১০ই অক্টোবর ১৯৪৬-এর কোজাগরী পুর্ণিমার রাতে শুরু হওয়া “নোয়াখালী হিন্দু-গণহত্যা” শুরু হবার মাত্র ৯ দিনের মাথাতেই সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নোয়াখালীর সেই মৃত্যুপুরীতে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে যান তৎকালীন “আনন্দবাজার পত্রিকা”র সম্পাদক শ্রী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়। উপরিউক্ত “নোয়াখালির ধ্বংসকান্ড” শীর্ষক পুস্তিকায় তাঁর আঁকা সে দিনের সেই অমূল্য এবং ভয়াবহ চিত্রগুলি জাতীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল।
ভূমিকা
“নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ড” সম্বন্ধে আলোচনা প্রকাশিত হইতে হইতে তৎকালীন বাঙলা গভর্ণমেন্টের আদেশের ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে উহার প্রকাশ বন্ধ হইয়া যায়। ১৯৪৭ সালের ৩০শে মে তারিখে মিঃ সুরাবর্দীর পরিচালিত বাঙলা গভর্ণমেন্ট নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ড সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশের অপরাধে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘হিন্দুস্থান ষ্ট্যাণ্ডার্ডের’ কয়েকটি সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেন এবং উভয় সংবাদপত্রের ৭০০০ টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করিয়া পুনরায় ১৭০০০ টাকা নূতন জামানত আদায় করেন। ফলে, প্রবন্ধ প্রকাশ এবং প্রবন্ধসমূহের পুস্তকাকারে প্রকাশ বন্ধ হয়। বৰ্ত্তমান বংসরের জানুয়ারী মাসে ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পরিচালিত পশ্চিম বাঙলা গভর্ণমেন্ট এক আদেশ জারী করিয়া ( আঃ বাঃ পত্রিকা ২০/১/৪৮) পূৰ্ব্ব গভর্ণমেন্টের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। তাহার ফলেই বর্তমান গ্রন্থের প্রকাশ সম্ভব হইয়াছে। নোয়াখালি-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ-প্রকাশ যখন তৎকালীন গভর্ণমেন্টের আদেশের ফলে বন্ধ হইয়া যায় তখন হইতে পুনঃ পুনঃ এই চিন্তাই মনে উঠিয়াছে, বর্তমানকালের বাঙলাদেশে যে এইরূপ ব্যাপার ঘটা সম্ভব হইয়াছিল ভবিষ্যৎকালের জন্য তাহার কিছু একটা ইতিহাস রক্ষিত হওয়া উচিত। সে চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা এতদিনে ফলবতী হইয়াছে। যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল এবং সরকারী আদেশের ফলে যাহা প্রকাশিত হইতে পারে নাই সমস্তই এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হইল। প্রবন্ধ গুলি যাহাতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় তজ্জন্য, প্রবন্ধ-প্রকাশের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া এ পর্যন্ত, বাঙলাদেশ হইতে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান হইতে বহু অনুরোধপত্র পাইয়াছি; সাক্ষাৎভাবেও অনেকে ইহার জন্য আগ্রহ জানাইয়াছেন। কিন্তু এত অনুরোধ ও আগ্রহ সত্ত্বেও গ্রন্থ প্রকাশ করিতে পারি নাই, কারণ উহা সম্ভব ছিল না। আজ গ্রন্থ-প্রকাশের প্রাক্কালে তাহাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাইতেছি।
যে প্রেরণা লইয়া নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনাসমূহের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম গ্রন্থ প্রকাশের প্রেরণা তাহা হইতে স্বতন্ত্র। অপ্রত্যাশিত ও কল্পনাতীত ভয়াবহ বর্বর ঘটনা মনকে রূঢ়ভাবে আঘাত করিয়া সদ্য সদ্য যে চেতনা ও চিন্তা জাগাইয়াছিল আলোচনার মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছিল তাহাই। কিন্তু গ্রন্থপ্রকাশের প্রেরণা ঐতিহাসিক। নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা সাম্প্রদায়িক অগ্ন্যুৎপাতের আকারে দেখা দিয়াছিল বটে কিন্তু এখন উহা ইতিহাসের পৰ্যায়ভুক্ত হইয়া গিয়াছে। ঘটনার পর আজ প্রায় দুই বৎসর হইতে চলিল। ঘটনার সমকালে যে দৃষ্টি ও মনোভাব লইয়া লোকে উহা দেখিয়াছিল এবং জনসমাজে উহা যে মনোভাবের সৃষ্টি করিয়াছিল এখন আর তাহা বৰ্ত্তমান নাই। এখন ইতিহাসের দৃষ্টি ও মনোভাব লইয়াই লোকে উহা দেখিবে ও পর্যালোচনা করিবে। উহাকে এখন আর কেহ মাত্র সাম্প্রদায়িক কাণ্ড বলিয়া সীমাবদ্ধ করিয়া দেখে না। পরবর্তী কালের ঘটনাসমূহের বৃহত্তর পটভূমিকায় উহা এখন সমসাময়িক ইতিহাসের অঙ্গ ও অংশ হইয়া গিয়াছে।
মুক্তিসাধনা ও গৃহযুদ্ধ
