একুশের সমাবেশে কত লোক! মমতার কাছেই হেরে গেলেন মমতা

একুশে জুলাই। এ কোনও দিন মাত্র নয়, বঙ্গ রাজনীতির এক চরিত্রের নাম— একুশে জুলাই।

এই একুশে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গ রাজনীতির অনেক ওঠাপড়া দেখেছে সে। এই একুশে দেখেছে শূন্য থেকে তৃণমূলের অনেক হয়ে ওঠা। এই একুশে দেখেছে এক সাংসদের দলকে একক শক্তিতে রাজ্যের ক্ষমতায় বসতে, সব থেকে বড় কথা তৃণমূলনেত্রীর জননেত্রী হয়ে ওঠা দেখেছে সে।

অনেক কিছু দেখিয়েছেও এই একুশে। ১৯৯৩ সালের পর থেকে ফি বছর একুশে জুলাই পালন করে চলেছেন মমতা। তখন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মও হয়নি। সেই বাম আমলে কখনও যুব কংগ্রেস নেত্রী হিসেবে, কখনও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে রাজ্যের মানুষ জড়ো হয়েছেন শহিদ দিবসে। এই মঞ্চে কখনও জোট শরিক বিজেপি, কখনও কংগ্রেস নেতাদের দেখা গেলেও বরাবরের মধ্যমণি মমতা। আর সেই মমতাই বারবার হারিয়েছেন মমতাকে। প্রতিবারের ভিড় টপকে গিয়েছে আগের বারের সমাবেশকে। এই একুশে জুলাই জানে, কী ভাবে একটু একটু করে বাম দুর্গে ধস নেমেছে, কী ভাবে ঘাসফুলের গোড়া শক্ত হয়েছে।

এবার কিন্তু উলট পুরাণ। এও এক রেকর্ড। মমতার কাছেই হেরে গেলেন মমতা। এই প্রথমবার একুশের সমাবেশে উপস্থিতি কমতির দিকে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে ২০১১ সালে বিজয় দিবস ও শহিদ দিবস মিলিদয়ে ব্রিগেডে সমাবেশ করলেও বাকি বছরগুলিতে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই মঞ্চ বেঁধেছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর সেই সব সমাবেশ যাঁরা ফি বছর দেখেছেন তাঁরা জানেন এমনটা আগে দেখা যায়নি। প্রতি বছরের ভিড় বৃদ্ধির দৃশ্য তো ছিলই না বরং, খোদ ধর্মতলা চত্বরেই ভিড় কখনও জমাট বাঁধেনি। মানুষের কালো মাথার ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান হয়েছে অনেকখানি অংশ জুড়ে থাকা কালো পিচের রাস্তা। দেখা গিয়েছে না জমা ভিড়র মাঝখান দিয়ে অনায়াসে চলছে মোটরসাইকেল। আর সেটা তখন, যখন খোদ মমতা বক্তব্য রাখছেন।

পুলিশের কর্তারাও আড়ালে আবডালে স্বীকার করে নিয়েছেন কমতি ভিড়ের কথা । তবে তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছে প্রায় ২০ লাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছে এদিন। কিন্তু আঁখো দেখা অভিজ্ঞতা বলছে, এ দিনের সমাবেশে টু-মিলিয়ন সংখ্যাটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল।

সেটা যে হয়নি তা তো তৃণমূলনেত্রীর বক্তৃতাতেই স্পষ্ট হয়েছে। শুরু থেকেই তিনি যেন সাফাই দিতে চাইলেন। এদিন অবস্থা বুঝে আগেভাগে সভায় চলে আসেন মমতা। সাধারণত তিনি সমাবেশ শুরুর অনেকটা পরে সভাস্থলে আসেন এবং বক্তৃতা শুরু করেন দুপুর একটার পরে। এদিন সেখানে পৌনে একটাতেই মমতার বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়। দেড়টা বাজার পরে পরেই সমাবেশের সমাপ্তি।

মমতা শুরুতেই বলতে থাকেন তিনি যখন বাড়ি থেকে আসছেন তখন নাকি রেড রোডে লাখ দুয়েক মানুষের জমায়েত ছিল। ব্রিগেডে নাকি আলাদা একটা সমাবেশ হচ্ছে বলে মনে হয়েছে তাঁর। কিন্তু তাঁরা কেন সভাস্থলে না এসে রেড রোডে রইলেন সে প্রশ্নের উত্তর দেননি মমতা। পরে আবার বলেন, অনেকেই নাকি ময়দানে বসে মাইকে বক্তৃতা শুনছেন। এমনকী বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বলে দেন আগামী এক ঘণ্টায় তিনি কিছু ঘোষণা করবেন আর সেটা না শুনে কেউ যেন চলে না যায়।

এমন বলার কারণও ছিল। এদিন সমাবেশের গোটা সময়টাই নড়াচড়া করেছে ভিড়। জমায় ব্যাপারটাই ছিল না। মমতা যখন বলতে শুরু করেছেন তখনই দেখা যাচ্ছে দলে দলে মানুষ উঠে পড়েছেন। বিজেপির উত্থানে তৃণমূলের যে সাংগঠনিক শক্তি কমেছে, লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফল যে রাজনৈতিক শক্তি কমিয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে এ দিনের পাতলা ভিড়।

আর সেই সঙ্গে যদি বাড়তি কারণ ধরা হয় তবে অবশ্যই ছিল দুই রবি-র ভূমিকা। এক ‘রবি’ সূর্যদেব এদিন ছিলেন অত্যন্ত প্রখর। শ্রাবণের আকাশে রবির এমন তেজ সত্যিই নতুন অভিজ্ঞতা। দিদি এদিন বলেছেন, সূর্য হাসছে। কিন্তু হাসি নয়, রীতিমতো অট্টহাসি টের পেয়েছেন সভায় আগত মানুষ। আর এক ‘রবি’— রবিবারও কিছুটা পাতলা করেছে ভিড়। ছুটির দিন হওয়ায় অফিসের লোক টানা যায়নি অফিসপাড়া এলাকার এই সমাবেশে।

তবে কি লোক একেবারেই হয়নি? না, সেটা একেবারেই বলা যাবে না। কিন্তু সেই ভিড় তৃণমূল কংগ্রেসের মতো নয়। মমতাই যে হারিয়ে দিয়েছেন মমতাকে।

রফিকুল জামাদার, পিনাকপাণি ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.