টিকা কীভাবে নিতে হবে, কতদিনে তৈরি হবে অ্যান্টিবডি, কারা পাবেন, বিস্তারিত বললেন এইমস প্রধান

ভারতে বৃহত্তর টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হতে চলেছে আর কিছুদিনের মধ্যেই। প্রাথমিকভাবে সমস্ত রাজ্যের কয়েকটি জেলা বেছে টিকার মহড়া বা ড্রাই-রান হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কো-উইন অ্যাপের ভ্যাকসিন মডিউল ও রেজিস্ট্রেশন মডিউলেও নজর রেখে চলেছেন সকলে। স্বাভাবিকভাবে আমজনতার মনে টিকাকরণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কারা আগে টিকার ইঞ্জেকশন পাবেন?  কীভাবে টিকা নিতে হবে ? টিকার ডোজ নেওয়ার কতদিনের মাথায় ভাইরাস প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি হবে?  কোনওরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে কী করতে হবে? সাধারণ মানুষের এইসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস)-এর প্রধান রণদীপ গুলেরিয়া।

কীভাবে হবে টিকাকরণ?

এইমস প্রধান বলছেন, টিকার অগ্রাধিকার যাঁরা পাবেন তাণদের মোবাইলে এসএমএস আসবে। সেখানে টিকা নেওয়ার সময় ও জায়গা বলা থাকবে। নির্ধারিত দিনে টিকাকরণ শিবিরে পৌঁছে যেতে হবে। মুখে মাস্ক থাকা বাধ্যতামূলক। লাইনে দাঁড়াতে হলে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মানতে হবে। টিকার ড্রাই-রানে স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে এইসব মহড় আগেই হয়েছে। তাই টিকাকরণ যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে দিকে নজর রাখবেন স্বাস্থ্যকর্তারা। টিকার ইঞ্জেকশন দেওয়ার আগে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। যাঁরা টিকা পাবেন তাঁদের নাম সরকারি খাতায় রেকর্ড করা থাকবে। একে একে টিকার ইঞ্জেকশন নেওয়ার জন্য ভেতরে ঢোকানো হবে। ইন্টারমাস্কুলার বা পেশির নিচে টিকার ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। ডোজ দেওয়ার পরে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করানো হবে। তার জন্য অবজারভেশন রুম থাকবে। এই আধঘণ্টার মধ্যে কোনওরকম শারীরিক অস্বস্তি শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গেই তা জানাতে হবে। যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন স্বাস্থ্যকর্মী, আশা কর্মীরা।

কতদিন অন্তর নিতে হবে টিকার ডোজ? কবে তৈরি হবে অ্যান্টিবডি?

টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার ২৮ দিনের মাথায় দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। ২৮ দিন অন্তর দুটি ডোজ সম্পূর্ণ হওয়ার দু’সপ্তাহ অর্থাৎ ১৪ দিন পর থেকে রক্তরসে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করবে। গুলেরিয়া বলেছেন, টিকা যাঁরা নেবেন, তাঁদের দুটি ডোজই নিতে হবে নিয়ম মেনে। একটি ডোজ নেওয়ার পরে দ্বিতীয় ডোজ না নিলে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে না। আর মাঝের ২৮ দিন সাবধানে থাকতে হবে। এই সময়ের মধ্যে অধিক মেলামেশা করা বা করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।

সাধারণত, টিকা শরীরে ঢুকে কাজ করতে কিছুটা সময় লাগে। প্রথম ডোজ দেওয়া মানে টিকা দেহকোষে ঢুকে ভাইরাল প্রোটিনের নকল করে ইমিউন সেল বা বি-কোষ ও টি-কোষকে সক্রিয় করার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয় ডোজ শরীরে ঢোকা মানে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হওয়া। তখন মেমরি বি-কোষ তৈরি হবে। রক্তরসে বি-কোষ বিভাজিত হয়ে অ্যান্ডিবডি তৈরি করতে থাকবে।

একটি টিকার সম্পূর্ণ ডোজ নিতে হবে

এইমস প্রধান বলছেন, মাঝপথে টিকার ডোজ বদল করলে চলবে না। ধরা যাক, কেউ সেরামের কোভিশিল্ড টিকা নিচ্ছেন, তাহলে তাঁকে সেই টিকারই দুটি ডোজ নিতে হবে। প্রথম ডোজ কোভিশিল্ডের, দ্বিতীয় ডোজ অন্য কোনও টিকার, এমন করলে কোনও কাজই হবে না। প্রতিটি টিকার নিজস্ব গুণাগুন আছে। শরীরে ঢুকে সেইমতোই কাজ করবে। টিকার ডোজ অদলবদল করলে হিতে বিপরীত হবে পারে। তাই যে টিকার ডোজ নেওয়া শুরু করবেন, সেটাই শেষ করতে হবে। দুটি ডোজ সম্পূর্ণ হলে এসএমএস মারফৎ কিউ-আর কোড যুক্ত সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হবে মোবাইল নম্বরে।

