্রাত্য করে তুলছেন? ঢাকা থেকে প্রাপ্ত একটি পুরনো মুসলমানি ছড়া এইরকম,
“ধলা মাইয়া সারিন্দা হাতে
সোনার বরন কলসি কাঁখে
পাশে বইস্যা প্যাঁচা।”
অতএব যারা সরস্বতীকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন তারা কাদের সুবিধা করে দিতে চাইছেন?
কোনো প্রয়োজন তো নেই! কারণ সরস্বতী কখনই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সংস্কৃতি ছিল না কোনোদিনই। তার অসাম্প্রদায়িক রূপ বিদ্যালয়গুলিতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
বরং বলা যায় সালোকসংশ্লেষের দেবী হলেন সরস্বতী।
কারণ-
‘সরস’ শব্দের অর্থ জল। শুরুতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। বিদ্যার দেবীর ধারণা অনেক পরে। উর্বর নদী উপত্যকায় কৃষির ফলন ছিল পর্যাপ্ত। তাই সরস্বতী নদীতীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। সেইসূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী। সভ্যতার অভ্যুত্থান ও তার ক্রমবিকাশে নদী সবসময় সহায়ক ও সঙ্গত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই কল্পনা করা যেতেই পারে সরস্বতী নদীর দু’কূলে সৃজিত পলল মৃত্তিকার উর্বর শস্যক্ষেত্র ছিল আর্য ঋষিদের ‘শস্যাগার’।
আবার ‘সরস’ শব্দের অপর অর্থ ‘জ্যোতি’। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে পাওয়া যায় অগ্নিরূপ, জ্যোতির্ময়ী এক দেবী রূপে। সরস্বতীর মধ্যে সূর্যকিরণের সপ্তবর্ণের ধারণা VIBGYOR এখানে পরিষ্কার। যেহেতু উদ্ভিদ দেহে বৃদ্ধি ও পরিস্ফূরণের অপরিহার্য শর্ত আলোক ও জল, সরস্বতী তাই সালোকসংশ্লেষ বা Photosynthesis প্রক্রিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৌরশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলের আবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, জলের সরবরাহকারিণী দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাই কৃষি উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘শ্রী’ অর্থে লক্ষ্মী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে একসময় হয়তো লক্ষ্মীপুজোই হত, এখনও অনেক পরিবারে দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীকেও ভক্তি সহকারে ফুল নৈবেদ্য দেন। আর এই দিনটি থেকেই যেন শুরু হয় মুকুল-বিকাশের পর্ব, বসন্তের সৌকর্য, সুপ্তির অবসান, মনের মুক্তির মরশুম।
দেবী সরস্বতী উপাসনায় লাগে পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব; ধান, যব, গম, মুগ, তিল দিয়ে এই পঞ্চশস্যের অর্ঘ্য রচিত হয় আর আম, অশোক, অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুরের বিটপ দিয়ে সাজানো হয় পঞ্চপল্লব।
পলাশপ্রিয়া হলেন দেবী সরস্বতী। পলাশের রক্ত রঙ উর্বরতার প্রতীক, আর ঋতুমতী নারীর রজোদর্শনই প্রাণীজন্মের প্রথম শর্ত।
দেবী সরস্বতী তাই উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী রূপে পূজিতা; জলের দেবী, আলোর দেবী এবং উর্বরতার দেবী।