[১০’ই অক্টোবর ১৯৪৬-এর কোজাগরী পুর্ণিমার রাতে শুরু হওয়া “নোয়াখালী হিন্দু-গণহত্যা” শুরু হবার মাত্র ৯ দিনের মাথাতেই সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নোয়াখালীর সেই মৃত্যুপুরীতে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে যান তৎকালীন “আনন্দ বাজার পত্রিকা”র মুখ্য সম্পাদক শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়। উপরিউক্ত “নোয়াখালীর ধ্বংসকান্ড” শীর্ষক পুস্তিকায় তাঁর আঁকা সে দিনের সেই অমূল্য এবং ভয়াবহ চিত্রগুলি জাতীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল।]
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৫ই অক্টোবর এই সংবাদ প্রকাশিত হয়, ঐ তারিখেই কুমিল্লা হইতে শ্রীকামিনীকুমার দত্ত ও শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একত্রে ভারত গভর্ণমেন্টের ও বাঙলা গভর্ণমেন্টের নিকট এক টেলিগ্রামে অবস্থা বিবৃত করেন ; উহা সংবাদপত্রেও প্রেরিত হয়। টেলিগ্রামটি বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হইয়া নিম্নলিখিত আকারে ১৬ই অক্টোবরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় :-
“নোয়াখালি জেলার রামগঞ্জ থানার অধীন গ্রামসমূহে অশান্তির দাবানলে বহু নিরীহলোকের প্রাণহানি ও সম্পত্তিনাশ হইয়াছে। বেগমগঞ্জ এবং লক্ষ্মীপুর থানার কোনো কোনো অঞ্চলেও এই অশান্তির আগুন ছড়াইয়া পড়িয়াছে। গ্রামবাসীদের উপর সহস্র সহস্র গুণ্ডা আক্রমণ চালায়। জবরদস্তির ফলে গ্রামবাসীরা তাহাদের গবাদি পশু হত্যা ও অখাদ্য ভক্ষণ করিতে বাধ্য হয়। ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ী পোড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। শত শত গ্রামবাসী জীবন্ত দগ্ধ হইয়াছে এবং শত শত লোক অন্যভাবে প্রাণ হারাইয়াছে। বহু তরুণীকে অপহরণ ও জোর করিয়া বিবাহ করা হইয়াছে। উপদ্রুত গ্রামসমূহে সমস্ত ধৰ্ম্মস্থানকেই অপবিত্র করা হইয়াছে। অসহায় আশ্রয়প্রার্থীরা ত্রিপুরা জেলায় চলিয়া আসিতেছে। নিরীহ গ্রামবাসীদের ধনপ্রাণ রক্ষার জন্য নোয়াখালির ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ট সময় থাকিতে কোনই ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নাই। প্রায় দুইশত বর্গমাইল ব্যাপী এলাকায় উপদ্রব চলিয়াছে ; সেখানে কোনো লোক যাইতে পারিতেছে না বা কোনো লোক বাহির হইয়া আসিতে পারিতেছে না। ঐ এলাকার সমস্ত প্রবেশপথে মারাত্মক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত গুণ্ডারা টহল দিয়া ফিরিতেছে।
নিগৃহীত অবস্থায় এখনও যাহারা বাঁচিয়া আছে এবং যে সব নারী অপহৃতা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে উদ্ধার করা একান্ত আবশ্যক। সামরিক সাহায্য ব্যতীত উদ্ধারকার্যে যাওয়া অসম্ভব। পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা জেলায়ও এই অশান্তির অনল শিখা বিস্তার করায় দক্ষিণ ত্রিপুরার অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই ভয়ঙ্কর নরহত্যা, গৃহদাহ ও লুণ্ঠন সুপরিকল্পিত ও সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফল। গত ১০ই অক্টোবর এই হাঙ্গামা শুরু হয়। অবিলম্বে নোয়াখালি ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম জেলায় সামরিক প্রহরী মোতায়েন করা একান্ত আবশ্যক। উদ্ধার ও পুনর্বসতির ব্যবস্থা করাও আশু কর্তব্য। নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ড কোনো কোনো স্থানে সমগ্র অধিবাসীকে ধর্মান্তরিতকরণ, প্রভূত ধনপ্রাণ নাশ ও নারীহরণের দিক দিয়া বিচার করিলে বলিতে হয়, ইহার কাছে কলিকাতার সাম্প্রতিক দাঙ্গা স্নান হইয়া গিয়াছে। পরে খবর আসিয়াছে যে, নোয়াখালির অন্যান্য থানায়ও হাঙ্গামা প্রসার লাভ করিয়াছে। ত্রিপুরা জেলার হাজিগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং লাকসাম থানায়ও অশান্তি সুরু হইয়াছে। যে পুলিশ ও সৈন্য মোতায়েন করা হইয়াছে তাহা মোটেই পৰ্য্যাপ্ত নহে। উন্মত্ত জনতা সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন করিয়া দিয়াছে এবং রাস্তা ও সেতুগুলি ধ্বংস করিয়া ফেলিতেছে। এই ব্যাপক ধনপ্রাণহানি যদি অবিলম্বে বন্ধ করা না হয়, তবে সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগ শীঘ্রই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হইয়া যাইবে। উপদ্রুত অঞ্চলে সামরিক আইন জারী করা বিশেষভাবে দরকার।”