কো-মবির্ডিটির রোগীদের টিকা নেওয়া জরুরি

ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্রনিক লিভার বা কিডনির রোগ, ফুসফুসের রোগ থাকলে টিকা নেওয়া একান্ত জরুরি। এমনটাই বলছেন, এইমস প্রধান গুলেরিয়া। ভারতে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষেরই কো-মর্বিডিটি আছে। আর ক্রনিক রোগ থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তখন সংক্রমণজনিত জটিল রোগ ধরে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। গুলেরিয়া বলছেন, প্রথমে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পাবেন। এর পরে প্রবীণ ও কো-মর্বিডিটির রোগীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। ৫০ বছরের কমে যাদের কো-মর্বিডিটি আছে তাঁরাও থাকবেন টিকার অগ্রাধিকারের তালিকায়। তবে করোনা রোগীদের এখনই টিকার ডোজ দেওয়া হবে না। কারণ শরীরে সংক্রমণ থাকলে টিকার প্রভাব কতটা হবে বা কী পরিমাণ টিকার ডোজ দিতে হবে, সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে সংক্রমণ সারিয়ে উঠেছেন এমন ব্যক্তিরা টিকা নিতেই পারেন। এতে শরীরে ভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির সংখ্যা আরও বাড়বে।

টিকার জন্য নাম নথিভুক্ত করতে হবে

কেন্দ্রীয় সরকার আগেই জানিয়েছে ৩০ কোটিকে প্রথম দেওয়া হবে টিকা। যার মধ্যে প্রথমে থাকবেন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারি পড়ুয়ারা। এর পরে টিকা পাবেন পুলিশ, প্রশাসন, মিউনিসিপ্যালিটির কর্মীরা। তৃতীয় ক্যাটেগরিতে রাখা রয়েছে ২৬ কোটি মানুষকে, যাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি। চতুর্থ ক্যাটেগরিতে থাকবে কোমবির্ডিটির রোগীরা এবং ৫০ বছরের কমবয়সী যাদের ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের মতো রোগ রয়েছে, তাঁরাও থাকবেন হাই-রিস্ক গ্রুপে।

টিকার অগ্রাধিকার যাঁরা পাবেন তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে হলে আইডি প্রুফ আগে দিতে হবে। নিজের পাসপোর্ট সাইজের ফটো, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট জব কার্ড, প্যান কার্ড, পাসবুক (ব্যাঙ্ক/পোস্ট অফিস), পাসপোর্ট, পেনশন ডকুমেন্ট, যেখানে চাকরি করেন সেখানেকার আইডি কার্ড, ভোটার কার্ড ইত্যাদি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। টিকা নেওয়ার আগে তাদের মোবাইলে এসএমএস আসবে। সেখানে টিকা নেওয়ার দিন ও জায়গা বলা থাকবে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে কী করতে হবে?

টিকা নেওয়ার পরে কোনওরকম শারীরিক অস্বস্তি বা সামান্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও কাছাকাছি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী, আশাকর্মী বা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, টিকা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য রাখতে ‘অ্যাডভার্স ইভেন্টস ফলোয়িং ইমিউনাইজেশন’ (এইএফআই) প্রোগ্রাম শুরু করা হচ্ছে দেশজুড়েই। জেলায় জেলায় এইএফআই ম্যানেজমেন্ট সেন্টার খোলার জন্য রাজ্যগুলিকে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। টিকার ড্রাই-রানে এই বিষয়ে প্রস্তুতিও নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। টিকাকরণ যে শিবিরে হবে তার কাছাকাছিই ইমিউনাইজেশন সেন্টার থাকবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি হেলথ সেন্টার বা জেলা হাসপাতালগুলিতে এই সেন্টার খোলা হতে পারে। টিকা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোনও অ্যাডভার্স সাইঢ এফেক্টস দেখা গেলে এই সেন্টারে যোগাযোগ করা যাবে। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, অভিজ্ঞ ডাক্তাররা থাকবেন এই ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে। টিকা নেওয়ার পরে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং তা সারানোর জন্য কী করণীয়, সে সব ট্রেনিং দেওয়া থাকবে স্বাস্থ্যকর্মীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.