ভ্যাকসিন নিলেও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে, এটা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না কোনও বিজ্ঞানীই। সংক্রমণের ঝুঁকি কার শরীরে কতটা, মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে কিনা সেসব কিছু প্রাথমিক রিস্ক ফ্যাক্টর দেখে আন্দাজ করা গেছে মাত্র। তবে এখন এইসবই সঠিকভাবে বলা সম্ভব। তার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এমন এক অ্যাপ বানিয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী যা বলে দেবে কোভিড সংক্রমণের এ টু জেড। সংক্রমণে মৃত্যু হতে পারে কিনা তার আগাম খবর দেবে, পুণঃসংক্রমণ বা রিইনফেকশনের ঝিঁকি আছে কিনা তাও বলে দেবে। শুধু ব্যক্তি বিশেষে নয়, একটা গোটা গোষ্ঠীতে সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা তাও বলা সম্ভব হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বানিয়েছেন এই নতুন অ্যাপ। বাঙালি বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের খবর ছাপা হয়েছে বিশ্বের প্রথম সারির সায়েন্স জার্নাল ‘নেচার মেডিসিন’-এ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এর আগেও নানারকম কম্পিউটার অ্যালগোরিদম বানিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা। যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি চেষ্ট-এক্স রে কোভিড সংক্রমণ নির্ভুলভাবে ধরে দিতে পারে। আবার কাশির শব্দ শুনে করোনা রোগীকে শণাক্ত করতে পারে এমন কম্পিউটার অ্যালগোরিদমও রয়েছে। উপসর্গহীন রোগীদের চিহ্নিত করার মতো অ্যাপও রয়েছে। তবে একটা গোটা কমিউনিটিতে সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা, কার শরীরে ভাইরাসের পুণঃসংক্রমণ সম্ভব, টিকা সবচেয়ে আগে দরকার কার, এসব বলা সম্ভব হয়নি এতদিনেও। নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের অ্যাপ সেই অসম্ভব কাজই সম্ভব করবে বলে দাবি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স)তৈরি এই অ্যাপ বলবে সংক্রমণের হালহকিকত
করোনার টিকাকরণ শুরু হয়ে গেছে ব্রিটেন, আমেরিকায়। ভ্যাকসিন বিতরণ চলছে রাজ্যগুলিতে। নীলাঞ্জনবাবু বলেছেন, এখনও কোভিড সংক্রমণ চিহ্নিত করা যায়নি এমন বহু মানুষ রয়েছেন। এমন কিছু এলাকা বা কমিউনিটি রয়েছে যেখানে আগামী দিনে সংক্রমণ বাড়তে পারে। এই অ্যাপ সেটাই ধরবে। এটি মূলত ‘রিক্স প্রোটেকশন টুল’ যা কতগুলো বিষয়ের উপর কাজ করবে। এই অ্যাপকে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।
কী কী ফ্যাক্টরের ওপর কাজ করবে এই অ্যালগোরিদম? প্রথমত, সোশিও-ডেমোগ্রাফিক ফ্যাক্টর যা বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা সেটা নির্ণয় করবে। পাশাপাশি সেই ব্যক্তি কোনও এলাকায় রয়েছেন, তার চারপাশে কতজন কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই কমিউনিটিতে সংক্রমণের ঝুঁকি কতটা এইসবও বলে দিতে পারবে এই অ্যাপ।
দ্বিতীয়ত, বিহেভেরিয়াল ফ্যাক্টর, যেমন ওবেসিটি, ধূমপানে আসক্তি, শরীরে কী কী ক্রনিক রোগ রয়েছে, সংক্রমণজনিত রোগের ইতিহাস আছে কিনা ইত্যাদি বিচার করে এই অ্যাপ বলে দিতে পারবে কোভিড রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত কিনা। এই অ্যাপ হল ‘মর্টালিটি রিস্ক ক্যালকুলেটার’ যা করোনার রিইনফেকশনের সম্ভাবনাও সঠিকভাবে বলতে পারবে। শুধু ব্যক্তিবিশেষে নয় তাঁর সংস্পর্শে থাকা লোকজনেরও সংক্রমণ বা পুণঃসংক্রমণের ঝুঁকি কতটা সেটাও বলে দিতে পারবে এই অ্যাপ।
তৃতীয়ত, প্রিডিসপোজিং কন্ডিশন দেখে সংক্রমণের ঝুঁকি বলে দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে অ্যাজমা বা হাঁপানি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ইত্যাদি রিস্ক ফ্যাক্টর নির্ধারণ করা হবে।
গোষ্ঠী সংক্রমণের পূর্বাভাস দিতে পারবে এই অ্যাপ। কোন সময় সংক্রমণ বাডতে পারে, মৃত্যুর ঝুঁকি কার শরীরে কতটা সেটাও সঠিকভাবে ধরে দিতে পারবে এই অ্যাপ।
কলকাতায় জন্ম নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের। বালিগঞ্জ গর্ভনমেন্ট হাইস্কুল থেকে পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা। স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক করেছেন। এরপর গবেষণা ওয়াশিংটন ইউিনিভার্সিটিতে। বায়োস্ট্যাটিস্টিকসের নানা বিষয়ের উপর গবেষণা করেছেন নীলাঞ্জনবাবু। কোয়ান্টিটেটিভ জেনেটিক্স, ক্যানসার রিসার্চ, স্ট্যাটিস্টিকাল মেথডোলজি, জিনোমিক্স, জিন-এনভায়রনমেন্ট রিঅ্যাকশন ইত্যাদিতে রিসার্চ পেপার রয়েছে তাঁর। বলেছেন, আমেরিকার বিভিন্ন কমিউনিটিতে সংক্রমণের গ্রাফ বের করে ফেলেছে এই অ্যাপ। ভ্যাকসিনের প্রয়োজন কোথায় কতটা সেটাও নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারছে এই কম্পিউটার অ্যালগোরিদম।