(“আনন্দবাজার পত্রিকা”, ১৬ই অক্টোবর, ১৯৪৬)
তৎকালে শ্রীকামিনীকুমার দত্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস দলের অধিনায়ক এবং শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে কংগ্রেস দলের সহকারী নায়ক। সুতরাং তাহারা একত্রে এই টেলিগ্রামে অবস্থা সম্বন্ধে যে বর্ণনা দেন, তাহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মিঃ সুরাবর্দীর বৈঠকঃ
১৬ই অক্টোবর তারিখে এই টেলিগ্রাম প্রকাশিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ সুরাবর্দী সংবাদপত্র-সম্পাদকগণকে সেক্রেটারিয়েটে এক জরুরী বৈঠকে আহ্বান করেন। বৈঠকে উপস্থিত হইয়াই তাঁহাকে বলিলাম-
“২৬শে সেপ্টেম্বরের সাংবাদিক বৈঠকে প্রেস অর্ডিন্যান্স জারীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমি যে অনুমান করিয়াছিলাম তাহাতে আপনি রুষ্ট হইয়াছিলেন, আমি বলিয়াছিলাম পূর্ববঙ্গে সে সকল নিন্দনীয় ঘটনা ঘটিতেছে ও ঘটিতে যাইতেছে তাহার প্রকাশ বন্ধ করাই এই অর্ডিন্যান্সের আসল উদ্দেশ্য। এখন দেখিতেছেন কি যে আমার অনুমান ও আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হইয়াছে? বস্তুতঃ উহা এত দ্রুত সত্য হইয়া উঠিবে ভাবি নাই।”
মিঃ সুরাবর্দী ইহার কোনও উত্তর না দিয়া জানাইলেন যে,
নোয়াখালি-ত্রিপুরার উপদ্রবের সংবাদ ও তৎসংক্রান্ত বিবৃতি সমূহ প্রকাশিত হওয়ায় তিনি বিশেষ ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। তাঁহার মতে ২৯শে সেপ্টেম্বরের আদেশের আমলে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির পক্ষে উহা প্রকাশিত হইতে দেওয়া উচিত হয় নাই। কামিনীবাবুর ও ধীরেনবাবুর টেলিগ্রামের কথা উঠিতে তিনি বলিলেন উহা প্রকাশেও তাহার আপত্তি আছে ; উহা প্রকাশ করাও প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির পক্ষে উচিত হয় নাই। প্রত্যুত্তরে তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম যে, টেলিগ্রামটি বঙ্গীয় আইন সভার দুই অংশের দুই নেতা কর্তৃক প্রচারিত হইয়াছে। এইরূপ দায়িত্বপূর্ণপদে অধিষ্ঠিত দুইজন নেতার বিবৃতিও যদি প্রকাশ করা না যায়, তাহা হইলে আর কি প্রকাশ করা যাইবে?”
যাহাই হউক, মি: সুরাবর্দী ভিন্নতর উদ্দেশ্যে এই বৈঠক আহ্বান করিলেও, এই সাংবাদিক বৈঠকেই সর্বপ্রথম নোয়াখালি-ত্রিপুরার অবস্থার গুরুত্ব সরকারী ভাবে স্বীকৃত হইল। প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা সম্বন্ধীয় সংবাদ ও বিবৃতি প্রকাশে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিতেছেন বলিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করিলেও মিঃ সুরাবর্দী শেষ পৰ্য্যন্ত স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন যে, নোয়াখালি ত্রিপুরায় যাহা – ঘটিয়াছে তাহা সত্যই অতীব গুরুতর। মাত্র পুলিশের সাহায্যে উপদ্ৰবকারীদিগকে দমন করা বা আয়ত্তে আনা সম্ভব নহে, তজ্জন্য মিলিটারীর সাহায্য লওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উপদ্ৰবকারীরা জলপথ অবরুদ্ধ করিয়া, স্থলপথসমূহ কাটিয়া ও অবরুদ্ধ করিয়া, সেতুসমূহ ভাঙ্গিয়া দিয়া এমন অবস্থা ঘটাইয়াছে যে, মিলিটারীর পক্ষেও সহজে প্রবেশ করিবার উপায় নাই। উপদ্রুত অঞ্চলে হত্যা, লুণ্ঠন, ধৰ্মনাশ প্রভৃতি ঘটিয়াছে ইহা স্বীকার করিয়া তিনি বলেন-“অরাজকতা ও অত্যাচার দুইই প্রবলভাবে দেখা দিয়াছে বটে কিন্তু কলিকাতার ঘটনার তুলনায় উহা কিছু নহে। নোয়াখালির ঘটনার কাছে কলিকাতার হাঙ্গামা একেবারে অকিঞ্চিৎকর হইয়া যায় সংবাদপত্রসমূহ একথা ছাপাইয়া অন্যায় করিয়াছে।”
প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম
“আপনাদের অগোচরে এমনতর একটা গুরুতর কাণ্ড কি করিয়া অকস্মাৎ ঘটিয়া গেল তাহার কোন কারণ বলিতে পারেন কি ?”