সে ইতিহাস কি এবং কিসের? পরাধীন জাতির মুক্তিসাধনার জন্য, স্বৈরাচারী শাসকের কবল হইতে জনগণের মুক্তি অর্জনের জন্য যে সকল স্তরের মধ্য দিয়া যাইতে হয় তাহাতে Civil War বা গৃহযুদ্ধ অধিকাংশ স্থলেই কোন না কোন পর্যায়ে দেখা দিয়া থাকে। নিতান্ত সৌভাগ্য না হইলে কোন দেশ ইহা হইতে অব্যাহতি পায় না। অন্যান্য প্রায় সকল দেশেই ইহা ঘটিয়াছে এবং আমাদের দেশেও ইহার ব্যতিক্রম হইল না। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র সম্বন্ধে ইতিহাস যে সাক্ষ্য বহন করিতেছে ভারতবর্ষকে তাহা হইতে মুক্ত রাখিবার জন্য মহাত্মাজী প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং অত্যন্ত দূরপ্রসারী দৃষ্টি লইয়া দেশের রাজনৈতিক মুক্তিসাধনার জন্য অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তন করিয়াছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পথে গৃহযুদ্ধ আসিয়া পড়িবে বলিয়া মহাত্মাজীর আশঙ্কা ছিল। সেইজন্যই রাজনীতিক্ষেত্রে আমাদিগকে অহিংসায় দৃঢ় রাখিবার জন্য তিনি এত চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমরা উহাকে সীমাবদ্ধ অর্থে গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং বৈদেশিক প্রভুশক্তির সহিত আমাদের সংঘর্ষ অহিংস-নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিয়াই ক্ষান্ত ছিলাম। যে দূরতর দৃষ্টি লইয়া মহত্মাজী উহা প্রবর্তন করিয়াছিলেন তৎসম্বন্ধে ভারতবর্ষের জনসমাজ যদি অবহিত হইত এবং রাজনীতিতে পরস্পরের সহিত সম্বন্ধ মহাত্মাজীর নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইত তাহা হইলে গৃহযুদ্ধের ভীষণতা হইতে আমরা অব্যাহতি পাইতাম। কিন্তু তাহা হয় নাই, পরস্পরের সহিত সম্বন্ধ আমরা মহাত্মাজীর নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিতে পারি নাই। ফলে, অতীতে অন্য দেশে যাহা ঘটিয়াছে এবং বর্তমানে আমাদের চক্ষের উপর অন্যান্য দেশে যাহা ঘটিতেছে আমাদের দেশেও ঘটিয়াছে তাহাই। তবে আমাদের দেশের রাজনীতির পূর্বাপর ধারা ও আমাদের জীবনের পারিপার্শ্বিক আবেষ্টনের প্রভাবে ইহা এক বিশেষ প্রকারের রূপ ও গতি লইয়াছে। Civil War বা গৃহযুদ্ধ মুক্তি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া। স্বাধীনতালাভ-প্রয়াসের প্রতিরোধমুখেই গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়া থাকে। সুতরাং ইহা রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষরূপেই দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতে উহার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আকারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগতি প্রতিহত ও প্রতিরুদ্ধ করিবার জন্য ব্রিটিশ কূটবুদ্ধি সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির প্রবর্তন করিয়াছিল। এই সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ক্রিয়াই ফুলে ফলে পল্লবিত হইয়া পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস, তিক্ততা ও সংঘর্ষ আনিয়াছে এবং শেষ পর্যন্ত দেশখণ্ডন ও লোক-বিনিময় পর্যন্ত ঘটাইয়াছে। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ হইতে মুক্তিলাভের প্রয়াসী ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধ এই পথে ও এই আকারেই দেখা দিয়াছে। মাত্র সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ বলিয়া যাহাকে সীমাবদ্ধ করিয়া আমরা দেখিতে চাহিয়াছি তাহা যে স্বরূপতঃ রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাহা ক্রমশঃ অভিব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে এবং গৃহযুদ্ধের রূপ গ্রহণ করিয়াছে। যে স্থলে মানসিক দুৰ্বলতাবশতঃ আমরা ভুল করিয়াছিলাম এবং এই সংঘর্ষের স্বরূপ লক্ষ্য করিতে ও স্বরূপে ইহাকে উপলব্ধি করিতে পরাঙ্মুখ হইয়াছিলাম ইতিহাস সে স্থলে ভুল করে নাই, ইতিহাস পরাঙ্মুখ হয় নাই ; বীজ হইতে বৃক্ষ ও তাহার পরবর্তী পরিণতি প্রকৃতির অপরিহার্য নিয়মেই ঘটিয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা মাত্র সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নহে, প্রত্যুত উহা মুক্তি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপে সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও ইতিহাসের অঙ্গ।
