একুশের ভোট আসছে। তার আগে ‘কার পক্ষে বাংলা’ নিয়ে যখন জোর তর্ক চলছে, তখন রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় শিল্পশহর হলদিয়ায় কেস স্টাডি পেশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের বক্তৃতায় প্রথমে জানাতে চাইলেন লুঠ, হিংসা, অপশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির মতো রোগে কথা। তার পর জানালেন, এর কী ওষুধ পেতে পারে বাংলা, তাঁর কাছেই বা এর কী ওষুধ রয়েছে।
বিজেপি নেতারাও ভাল করে বুঝতে পারছেন যে কেবল মেরুকরণের অস্ত্রে তৃণমূল বধ হবে না। উন্নয়ন ও শিল্পায়নের জন্য বাংলায় প্রবল ক্ষুধা ও তৃষ্ণা রয়েছে। তাই বিকল্প মডেলও দেখাতে হবে। এবং দুই সেই মডেল বিশ্বাসযোগ্যও হতে হবে।
এদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা সে ভিন্ন ছিল না। হলদিয়ায় হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করেন গত কয়েক দশকে বাংলার অধঃপতন কতটা হয়েছে। তাঁর কথায়—
• “আজ যখন বাংলায় এসেছি, একটা প্রশ্ন করতে চাই। পরাধীন ভারতেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের অগ্রসর ও উন্নত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। সেই সময়ে বাংলায় রোজগার ছিল, বাংলার মানুষ স্বনির্ভর ছিলেন, এখানকার শিল্প বাণিজ্যে ছিল অতুলনীয়। কারণ, বাংলার মানুষ পরিশ্রমী, মেধাবি, এখানকার জমি উর্বর”।
• “কিন্তু কেন সেই উন্নয়নের গতি বাংলা ধরে রাখতে পারেনি? গত দশকে (পড়ুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায়) সেই গতি যদি অব্যাহত থাকত, তা হলে বাংলায় কোথায় পৌঁছে যেত! তা হলে কী এমন হল যে বাংলা পিছিয়ে গেল? কী এমন হল যে এখানকার ব্যবসায়ী, শিল্পমহল, উদ্যোগপতিরাও পরিবর্তন ও আধুনিকীরণ চাইছেন”।
এ কথা বলেই প্রধানমন্ত্রী এর পর কারণগুলি এক, দুই করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তাঁর কথায়—
• আজ বাংলার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করব। গ্যাস কানেকটিভিটি আর রোড কানেকটিভিটির এই প্রকল্প এখানে সুবিধা বাড়াবে ও রোজগারের সুযোগ তৈরি করবে।
• কলকাতায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকায় মেট্রো লাইনের সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। এ বার বাজেটেও প্রচুর বরাদ্দ করা হয়েছে।
• তা ছাড়া বাংলায় সড়ক নির্মাণে বহু হাজার (২৫ হাজার) কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে।
• পাঞ্জাব থেকে ডানকুনি পর্যন্ত পণ্যবাহী রেল করিডর নির্মাণের কাজ দ্রুততার সঙ্গে এগোচ্ছে। সেই সঙ্গে খড়্গপুর থেকে বিজয়ওয়াড়া পর্যন্ত নতুন পণ্যবাহী করিডরের ঘোষণা হয়েছে বাজেটে।
• পূর্ব মেদিনীপুরে একটা মৎস্যবন্দর তৈরি করা হবে। তাতে মৎস্যজীবীদের উপকার হবে।
• তা ছাড়া এ বার বাজেটে চা বাগানের শ্রমিকদের জন্যও ১ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। চা বাগানের মহিলা শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ করে ওই অর্থ খরচ করা হবে।
• বাংলায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ৩৭ লক্ষ গৃহ নির্মাণের জন্য টাকা দিয়েছে কেন্দ্র, সেই সঙ্গে ৭৩ লক্ষ শৌচাগার নির্মাণ করতে অর্থ দিয়েছে।
• পিএম কিষাণ প্রকল্পের টাকা মমতা দিদির সরকার বাংলার চাষীদের পেতে দেয়নি, কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। বকেয়া ১৪ হাজার টাকাও দেওয়া হবে।
• বাংলায় উন্নয়নের জন্য ডবল ইঞ্জিন সরকার চাই। কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও ক্ষমতায় চাই বিজেপিকে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে কি মেরুকরণ বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিষয়আশয় একবার ছুঁয়েও গেলেন না প্রধানমন্ত্রী?
তাও ছিল। বস্তুত বিজেপির সেই মৌলিক রাজনৈতিক অস্ত্র এদিনও প্রচারে পড়তে পড়তে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কখনও বলেছেন, দেশ বিরোধী শক্তি যখন ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তখন একবারও মুখ খোলেননি মমতা দিদি। ভারত মায়ের নামে স্লোগান তুললে দিদির রাগ হয়। কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে কথা বললে কোনও রাগ হয় না।
সেই সঙ্গে জয় শ্রীরাম প্রসঙ্গেও দিদিকে খোঁচা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি ভিক্টোরিয়ায় নেতাজির জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে মমতার বক্তৃতার আগে জয় শ্রীরাম স্লোগান উঠেছিল। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বক্তৃতাই দেননি মমতা। এদিন সেই কথা না তুললেও প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলায় মানুষের ফুটবল প্রেম সুবিদিত। তাই ফুটবলের ভাষায় বলছি, তৃণমূল একটার পর একটা ফাউল করেছে। অপশাসনের ফাউল, মানুষের টাকা লুঠ করার ফাউল, বিরোধীদের উপর হিংসা আর অত্যাচারের ফাউল.. বাংলার মানুষ সব দেখেছে। তাই খুব শিগগির বাংলার মানুষ তৃণমূলকে রাম কার্ড দেখাতে চলেছে”।
আর সব শেষে বাংলায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোটের ভাগাভাগি রোখার জন্য বার্তা দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অতীতে দেখা যেত, বাম বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুবিধা পেয়ে যেতেন জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা। প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “তৃণমূলের সঙ্গে বাম, কংগ্রেসের ছুপা দোস্তি রয়েছে। দিল্লিতে ওরা এক ঘরে বসে গোপনে বৈঠক করে। তাই তাঁদের ধোঁকাবাজির শিকার যেন না হয় মানুষ।”
প্রধানমন্ত্রী এদিন তাঁর সব রকম ওষুধ যে এদিনই বলে দিয়েছেন, তা ভাবলে হয়তো সরলিকরণ হবে। তবে তাঁর ওষুধ বাংলা মানুষ নেন কিনা, কত জন নেন, কী পরিমাণ ডোজ নেন তা সময় বলবে।