আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আদ্যন্ত একটি কমিউনিস্ট পরিবারে। ফলত, কৈশোর থেকেই এক ধরনের নাস্তিকতা আমাকে গ্রাস করেছিল। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই নাস্তিকতা অনেকটাই দূর হয়েছে বটে, তবে পুরোপুরি আস্তিকও যে হতে পেরেছি, তা আমি মনে করিনা এখনও। এখনও অনেক ধর্মীয় আচারে আমি বিশ্বাসী নই; বরং অনেক মানসিক শান্তি লাভ করি উপনিষদ পাঠে। তো, এই কমিউনিস্ট পরিবারের সন্তান হয়ে শেষ পর্যন্ত উপনিষদে নিজেকে সমর্পণ করা- এই যাত্রাপথটুকুতে এক অত্যাশ্চর্য আলোকের সন্ধান আমি পেয়েছি।
সে বেশ দু দশক আগের কথা। এক বিকেলে হাজরা মোড়ের এক বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে নানাবিধ বই উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। দু-এক পাতা পড়ছিলাম। এই বইয়ের দোকানটি আমার দীর্ঘদিনের চেনা। ফলে ইচ্ছেমতো বই উল্টে দেখা এবং দু-এক পাতা পড়ে ফেলার সহাস্য অনুমতি আমাকে বরাবরই দিয়ে থাকে। যাই হোক, এরকম নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতেই একটি বই আমার হাতে চলে আসে। কিছুটা নিস্পৃহভাবেই আমি বইটি পড়া শুরু করি। গোটা চার পাঁচ পাতা পড়ার পর আমি কৌতুহলী হই। যেমন, আমার মনে হতে থাকে- এই বইটির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা আমাকে এত সহজ ভাষায় এতদিন কেউ বলেনি। বইটি কিনে ফেলতে আমি দ্বিধা করিনা এবং বাড়ি ফিরে এসেই ওইদিন রাত থেকেই আমি সোৎসাহে বইটি পড়তে শুরু করি। যতই পড়ি বইটি, যতই তার গভীরে যাই; বুঝতে পারি বিশ্বের সর্বপ্রাচীন এবং সর্বজনীন এক দর্শণ অতি সাধারনের বোধগম্য এক ভাষায় এই বইটিতে বিবৃত হয়েছে। এখানে জ্ঞানীর অহংকার নেই, যা আছে তা হল এক প্রেমময় পুরুষের অপার করুনাবর্ষণ। বইটির নাম ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। এই বইটি যখন আমি শেষ করি, তখন আমার সব অহংকার তিনি হরণ করে নিয়েছেন। সব হারিয়ে নিঃশ্ব, রিক্ত আমি তখন তাঁর শরণাগত। সেইদিন থেকেই তিনি আমার ঠাকুর, আমার রামকৃষ্ণ।
আমার জীবনে এর পরের পর্যায় রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নেওয়া। বলতে দ্বিধা নেই, কমিউনিস্ট পরিবারের নাস্তিক সন্তান ততদিনে ক্রমে আস্তিক হয়ে উঠেছে। তবে রামকৃষ্ণ মিশনেও আমার দীক্ষা নেওয়া কোনও গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নয়। শুধুমাত্র রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা এবং স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত এবং স্মৃতিধন্য এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে রাখার তাগিদেই। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে আমার মতের পার্থক্য হয়েছে, বিরোধেও দাঁড়িয়েছি হয়তো-তবে তা মিশন কর্তৃপক্ষের কোনও কোনও আচরনের প্রতিবাদে। তবু রামকৃষ্ণ দেব, মা সারদা এবং স্বামী বিবেকানন্দের পদতলে আমি আভূমি প্রণতই থেকেছি। তাঁরা আমার মনিব, আমি তাঁদের পোষা সারমেয়টার মতো। কোনও শক্তি নেই যা এই ত্রয়ীর পদতল থেকে আমায় সরিয়ে নিতে পারে।
আমার ঠাকুর, আমার রামকৃষ্ণকে আমি পুজো করি আমার মতো করে। দীক্ষা নিয়েছি বটে কিন্তু ত্রিসন্ধ্যাজপ করতে পারি না। বহু পাপীতাপীকে তিনি উতরে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস আছে, আমার মতো নিতান্ত ব্রাত্যজনকেও তিনি উতরেই দেবেন। মঠ-মিশনের সভায় অনেকে দেখি ঠাকুরকে নিয়ে কত গবেষণালব্ধ ভাষণ দেন। ঠাকুরের কত বই লেখেন তাঁরা। আমি ঠাকুরের সেসব বিশিষ্ট ভক্তদের দলে পড়ি না। ঠাকুর এক সমুদ্রের মতো। সমুদ্রকে কী ডিঙানো যায়? আমি তাই সেই বৃথা চেষ্টা না করে সমুদ্রেই অবগাহন করি। পাড়ে বসে দেখি সমুদ্রের ঢেউয়ের ওঠাপড়া। আমার ঠাকুরকে আমি আমার হৃদয়ের মণিকোঠাটিতে রাখি। তাঁকে হাটের মাঝে বেচতে যাইনি কখনও।
‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ আমার জীবনে এক আশ্চর্য জাদুদণ্ড। যে জাদুদণ্ডের স্পর্শে কমিউনিস্ট পরিবারের এক নাস্তিক অহংকারী সন্তানও একদিন পরিবর্তিত হয়েছিল এক রামকৃষ্ণ সন্তানে। এখানে আর একটি কথা না বললে অপরাধ হবে। ঠাকুরকে না হয় মাথায় করে রাখি; কিন্তু আমাকে আগলে রাখার মতো একজন মা আছেন। আমি ধুলোকাদা মেখে ফিরে এলেও তিনি আমায় কাছে টেনে নেন। এখানেই আমার বড় ভরসা। সেই স্বামীজির কথায়- ‘পরমহংস যায় যান, আমি তাতে ভীত নই, আমার একজন মাতা ঠাকুরানি আছেন।’
আমি মন্ত্রতন্ত্র জানি না। জপতপের ধারও ধারিনি কোনওদিন। শুধু এটুকু জানি, অনেক আঘাতে জর্জরিত হয়ে, নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে আমি যখন আমার গৃহে প্রত্যাবর্তন করি, তখন আমার সেই একলা চলার পথে একজন এসে আমার হাত ধরেন। আমার তখন আর কোনও ভয় করেনা। তিনি আমার ঠাকুর। আমার রামকৃষ্ণ।