মুসলীম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ও ভারত গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে মুসলীম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের’ [মুসলীম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের’ প্রস্তাব এখন সর্বত্র কুখ্যাত। ইহা ১৯৪৬ সালের ২৯শে জুলাই বোম্বাই সহরে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবদ্বয়ের অন্যতম। ভারতীয় শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে ব্রিটিশ মন্ত্রীমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে লীগ কাউন্সিল পূর্বে সম্মত হইয়াছিল। উল্লিখিত প্রস্তাবদ্বয়ের প্রথমটির দ্বারা সেই সম্মতি প্রত্যাহার করা হয় এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলীম লীগের দাবী পূরণের উদ্দেশ্যে চাপ দিবার জন্য প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ চালাইবার সংকল্প গ্রহণ করা হয়।] আন্দোলনেই এই গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে কলিকাতায় যাহা ঘটে তাহাকেই এই চূড়ান্ত অবস্থার প্রথম পৰ্য্যায় বলা যাইতে পারে কিন্তু নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনাতেই ইহার স্বরূপ প্রকাশ। নোয়াখালির পর ঘটনার ধারা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আরও অগ্রসর হইয়াছে। বিহার, যুক্ত প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ এবং সর্বশেষ ও সর্বচূড়ান্ত পাঞ্জাব—এই কয়টি প্রদেশে পর পর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও প্রত্যাক্রমণের রূপে যাহা ঘটিয়াছে সেগুলিও এই একই ঐতিহাসিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এগুলিও ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালবর্তী Civil War বা গৃহযুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাক্ষেত্র। ভারতের পূৰ্ব্বসীমায় নোয়াখালিতে যে অভিযানের প্রারম্ভ দেখা দিয়াছিল পশ্চিম সীমায় পাঞ্জাবে তাহাই বৃহত্তম আকারে ঘটিয়াছে এবং এখনও পাকিস্থানী হানাদারদিগের আক্রমণে কাশ্মীরে সংঘটিত হইতেছে। পাঞ্জাবে ইহার সূত্রপাত হইয়াছে বিভাগের পূর্বে ; এবং বিভাগ হইবার পর পর্যন্ত পাঞ্জাবের পূর্ব ও পশ্চিম খণ্ডে মিলিয়া যাহা ঘটিয়াছে তাহা সকল কল্পনাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্থান অর্থাৎ পশ্চিম পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু হইতে হিন্দুর বাসের প্রায় সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটিয়াছে এবং পূর্ব পাঞ্জাব হইতে মুসলমানের বাস উৎসন্ন হইয়াছে। পাঞ্জাবের দুই দিকে মিলিয়া মোট এক কোটি লোক উদ্বাস্তু ও স্থানচ্যুত হইয়াছে। ইহা মাত্র সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ফল নহে। একটা বৃহৎ যুদ্ধেও সাধারণতঃ এই বিপুল সংখ্যক লোকের উচ্ছেদ ঘটে না। বিগত যুদ্ধে মধ্য ইউরোপ হইতে যে জনসমষ্টি উৎখাত হইয়াছে তাহাদের সংখ্যা উভয় পাঞ্জাবের মিলিত জনসংখ্যা হইতে অনেক কম। নোয়াখালির ঘটনা দেখিয়াও যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে আমরা ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম পাঞ্জাবের ঘটনা সে ক্ষেত্রে আমাদের কোন সঙ্কোচ বা সংশয়ের অবসর রাখে নাই। আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছি যে ঐতিহাসিক স্বরূপে এবং ইতিহাসের বিচারে ইহা গৃহযুদ্ধরূপেই গণ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ও প্রতিরোধে গৃহযুদ্ধ বাধাইবার প্রবৃত্তি ব্রিটিশ-অনুগ্রহ-পুষ্ট মুসলীম লীগের দিক হইতেই দেখা দিয়াছিল। ব্রিটিশের প্রসাদে রাজ্যখণ্ডের অধিকারী হইয়া এই গৃহযুদ্ধকে তাহারা অভীপ্সিত শেষ পরিণতির দিকে লইয়া গিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্থান হিন্দুশূন্য হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্থান হইতে হিন্দুদিগের ব্যাপক বাস্তুত্যাগ আরম্ভ হইয়াছে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নোয়াখালির ঘটনা দেখিয়া প্রথমেই বলিয়াছিলাম ইহা সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নহে— “It is a total war on minority”— ইহা মাইনরিটিকে সমূলে উচ্ছেদ করিবারই প্রয়াস। এতদিনে তাহা সম্পূর্ণ সত্যকার রূপে প্রকট হইয়াছে।
বিবরণ অসম্পূর্ণ
নোয়াখালিতে যাহা ঘটিয়াছে তাহার সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয় নাই, প্রকাশ করিবার উপায় ছিল না। সংবাদপত্রের অফিসে অফিসে বহু বিবরণ আসিয়া স্তুপীকৃত হইয়াছে যাহার এক ভগ্নাংশও প্রকাশত হইতে পারে নাই। তৎকালীন গভর্ণমেন্ট বিশেষ নিয়ন্ত্ৰণাদেশ জারী করিয়া উহার প্রকাশ বন্ধ করিয়া ছলেন। লুণ্ঠন, গৃহদাহ, ধৰ্মনাশ, হত্যা ও নারীহরণ-নোয়াখালি-ত্রিপুরায় এই পঞ্চাঙ্গ অভিযানের প্রথম দুইটির বিবরণ মোটামুটি বোঝা গিয়াছে এবং দ্বিতীয়টির বিবরণও অনেকটা জানা গিয়াছে, কিন্তু যে দুইটার সম্পূর্ণ বিবরণ জানিবার বিশেষ। প্রয়োজন ছিল, কিন্তু জানা গেল না এবং এখন আর জানিবার উপায় নাই তাহা হইল হত্যা ও নারীহরণ। হত্যার বিবরণ যদিও খানিকটা সংগ্রহ করা যায় নারীহরণের বিবরণ পাইবার সম্ভাবনা আরও কম। কারণ, পরিবারসমূহ বিধ্বস্ত ও বিক্ষিপ্ত, অপহৃতাগণ অপসারিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী। আপনারাই উহা গোপন করিবার জন্য উদ্বিগ্ন। যে সকল বিবরণ পাওয়া গিয়াছে এবং ঘটনাস্থলে যাহা দেখা গিয়াছে তাহা হইতে খানিকটা অনুমান করিয়া লওয়া যায়। এই দুইটা বিষয় লইয়া যাহারা সংখ্যাগত হিসাব করিতে চাহিবেন তাহারা কখনও বলিতে পারিবেন না যে — “ইহার অধিক হয় নাই; তাহারা বড় জোর বলিতে পারেন যে “এই পৰ্য্যন্ত হিসাব পাওয়া গিয়াছে বা নির্ধারিত হইয়াছে।”
