চিত্ততলে যে নাগবালা ছড়িয়ে ছিঁড়ে কেশের কেশর কাঁদছে—–
অফুরন্ত অশ্রুধারা সহস্রবার নাসার বেশর বাঁধছে ;
মানিক-হারা পাগল-পারা যে বেদনা বাজছে তাহার বক্ষে,
পলে-পলে পলক বেয়ে অলক ছেয়ে ঝরছে যাহা চক্ষে ;
দুঃখে-ভাঙা বক্ষে যাহা নিশ্বসিয়া সকাল-সাঁঝে টুটছে—-
মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে !
শোনা যায়, নাগলিঙ্গম গাছে যখন ফুল ফোটে তখন ফুল হতে অদ্ভুত মাদকতাময় গন্ধ বের হয়। সেই গন্ধে নাগিনীর গায়ের ন্যায় কাম গন্ধ খুঁজে পায় নাগ। কামের নেশায় মত্ত হয়ে তখন নাগ ফনা তোলা নাগিনীর মতো দেখতে ফুলের কাছে ছুটে আসে। তাই এই গাছের নাম নাগলিঙ্গম। উপমহাদেশে কালক্রমে এই নামটিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে।
তিন হাজার বছর আগে থেকেই গাছটি ভারত উপমহাদেশে একটি পবিত্র উদ্ভিদ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। শিব ও সর্প পূজায় নাগলিঙ্গম ফুল ব্যবহার করেন। ভারতে নাগলিঙ্গমকে ‘শিব কামান’ নামে ডাকা হয়।
বৌদ্ধদের মন্দিরেও এই ফুলের যথেষ্ট কদর রয়েছে। এ কারণে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারের বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গণে নাগলিঙ্গম গাছ বেশি দেখা যায়।
বিলুপ্ত প্রায় নাগলিঙ্গম গাছের ফুলগুলি অদ্ভুত সুন্দর। ফুলের পরাগচক্র দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। হয়তো এ’ কারণেই এ ফুলের নাম নাগলিঙ্গম। কথিত আছে নাগলিঙ্গম গাছের ফুল ও ফল একান্তই নাগ-নাগিনীর সম্পদ। যেহেতু ফল হুবহু কামানের গোলার মতো হওয়ায় এ গাছ ইংরেজদের কাছে Cannonball Tree নামে পরিচিত। Cannonball অর্থাৎ কামানের গোলা!
ভেষজ গুণসম্পন্ন নাগলিঙ্গম গাছের ফুল,পাতা ও বাকলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ হয়।
দ্রুত বর্ধনশীল নাগলিঙ্গম গাছে চারা রোপণের ১২ থেকে ১৪ বছর পর গাছে ফুল ধরে। গ্রীষ্মকাল এবং বর্ষাকালে ফুল ফোটে। গাছের কাণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে আসে প্রায় ৭ ইঞ্চি দীর্ঘ অসংখ্য মঞ্জুরি। এক একটি মঞ্জরিতে ১০ থেকে ২০টি ফুল ক্রমান্বয়ে ফুটতে থাকে। মঞ্জরির একদিকে নতুন ফুল ফোটে অন্যদিকে পুরাতন ফুল ঝরে পড়ে। ফুলে ৬টি মাংশল পুরু পাপড়ী থাকে। ফুলের মাঝে থাকে নাগের ফনা আকৃতির পরাগচক্র।
বসন্তের শেষ থেকে অনেক দিন ধরে ফুটে থাকে -প্রায় শরৎকাল অবদি। ফুলগুলো কমলা, উজ্জ্বল লাল বা গোলাপি বর্ণের এবং তিন মিটার দীর্ঘ মঞ্জুরিতে ফুটে থাকে। ফুলের এই বিচিত্র গড়ন আমাদের দেশে বিরল। ফুলগুলো ঊর্ধ্বমুখী স্থুল ডিস্কের সাথে যুক্ত থাকে। তীব্র সুগন্ধযুক্ত, দীর্ঘ ছয়টি পাপড়ি বিদ্যমান। এ ফুল আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এর পরাগায়ণও বাতিক্রমধর্মী। মূলতো মৌমাছি পরাগায়ণে বাহক হিসেবে কাজ করে।
ফল গোলাকার। Cannon অর্থাৎ কামানের গোলার মত দেখতে। ২০ সে.মি ব্যাসযুক্ত। প্রতি গাছে ৫০-১৫০ টি করে ফল থাকে । একটি ফলের ভেতর ৬৫-৫৫০টি পর্যন্ত বীজ থাকতে পারে। ফল পরিপক্ক হতে প্রায় এক বছর সময় নেয়। কখনোবা ১৮ মাস! পরিপক্ক ফল মাটিতে পড়লে ফেটে যায়। বাতাসে খানিকটা ঝাঁঝালো গন্ধ সৃষ্টি হয়। বীজগুলোতে চুলের মত আস্তরণ থাকে যা এদেরকে প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করে। ফলগুলো প্রচণ্ড শক্ত ও আকারে বেশ বড় হওয়ায় নাগকেশর গাছ রাস্তার পাশে রোপণ করা হয় না, কেননা এর পরিপক্ক ভারী ফল যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
ফল মূলত পশু পাখির খাবার। আমাদের জন্য এ’ফল অখাদ্য, এমনকি ক্ষতির কারণও হতে পারে। যদিও আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর কাছে এটি একটি প্রিয় খাবার! কেননা পুরুষত্ব বৃদ্ধিতে নাকি এ’ফল বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে!!! উদ্ভিদটির অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। ফলের শক্ত খোলস অলংকার হিসেবে ও বিভিন্ন দ্রব্য বহনে ব্যবহার করা হয়। এর ফুল, পাতা এবং বাকলের নির্যাস ঔষধ হিসেবে বহুল প্রচলিত। এটি Antibacterial, Anti-fungal, Antiseptic এবং Analgesic হিসেবে কাজ করে। পেটের পীড়া দূরীকরণে । বিশেষ করে হাতির পেটে পিঁড়ায় এটি বেশ কার্যকর। পাতা থেকে উৎপন্ন জুস ত্বকের সমস্যা দূরীকরণে খুবই কার্যকর। প্রসূতি মাকে কচি ফুলের রস খাওয়ালে সন্তান প্রসব সহজতর হয়। এর পাতা ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে থাকে।
রূপে গুনে ভরপুর এই উদ্ভিদের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে খুবই কম। সমস্ত পৃথিবীতে এই উদ্ভিদটি বিলুপ্তির পথে। তবে সুখের সংবাদ আপনি চাইলে নার্সারি থেকে ক্রয় করে নিজ বাগানের শোভা বাড়াতে পারেন চাইলেই! হয়ত হিন্দু ধর্মের একটা গাছকে বিলুপ্তির পথ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। অথবা কোনো বিলুপ্ত ঐতিহাসিক গাছকে বাঁচাতে পারবেন।
মন-পাতালে যে নাগবালা রতন-জ্বালা কক্ষে ব’সে হাসছে—-
দীপ্তি যাহার নেত্রপথে শুভ্র-শুচি দৃষ্টি হয়ে আসছে ;
মুক্তামানিক সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে উল্লাসে যে চঞ্চল,
উদ্বেলিত সিন্ধুসম দুলছে যাহার উচ্ছৃসিত অঞ্চল ;
বিশ্বভুবন পূর্ণ ক’রে যে আনন্দ শঙ্খস্বরে উঠছে—–
মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে |
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃকবিতা : যতীন্দ্রনাথ বাগচী
দ্বিজেন শর্মা লেখক; বাংলা একাডেমী ; ফুলগুলি যেন কথা