শিল্পায়নের জন্য ‘ক্ষুধার্ত’, ‘তৃষ্ণার্ত’ বাংলায় আজ শিল্পশহর থেকে একুশের প্রচারে মোদী

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্বের সঙ্গে দাবি করেন, একশ দিনের কাজে বাংলা ১ নম্বরে। এ কথা শুনে অনেকের যেমন ভাল লাগে, তেমনই আরও আরও অনেকে মনে করেন বাংলায় শিল্পে খরা চলছে। শিক্ষিত যুবক, দক্ষ শ্রমিক এমনকি অদক্ষ শ্রমিকেরও কাজের জায়গা নেই। সরকারের দয়ায় তাই একশ দিনই ভরসা। কিন্তু বাকি ২৬৫ দিন?
পরিস্থিতি যখন এমনই তখন আজ রবিবার শিল্পশহর হলদিয়া থেকে একুশের ভোটে তাঁর প্রচার অভিযান শুরু করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যা তাৎপর্যপূর্ণ বইকি।

কেন?

পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, কারণটা পরিষ্কার। এগারো সালে বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর মেরুকরণের রাজনীতিতে আগে ধার দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু ইমামদের জন্য ভাতা ঘোষণা নয়, আচারে বিচারে, আদব কায়দায় মুখ্যমন্ত্রী এমন আবহ তৈরি করতে চেয়েছেন যাতে সংখ্যালঘু ভোটের এক মাত্র ঠিকানা হয়ে ওঠে তাঁর দল। তা বাহ্যত যাই দেখতে লাগুক, পরোয়া করেননি তিনি। সেই উর্বর জমিতে অমিত শাহরা সার দিয়েছেন, জল দিয়েছেন, বীজ ঢেলেছেন। তাতে তর তর করে বেড়ে উঠে উনিশ সালেই ১৮ ছুঁয়ে সাবালক হয়ে গেছে গাছ। অর্থাৎ বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণের প্রশ্ন এখন সম্পূর্ণ।

তা হলে নতুন কী? একুশে তৃণমূল-বিজেপি ফারাক কোথায় হবে? বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রের নেতারা মনে করছেন, শিল্পায়ণ ও উন্নয়নের জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত পশ্চিমবঙ্গ। তাঁদের মতে, শুধু মেরুকরণ বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা দিয়ে চলবে না। উন্নয়নের বিকল্প মডেল দেখাতেই হবে। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষিতে আধুনিকীকরণ ও বড় শিল্প স্থাপনের মডেল দেখাতে হবে, যাতে বাংলায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। তা ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের পথ যেন সুগম হয় ও পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমে এবং ঘরের ছেলে পাড়ায় কাজ পায়। এমনকি একশ দিনের কাজের উপর নির্ভরতা কমে অদক্ষ শ্রমিকেরও বছর ভর রোজগারের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

ফলে শুধু আম বাঙালি নয়, রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় হলদিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার জন্য অসীম আগ্রহ রয়েছে গেরুয়া শিবিরেরও। বাংলায় উন্নয়নের কী বিকল্প মডেল দেখান প্রধানমন্ত্রী।

বস্তুত এ কথা ষোল আনার উপর আঠারো আনা খাঁটি যে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অবনতির কারণেই বাংলায় সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়ন বার বার ধাক্কা খেয়েছে। অতীতে বামেরা ঐতিহাসিক ভাবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার রাজনীতি করেছেন। পাইনি পাইনি করে কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু সেই বামেরাই ২০০৪ সালে যখন কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের চালিকা শক্তি হয়, দেখা যায় গ্রামোন্নয়ন ও সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়নে বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের সরকার অঢেল সাহায্য পেয়েছে। এমনকি রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরাতে বুদ্ধবাবু প্রস্তাবিত ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স খাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মনমোহন সিংহ সরকার।

আবার দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে কেন্দ্রে শরিক দল ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এগারো সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বাংলায় ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে তিনি সরকার গঠনের পর থেকেই দিল্লি থেকে ধারাবাহিক সাহায্য পেয়েছেন। শপথ নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নে ৮৭৫০ কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাংলায় গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ, একশ দিনের কাজ প্রকল্পে ঢেলে অর্থ সাহায্য করেছিল গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও গ্রামোন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অটুট রেখেছিলেন জয়রাম রমেশরা।

তবে চোদ্দ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসতেই ফের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যায়। অনেকের মতে, তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক চাপানউতোরে বলি হয় সহযোগিতা মূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবেশ। এবং ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলায় গ্রাম গঞ্জে তার পর আর আগের মতো গতিতে রাস্তা তৈরি হয়নি। এমনকি পুরনো রাস্তার মেরামত করতে গিয়েও অর্থাভাবে বেগ পেতে হয়েছে।

একুশের নির্বাচনে এই বিষয়টাও বাংলায় কৌশলে চাড়িয়ে দিতে চাইছে বিজেপি। বোঝাতে চাইছে, কেন্দ্রে রাজ্যে একই সরকার থাকলে তবেই আরও উন্নয়ন সম্ভব হবে। সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তখন উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে উঠবে না রাজনীতি।

শুধু বিজেপি নয়, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের অভাবের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করছে বাম, কংগ্রেসও। সুজন চক্রবর্তী সিঙ্গুরের গেটে দাঁড়িয়ে শিলান্যাস করছেন। অধীর চৌধুরী বলছেন, বাংলায় শিল্প বন্ধ করে নটে শাক চাষ করা মমতাই শিখিয়েছেন। তবে সমস্যা হল, বিকল্প উন্নয়নের মডেল যেমন তাঁরা এখনও দেখাতে পারেননি। তেমনই এ ব্যাপারে বামেদের পূর্ব রিপোর্ট কার্ডও উজ্জ্বল নয়।

তবে হ্যাঁ, পর্যবেক্ষকরা এও মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহরা যে বিকল্প উন্নয়নের মডেল দেখাবেন তা বিশ্বাসযোগ্যও হওয়া চাই। বিজেপি তথা কেন্দ্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নাটুকেপনার অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদের। তাঁরা বলেন, যত না কাজ হয়, তার তুলনায় ঢক্কানিনাদই বেশি। বাস্তবে কাজের কাজ কম হচ্ছে।

হতে পারে সেই কারণেই রবিবার রাজনৈতিক সভার পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনও করবেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯০ কোটি টাকা খরচ করে ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর উড়ালপুল, ১১০০ কোটি টাকা খরচ করে এলপিজি গ্যাস আমদানি টার্মিনাল, ২৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ধোবি-দুর্গাপুর প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন তৈরি হয়ে গেছে। সেই উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে। রবিবার তারই উদ্বোধন করবেন নরেন্দ্র মোদী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.