যে সরকারী নিষেধাজ্ঞার ফলে নোয়াখালি-ত্রিপুরার উপদ্রব সম্বন্ধীয় সংবাদ প্রকাশে বাধার সৃষ্টি হয় তাহাতে প্রথমে বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে [এই কমিটি নিখিল ভারতীয় সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের প্রাদেশিক মুখপাত্র এবং কলিকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদিগকে লইয়া গঠিত।] একটু বিশেষ সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল। বলা হইয়াছিল, প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি যে সকল সংবাদ ও বিবরণের প্রকাশ অনুমোদন করিবেন তাহা নিষেধাজ্ঞার আমলে পড়িবে না। বহু প্রয়াসের পর কমিটি মিঃ সুরাবর্দীর নিকট হইতে এইটুকু অধিকার আদায় করিতে সমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু কমিটির কার্যের ফলে নিষেধাজ্ঞার বিধানসমূহ উল্লখিত হইতেছে এবং উহার উদ্দেশ্য পণ্ড হইতেছে এই অভিযোগ করিয়া পরে গভর্ণমেন্ট এই সুযোগ নাকচ করিয়া দেন; তবে যতটুকু কাল ইহা বর্তমান ছিল তাহারই মধ্যে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদনে নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা কিছু প্রকাশিত হইতে পারিয়াছিল। প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি না থাকিলে তাহাও প্রকাশ হইত না। এই কমিটির কর্মপরিচালনার সূত্রে এমন বহু সংবাদ ও বিবরণ পাইয়াছিলাম যাহা কমিটির পক্ষেও প্রকাশ করিতে দেওয়া সম্ভব ছিল না ; ‘আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও এইরূপ বহু সংবাদ ও বিবরণ গোচরে আসিয়াছিল এবং নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় পরিভ্রমণের সময় প্রত্যক্ষভাবেই সমস্ত শুনিবার ও দেখিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। পড়িয়া, শুনিয়া ও দেখিয়া যাহা জানিয়াছিলাম ও বুঝিয়াছিলাম তাহা হইতেই “নোয়াখালি-ত্রিপুরার ধ্বংসকাণ্ড” রচিত। ইহা ঘটনার আনুপূৰ্ব্বিক সংগ্রহ বা বিবরণ নহে। পূৰ্বেই বলিয়াছি ইহা ঘটনার দৃশ্য ও বর্ণনার সহিত জড়িত তৎকালীন চিন্তার প্রতিচ্ছবি। তৎকালীন অবস্থা বুঝিবার পক্ষে ইহার একটা স্বতন্ত্র উপযোগিতা আছে ; সেইজন্য, মধ্যে কিছু সময় বহিয়া গেলেও, প্রবন্ধগুলি যেভাবে প্রকাশিত হইয়াছিল গ্রন্থের মধ্যে সেই ভাবেই সন্নিবিষ্ট হইল ।**
শ্ৰীচপলাকান্ত ভট্টাচার্য
২৬শে বৈশাখ, ১৩৫৫…
৯ই মে, ১৯৪৮, ..
কলিকাতা।
** নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ডের অত্যন্ত-বিলম্বিত প্রকাশের উদ্যোগে এই ভূমিকা লিখিত হইবার পর পুনরায় উহার প্রকাশ স্থগিত হয়। “রাডক্লিফ বাটোয়ারায় কৃত অন্যায়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ যে ভাবে নদীয়া জেলায় ছয়শতাধিক বর্গমাইল ভূমি হইতে প্রবঞ্চিত হইয়াছে তৎপ্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং উহার সংশোধনের জন্য আলোচনার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে প্রবৃত্ত হই। সে আলোচনা সম্প্রতি সমাপ্ত হইয়া “Radclife Awarda Case for Revision” আখ্যায় ইংরাজীতে এবং “বাঙলায় রাডক্লিফ বাটোয়ারা সংশোধনের দাবী’–এই আখ্যায় বঙ্গভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। ইংরাজী গ্রন্থের ভূমিকায় নোয়াখালির প্রসঙ্গে যাহা বলা হইয়াছে তাহা এখানেও উল্লেখযোগ্য :-
প্রথম অধ্যায়: সূচনা
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস ; ১৬ই আগষ্ট কলিকাতা সহরে মুসলীম লীগ যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছিল তাহার জের তখনও পূরা মাত্রায় চলিতেছে ; কলিকাতা মহানগরী বিপর্যস্ত ; লোকের জীবনযাত্রা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ; ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রকোপ কলিকাতা অতিক্রম করিয়া পূর্ববঙ্গে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ; পূর্ববঙ্গের মফঃস্বল হইতে হিন্দুনিগ্রহের নিত্য নূতন সংবাদ আসিতেছে ; কলিকাতায় অনুষ্ঠিত ঘটনার জন্য সুরাবর্দী-মন্ত্রিমণ্ডলকে ধিকৃত করিয়া ২৯শে সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উঠিয়াছে এবং তাহার উত্তরে বলা হইয়াছে যে মন্ত্রিমণ্ডলকে অপদস্থ করিবার এই চেষ্টার ফল পূর্ববঙ্গের হিন্দুদিগকে ভোগ করিতে হইবে [অনাস্থা-প্রস্তাবের আলোচনায় লীগ-মন্ত্রী মৌলবী সামসুদ্দীনের বক্তৃতা ; পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত রিপোর্টারদের নিকট জানা যায় লীগদলভুক্ত অপর একজন বিশিষ্ট সদস্য নোয়াখালির নাম করিয়াই সতর্ক করিয়াছিলেন]। বস্তুতঃ বক্তৃতায় ভীতিপ্রদর্শনছলে যাহা বলা হইয়াছিল পূর্ববঙ্গে তখন তাহা কাৰ্যতঃ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। ২০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশ, পূর্ববঙ্গের উপদ্রব দমনের জন্য থানায় থানায় মিলিটারী বসাইবার প্রয়োজনীয়তা দেখাইয়া নারায়ণগঞ্জ হইতে শ্রীআনন্দমোহন পোদ্দার বাঙলার গভর্ণরের নিকট ও ভারত গভর্ণমেন্টের নিকট টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছেন এবং কুমিল্লা হইতে শ্রীকামিনী কুমার দত্ত ও শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারত গভর্ণমেন্টের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করিয়া জানাইয়াছেন, অবিলম্বে রক্ষাব্যবস্থা না করিলে গুরুতর অবস্থা দেখা দিবে, কারণ মুসলমান সরকারী কর্মচারীরা প্রকাশ্যেই হিন্দুদিগকে ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে নোয়াখালির প্রতিনিধি শ্ৰীহারাণচন্দ্র ঘোষ চৌধুরী ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখের আলোচনায় জেলার অবস্থার প্রতি গভর্ণমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বলিয়াছেন এবং জেলার নানা স্থানে অনুষ্ঠিত অত্যাচারের দীর্ঘ তালিকা সংবাদপত্রে প্রকাশ করিতেছেন [অমৃতবাজার পত্রিকা ২৩/৯/৪৬ এবং হিন্দুস্থান ষ্টান্ডার্ড ২৪/৯/৪৬। ইহাই বর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৮/৯/৪৬ তারিখে।]। ইহা ছাড়া অন্যান্য বিবৃতিতেও অবস্থার প্রতিকারের জন্য গবর্ণমেন্টের নিকট পুনঃ পুনঃ দাবী করা হইয়াছে। ইহার পরেই আসে ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জে হিন্দুদিগের উপর আক্রমণের সংবাদ। তাহার পর ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ঐ জেলার কেরাণীগঞ্জ থানা হইতেও হিন্দুসমাজের উপর অধিকতর ব্যাপক আক্রমণের সংবাদ আসে এবং সর্বত্র প্রবল উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
সংবাদ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ
এই অবস্থায়, ২৬শে সেপ্টেম্বর, প্রধান মন্ত্রী মিঃ সুরাবর্দী কলিকাতার সংবাদপত্র সম্পাদকদিগকে সেক্রেটারিয়েটে একটি বিশেষ বৈঠকে আহ্বান করিলেন। সম্পাদক-বৈঠকে মিঃ সুরাবর্দী জানাইলেন যে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও সংঘর্ষ সম্পর্কিত সংবাদের প্রকাশ নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য তিনি ভারতরক্ষা আইনের বিধান অনুসারে একটা বিশেষ আদেশ জারী করিতে মনস্থ করিয়াছেন। তাঁহার অজুহাত এই যে, কলিকাতায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি-সম্পর্কিত সংবাদ যথেচ্ছ প্রকাশিত হইতেছে বলিয়াই দেশের অন্যান্যস্থানে তাহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেছে ; বিশেষতঃ কলিকাতার সংবাদপত্রসমুহ হিন্দুদিগের দিকে টানিয়াই সংবাদ প্রকাশ করিতেছে। বলা বাহুল্য, কলিকাতার জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহকে লক্ষ্য করিয়াই মিঃ সুরাবর্দী উক্ত মন্তব্য করেন। সংবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিঃ সুরাবর্দী যে আদেশের খসড়া রচনা করিয়াছিলেন, তাহা বৈঠকে শুনাইলেন। উহার প্রধান নির্দেশ ছিল এই যে, বাঙলা দেশে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবসংক্রান্ত ঘটনার কোনোরূপ উল্লেখ করিতে হইলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বাদ দিতে হইবে :—
(১) ঘটনার স্থানের উল্লেখ [পরে থানার উল্লেখ অনুমোদিত হইয়াছিল।]
(২) ঘটনায় মৃত অথবা আহত ব্যক্তিদের আঘাত বা মৃত্যুর কারণের উল্লেখ
(৩) আক্রান্ত বা আক্রমণকারী ব্যক্তিদের নাম বা সম্প্রদায়ের উল্লেখ
(৪) দেবস্থান বা পূজার বস্তু অপবিত্র করার বর্ণনা
(৫) ঘটনার এবং ঘটনায় মৃত ও আহত ব্যক্তিগণের ফটো বা অন্য কোনোরূপ চিত্র।
ইহা ছাড়া আরও একটি বিষয় নিষিদ্ধ হয়, খবরের হেডিংএর হতাহতের সংখ্যার উল্লেখ। এই সমস্ত নিষেধ-বিধান কেবল সংবাদপত্রে প্রাপ্ত সংবাদের উপর প্রযোজ্য হইবে, কিন্তু গভর্ণমেন্ট স্বীয় অভিপ্রায়ানুরূপ যে কোনো সংবাদ প্রকাশ করিতে পারিবেন, তাহাতে ইহা প্রযোজ্য হইবে না। আদেশের খসড়াটি পড়িয়া মিঃ সুরাবর্দী উহার সম্বন্ধে উপস্থিত সম্পাদকগণের মতামত জানিতে চাহিলেন।
প্রত্যুত্তরে বলিলাম—“আপনার এই আদেশের বিধানসমূহ শুনিয়া। যাহা মনে হইতেছে তাহা খোলাখুলি বলিতে পারি কি ?”মিঃ সুরাবর্দী—“কেন বলিবেন না?”