প্রধানমন্ত্রী মহাশয় বলিলেন—
“কেমন করিয়া ইহা ঘটিল সে সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নাই।”
পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম—
“ঘটনা ঘটিবার পূর্বে অর্থাৎ ১০ই অক্টোবরের পূর্বে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হইতে বা মহকুমা হাকিমের নিকট হইতে আপনারা কি কোনই রিপোর্ট পান নাই যে তাহারা উপদ্রবের আশঙ্কা করিতেছেন?”
প্রধানমন্ত্রী মহাশয় উত্তর দিলেন—
“না।”
ইতিপূর্বেই প্রকাশ পাইয়াছিল যে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের পূর্বতন সদস্য মৌলবী গোলাম সারোয়ার এই ধ্বংসকাণ্ডের উদ্যোক্তা ও অধিনায়ক। প্রধানমন্ত্রী মহাশয়কে সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন—
“সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হইতেছে না কেন?”
তিনি জবাব দিলেন—
“সারোয়ার কোথায়? তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য সর্বস্থানে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। কিন্তু কোথাও ত পাইতেছি না।”
শেষ পর্যন্ত তাহাকে আর একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম-
“আপনি কি উপলব্ধি করিতে পারিতেছেন যে, নোয়াখালিতে যাহা ঘটিতেছে উহা মাত্র সাম্প্রদায়িক উপদ্রব নহে—পরন্তু রাজনৈতিক দলবিশেষ (মুসলীম লীগ) কর্তৃক পূর্ববঙ্গ হইতে সংখ্যালঘু হিন্দুসমাজের উচ্ছেদ সাধনের জন্য সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াস?”
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলিলেন-
“ইহা যদি রাজনৈতিক দলের উপদ্রব হয় তাহা হইলে মাত্র একটা স্থানবিশেষে আবদ্ধ রহিল কেন?”
উত্তরে বলিলাম—
“তাহারা কার্য্যারম্ভের জন্য সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক স্থানই নির্বাচন করিয়া লইয়াছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলিলেন—
“মুসলীম লীগের নাম দিয়া যাহারা ইহা করিতেছে তাহারা লীগের হিতৈষী নহে, উহারা লীগের শত্রু।”
এইভাবে তর্কবিতর্কের পর বৈঠক সমাপ্ত হইল। মিঃ সুরাবর্দী যে ঘটনার গুরুত্ব লঘু করিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছেন সাংবাদিকেরা সমবেত ভাবে তাহার প্রতিবাদ করিলেন। শেষ পর্যন্ত সকলের পীড়াপীড়িতে তিনি অনুগ্রহ করিয়া এইটুকু রাজী হইলেন যে তিনি নিজেই শীঘ্র অবস্থা – পরিদর্শনে যাইবেন।
নোয়াখালি যাত্রা
ঠিক এই সময়েই রাষ্ট্রপতি কৃপালনী নোয়াখালি-ত্রিপুরার অবস্থা পরিদর্শনের জন্য সস্ত্রীক কলিকাতায় আসেন। তিনি এবং শ্রদ্ধেয় শ্ৰীশরৎচন্দ্র বসু ১৯শে অক্টোবর তারিখে বিমানযোগে কলিকাতা হইতে যাত্রা করেন। মিঃ সুরাবর্দী সাংবাদিক বৈঠকের পরই দার্জিলিং চলিয়া গিয়াছিলেন। তথা হইতে তিনিও গভর্ণরসহ এই তারিখেই বিমানে রওনা হন। সরকারী ও বেসরকারীদল ফেণীতে পৌছাইয়া একযোগে অবস্থা পরিদর্শন করিবেন ইহাই কথা ছিল; কিন্তু কাৰ্যতঃ তাহা ঘটিয়া উঠে নাই। শরৎচন্দ্র কর্তৃক আমন্ত্রিত হইয়া বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির পক্ষ হইতে এই যাত্রায় আমি সঙ্গী হই এবং ফিরিয়া আসিয়া প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির প্রতিনিধিরূপে আপন অভিজ্ঞতা সংবাদপত্রে বিবৃত করি। নোয়াখালির অভিযান সম্বন্ধে যথাসম্ভব পরিপূর্ণ বিবরণ এই প্রথম। নোয়াখালি পরিদর্শনে যাত্রার এবং নোয়াখালি-ত্রিপুরার অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইবার ইহাই সূত্রপাত।
মিঃ সুরাবর্দী রুষ্ট – পূর্ববঙ্গের ঘটনার প্রকাশ বন্ধ করিতে গভর্ণমেন্ট কৃতসংকল্প — সংবাদপত্রের কণ্ঠ অবরুদ্ধ — এই বিদ্যুদগ্নিবজ্রবিস্তারের মধ্যেই ইহার সূচনা।
(ক্রমশঃ)