বলিলাম—“আমার মনে হইতেছে, পূর্ববঙ্গে যে সকল অত্যাচার কাণ্ড ঘটিতেছে এবং যাহা ঘটিতে যাইতেছে তাহা চাপা দিবার জন্যই আপনার এই আদেশের ব্যবস্থা।”
এই কথা শুনিয়া মিঃ সুরাবর্দী রুষ্ট হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, “আপনি একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে রহিয়াছেন, আর আপনি আমার আদেশের এই কদৰ্থ করিতেছেন?”
উত্তরে বলিলাম—“মার্জনা করিবেন। আপনার আদেশের অন্য কোনো অর্থ আমার মনে আসিতেছে না; অন্য কোনো অর্থ হয়ও না ; এখানে বাহিরের লোক নাই, অন্ততঃ এই ঘরের মধ্যে পরস্পরের মনের কথা খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করিতে দিন ”
মিঃ সুরাবর্দীর অজুহাত
মিঃ সুরাবর্দী অধিকতর উত্যক্ত হইয়া উঠিতেছেন দেখিয়া বলিলাম, “আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আপনি “বলিয়াছেন, – সংবাদপত্রে সাম্প্রদায়িক অশান্তি-সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়াতেই মফস্বলে অশান্তি দেখা দিতেছে। যে সংবাদপত্রগুলি আপনার মন্তব্যের লক্ষ্য সেগুলিতে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের সংবাদটাই ফলাও করিয়া ছাপা হয়—ইহা আপনার ধারণা। সুতরাং ইহার প্রতিক্রিয়া যদি কোথাও দেখা দেয় তো পশ্চিমবঙ্গেই দেখা দেওয়া উচিত, পূর্ববঙ্গে দেখা দিতে পারে না। পূর্ববঙ্গে যাহা ঘটিতেছে তাহা যদি কিছুর প্রতিক্রিয়া হয় উহা আপনার দলীয় মুসলিম লীগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত মুসলমানের উপর হিন্দুর অত্যাচারের কাল্পনিক সংবাদের প্রতিক্রিয়া। সুতরাং দায়ী করিতে হইলে তাহাদিগকেই দায়ী করিতে হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গে এই সকল ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে যখন কোন প্রতিক্রিয়া নাই তখন জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহকে দায়ী করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই।” তথ্য ও যুক্তি দিয়া ইহা খণ্ডন করিবার উপায় ছিল না। মিঃ সুরাবর্দী কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন “পশ্চিমবঙ্গেও এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া আমি সংবাদ পাইয়াছি।”
উত্তরে বলিলাম, “আপনি একটি প্রকাশিত ঘটনার বিবরণ দেখান ; পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের উপর কোন অত্যাচার হইলে আপনার দলীয় সংবাদপত্রসমূহ কখনই তাহা প্রকাশ করিতে ছাড়িত না।”
মিঃ সুরাবর্দী—“প্রকাশিত হয় নাই বটে কিন্তু স্থানীয় লোকেরা আমাকে খবর দিয়া গিয়াছে।”
হোম সেক্রেটারী মিঃ মার্টিন প্রধান মন্ত্রীর পার্শ্বে বসিয়াছিলেন, তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “কেমন মিঃ মার্টিন আপনিও কি এইরূপ খবর পান নাই ?”, মিঃ মার্টিন বলিলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও এইরূপ খবর পাইয়াছি বটে।”
মিঃ মার্টিনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলাম –“মিঃ মার্টিন, আপনার ডিপার্টমেন্ট এইরূপ ঘটনার কোন রিপোর্ট আসিয়াছে কি ?”
তিনি বলিলেন—“না, তবে, লোকে আমাকে বলিয়া গিয়াছে।”
উত্তর বলিলাম—“মিঃ মার্টিন, আপনার হাতে কোন রিপোর্ট নাই, তত্ৰাচ যদি আপনি বলেন যে পশ্চিমবঙ্গে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে তাহা হইলে আমি বলি আপনি যে পদ অধিকার করিয়া আছেন তাহার যোগ্যতা আপনার নাই।”
প্রেস এডভাইসরী কমিটি উপেক্ষিত ও আদেশ জারী
এইভাবে কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর মিঃ সুরাবর্দী ও সিভিলিয়ানবর্গ হয়তো আপনাদের আচরণের অসঙ্গতি উপলব্ধি করিলেন এবং আদেশটা সদ্য সদ্য জারী করিরার উদ্যোগ স্থগিত রাখিতে সম্মত হইলেন। সম্পাদকগণের দিক হইতে প্রস্তাব হইল গভর্ণমেন্ট এইরূপ আদেশ জারী না করিয়া বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির উপর এই শ্রেণীর সংবাদ নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পণ করিয়া নিরস্ত থাকুন। গত মহাযুদ্ধের সময় গভর্ণমেন্ট বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির সাহায্য লইয়াছেন। বর্তমান অবস্থাতেও সেই ব্যবস্থাই পুনরায় প্রবর্তিত হইতে পারে। উভয় পক্ষের এই কথাবার্তার পর আলোচনা চারদিনের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত করা হইল। স্থির হইল ৩০শে সেপ্টেম্বর, সোমবার পুনরায় সম্পাদকগণের সহিত মিলিত হইয়া মিঃ সুরাবর্দী এবিষয়ে সিদ্ধান্ত করিবেন। ইতিমধ্যে সম্পাদকগণ পরামর্শ করিয়া দেখিবেন প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে দিয়া কি ভাবে সংবাদ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হইতে পারে।
এই কথাবার্তা অনুসারে ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে “ষ্টেটসম্যান” পত্রিকার অফিসে বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির আহ্বানে সম্পাদকগণের এক সভা হয় এবং সাম্প্রদায়িক উপদ্রবের সংবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সাব-কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মিঃ সুরাবর্দীর নিকট প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ সুরাবর্দীর পক্ষ হইতে একটি জরুরী পত্ৰ আসে, ঐ পত্রে জানানো হয় যে, গভর্ণমেণ্ট পূর্ব প্রস্তাবমত ৩০শে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করিবেন না, সেই দিনই সিদ্ধান্ত করিতে মনস্থ করিয়াছেন এবং তজ্জন্য সম্পাদকদিগের এক জরুরী বৈঠক আহুত হইয়াছে। গভর্ণমেন্টপক্ষের এই মতিপরিবর্তনে বিস্মিত হইয়া সম্পাদকগণ সেক্রেটারিয়েটের বৈঠকে উপস্থিত হইলেন। মিঃ সুরাবর্দী জানাইলেন, তিনি আর অপেক্ষা করিতে পারিবেন না; আদেশ সদ্যই জারী হইবে; বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির উপর সমস্ত ভার ছাড়িয়া দেওয়ার যে প্রস্তাব হইয়াছিল গভর্নমেন্ট তাহাতে সম্মত নহেন, তবে কমিটিকে সুযোগ দিবার জন্য গভর্ণমেন্ট এইটুকু করিতে রাজী আছেন যে, কমিটির অনুমোদিত সংবাদও গভর্ণমেন্টের অনুমোদিত সংবাদের ন্যায় প্রকাশিত হইতে পারিবে, নূতন আদেশের মধ্যে এই ব্যবস্থা থাকিবে [ব্যবস্থাটি এইঃ-“Provided that nothing in this order shall apply to any matter communicated by the Provincial Government to the Press or any communication issued to the Press by the Press Advisory Committee, Bengal.”] ।
এই ব্যবহারে, বিশেষতঃ প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদিত সংবাদকে সরকারী বিবৃতির সমপৰ্যায়ভুক্ত করায় সকলেই অত্যন্ত বিরক্ত হন। আলোচনাপ্রসঙ্গে মিঃ সুরাবর্দীকে জিজ্ঞাসা করি, “আপনি সকলের অনুরোধ অগ্রাহ্য করিয়া সহসা এই আদেশ জারী করিতেছেন। এই আদেশ জারীর কতদিনের মধ্যে আপনি অশান্তি প্রশমিত করিতে পারিবেন বলিয়া মনে করেন ?”
মিঃ সুরাবর্দী বলিলেন, “এই আদেশ যদি জারী হইতে পারে তাহা হইলে তিন দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিতে পারিব।” এই আদেশই ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতরক্ষা আইনের বিধানানুযায়ী বিশেষ আদেশরূপে জারী হয়।
সংবাদপত্রের প্রতিবাদ
মিঃ সুরাবর্দীর এই হঠকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইবার জন্য ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখেই অমৃতবাজার পত্রিকার সিটি অফিসে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও পরিচালকদিগের এক সভা হয়। সভায় স্থির হয় যে, সংবাদপত্রসমূহের প্রকাশ স্থগিত রাখাই প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সুষ্ঠু উপায়। ১লা অক্টোবর হইতে প্রকাশ স্থগিত রাখিবার জন্য সকল সংবাদপত্রকে অনুরোধ জানাইয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং গত কয়েকদিনের যে সকল ঘটনার ফলে সভা এই প্রস্তাব গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন সভার পক্ষ হইতে চারিজনের স্বাক্ষরে এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া তাহা সকলকে জানানো হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখের সংবাদপত্রে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় সরকারী নিয়ন্ত্ৰণাদেশ এবং তাহার প্রতিবাদে সংবাদপত্র-প্রতিনিধিদিগের সিদ্ধান্ত ও বিবৃতি। প্রত্যুত্তরে মিঃ সুরাবর্দী ১লা অক্টোবর তারিখের এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া জানান যে, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করিবার বা প্রকৃত ঘটনা চাপা দিবার ইচ্ছা তাহার নাই। ১লা অক্টোবর তারিখে পুনরায় সংবাদপত্র প্রতিনিধিগণের এক সভায় মিঃ সুরাবর্দীর এই বিবৃতি বিবেচিত হয় এবং গভর্ণমেন্টকে পুনরায় অনুরোধ করা হয় যে তাহারা আদেশ প্রত্যাহার করিয়া বিরুদ্ধ-ভাবমুক্ত অবস্থার মধ্যে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে কাজ করিতে দিন। সভার পক্ষ হইতে চারিজনের স্বাক্ষরে এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া সভার এই সিদ্ধান্ত এবং মিঃ সুরাবর্দীর প্রত্যুত্তরে সভার বক্তব্য বিজ্ঞাপিত করা হয়। বলা বাহুল্য, গভর্ণমেন্ট ইহার প্রতি কোনো সুবিবেচনা করেন নাই; ফলে ১লা অক্টোবর হইতে কলিকাতায় জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহের প্রকাশ বন্ধ হইয়া যায়।
ন্যূনপক্ষে ২১ খানি পত্রিকার [আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান ষ্টাণ্ডার্ড, দেশ, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, বসুমতী, ভারত ইষ্টার্ণ এক্সপ্রেস, কৃষক, মাতৃভূমি, এ্যাডভ্যান্স, বিশ্বমিত্র, লোকমান্য, জাগৃতি, জয়হিন্দ, প্রত্যহ, ন্যাশনালিষ্ট, উষা, নবযুগ, স্বাধীনতা, দেশদর্পণ।] প্রকাশ স্থগিত থাকে। ইতিমধ্যে ঘটনার গতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হয় এবং নূতন ঘটনার উদ্ভব হইতে থাকে। কয়েকদিন এইরূপ চলিলে লোকের মধ্যে দারুণ উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। তাহার ফলে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও পরিচালকগণ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের জন্য জনসাধারণের পক্ষ হইতে বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হন। ৬ই অক্টোবর পুনরায় তাঁহারা এক সভায় সমবেত হইয়া পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত করেন। স্থির হয়, সরকারী নিয়ন্ত্ৰণাদেশে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে তাহা কাৰ্যতঃ পরীক্ষা করিয়া দেখতে হইবে।
নোয়াখালির উপদ্রবের সংবাদ
এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ৮ই অক্টোবর হইতে পত্রিকাসমূহ পুনরায় প্রকাশলাভ করে এবং প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির পক্ষ হইতে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবঘটিত সংবাদের সংগ্রহ, সম্পাদন ও প্রচারের ব্যবস্থা হয়। ইহার প্রায় অব্যবহিত পরেই নোয়াখালির ঘটনা ; ১০ই অক্টোবর ঘটনা আরম্ভ হয় এবং ১১ই অক্টোবর হইতেই কলিকাতায় লোকমুখে প্রচারিত হইতে থাকে যে, নোয়াখালিতে প্রবল ও ব্যাপক আকারে অরাজকতা দেখা দিয়াছে এবং তথাকার হিন্দুসমাজের উপর ভয়াবহ অত্যাচার সংঘটিত হইয়াছে। তৎকালে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবের অন্যান্য সকল সংবাদকে অতিক্রম করিয়া নোয়াখালির ঘটনার সংবাদ যে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চিত আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা বিস্মৃত হইবার নহে। কিন্তু ১৪ই অক্টোবর পর্যন্ত নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট সংবাদ কিছু পাওয়া যায় নাই। ১৪ই অক্টোবর প্রথম সংবাদ আসে ; যতদূর মনে হইতেছে প্রথম সংবাদের প্রেরক নোয়াখালি মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং পাইকপাড়া জমিদারীর অন্তভুক্ত স্থানীয় ভুলুয়া ষ্টেটের ম্যানেজার শ্রীপ্রফুল্ল কুমার ভৌমিক। তাহাদের এই টেলিগ্রাম দিল্লীতে তৎকালীন ভারত, গভর্ণমেন্টের সদস্য শ্রীশরৎচন্দ্র বসুর নিকটেও প্রেরিত হইয়াছিল। ১৪ই তারিখে প্রাপ্ত সংবাদ প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদন ক্রমে ১৫ই তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। নোয়াখালি-ত্রিপুরার ধ্বংসকাণ্ড সম্বন্ধে কলিকাতায় সংবাদ প্রকাশ এই প্রথম। সংবাদটি এইঃ –
“নোয়াখালি জেলায় সঙ্ঘবদ্ধভাবে গুণ্ডামীর সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। উত্তেজিত জনতা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র লইয়া বিভিন্ন গ্রামে হানা দিতেছে এবং গত ১০ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার হইতে ব্যাপকভাবে খুন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চলিতেছে। বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, নারীহরণ এবং ধৰ্ম্মস্থান অপবিত্র করার সংবাদও পাওয়া গিয়াছে। এপর্যন্ত যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে তাহাতে জানা যায় যে, সদর ও ফেণী মহকুমার দুইশতাধিক বর্গমাইল পরিমিত স্থানে হাঙ্গামা চলিতেছে। উপদ্রুত অঞ্চলের প্রবেশপথসমূহে সশস্ত্র গুণ্ডাগণ পাহারা দিতেছে। বহুলোক নিহত অথবা জীবন্ত দগ্ধ হইয়াছেন— তাহাদের মধ্যে জেলা উকীল-সভার সভাপতি ও তাহার পরিবারবর্গ এবং জেলার একজন বিশিষ্ট জমিদারও আছেন।
কলিকাতার সরকারী মহলে সংবাদ লইয়া জানা গেল যে, উপদ্রুত অঞ্চলে সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশ প্রেরণ করা হইয়াছে। সমগ্র রামগঞ্জ থানা এবং লক্ষ্মীপুর থানা, রায়পুর থানা, সেনবাগ থানা, ফেণী থানা, ছাগলনাইয়া থানা, সন্দ্বীপ থানা ও বেগমগঞ্জ থানার কিয়দংশ উপদ্রুত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।”
(“আনন্দবাজার পত্রিকা”, ১৫ই অক্টোবর, ১৯৪৬)
(ক্রমশঃ)