আজকের ভোটে নজর নিবদ্ধ তারকা রাজনীতিকদের দিকে। কংগ্রেসের ম্যাচো অ্যাংরিম্যান অধীর চৌধুরীর বহরমপুর, আবার প্রার্থী না হয়েও কাঁচা ঘুম থেকে উঠে আসা কু-কথার কুম্ভকর্ণ স্বরুপ অনুব্রত মণ্ডল।
শেষ পর্যন্ত সব বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করছে নির্বাচন কমিশন। শুধু বিজেপি বা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, ভোটকর্মীদেরও প্রথম থেকেই দাবি ছিল সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাই।
বীরভূমে মমতার ভরসা বীর কেষ্টকেও নজরবন্দি রাখার দাবি উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত সে দাবিও মেনেছে কমিশন।
মানুষ ভরসা পেলে এবার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯-এর পুনরাবৃত্তি হবে, এমনটাই সিংহভাগ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ১৯টা আসন পেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা আসছে।
এবার সেই একই ছবি দেখতে পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা, শুধু তৃণমূলের জায়গায় যে দলটি রাজ্যে তাদের আগমন বার্তা ঘোষণা করতে পারে, সেটির বদল ঘটেছে। সেদিন ছিল তৃণমূল আর এবার বিজেপি।
পঞ্চায়েতে মানুষকে ভোট দিতে না দেওয়ার পরিণাম যে কি সাংঘাতিক হয়েছে, তা পারিষদ পরিবেষ্টিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টের পাচ্ছেন কি না, তা নিশ্চিত ভাবে জানা না গেলেও, অনুমান করা যায়, এই রাজ্যের মানুষের নাড়ি বোঝা মমতা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
মমতা ইতিমধ্যে একটি জনসভায় বলেও ফেলেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে যাবে, পুলিশ রয়ে যাবে। পুলিশ মানে কোন পুলিশ? যে পুলিশ তৃণমূলের কাছে কেঁচো, বিরোধীদের সামনে কেউটে। যে পুলিশ শাসক দলের নির্দেশে মিথ্যা মামলা সাজাতে সিদ্ধহস্ত।
সেই পুলিশকে সাধারণ মানুষ তো ভয় পাবেই। মমতা সম্ভবত সেই ভয়টাই দেখাতে চাইলেন ভোটারদের। ভাবটা এমন, স্কুলে ইনসপেক্টর আর কতক্ষণ থাকবে? সে যাওয়া মাত্রই মাষ্টার মশাইয়ের টিকিতে টিকটিকি বেঁধে দেবো!
ভয় দেখালেও মানুষ কি শেষ পর্যন্ত ভয় পাবে? ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে, কিংবা ইভিএমের সামনে দাঁড়িয়ে সে কি ভাববে উল্টো ভোট দিলে যদি উল্টো বিপত্তি হয়!
সে কি ভাববে পুলিশের অবান্তর হুজ্জুতি হতে পারে তার ওপর?
মেয়েটা টিউসন থেকে ফেরার সময় নাও ফিরতে পারে আর?
ছেলেটার কলেজের অ্যডমিসন আটকে যাবে নাতো? সে কি ভাববে?
তার কি মনে হবে দিল্লিতে মোদি-রাহুল যে আসুক না কেন এখানে তো দিদিই রয়ে যাবে।
দিদির ভাইয়েরা হাটে বাজারে বেমক্কা অসম্মান করে দেবে নাতো?
নির্বাচন কমিশন হয়তো ভোট কেন্দ্র নিষ্কণ্টক করেছে। ধরে নেওয়া যাক ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথটুকুও কুসুমাস্তীর্ণ। তবু সন্তানকে দুধে ভাতে রাখতে চাওয়া সাধারণ মানুষ তো কালকের কথা ভাববে, পরশুর কথা।
মমতা সেই গুঢ় জায়গাটিতেই মরিয়া চাপ দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিরাপত্তা দেবে দু’দিন বই তো নয়। তারপর? তারপর তাঁর পুলিশ, তাঁর ভাই, তাঁর ভাইপো, তাঁর গুণ্ডা, তাঁর তাঁর তাঁর। এ রাজ্যে সবই তাঁর। তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি অভিভাবক, তিনি নেত্রী, তিনি দিদি, তিনি পিসি, তিনিই বাংলা, তিনিই সব।
তবে এবারের কাহিনীতে থোড়া টুইস্ট আছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন এবারের পরিস্থিতি আলাদা।
মমতার না-ভোট এবার পড়বে বিরোধী বাক্সে। বিজেপি যেহেতু কার্যকরী ভাবে বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে শেষ দু’বছরে, তাই মমতার না-ভোট এবার বিজেপির হ্যাঁ-ভোটে পর্যবসিত হবে বলেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা মানুষের ধারণা।
তাছাড়া মুকুল ফ্যাক্টর এবার প্রবল। তৃণমূলকে ভেতর থেকে খানখান করে দিয়েছেন মুকুল। দলের মধ্যে সিংহ ভাগ নেতা-কর্মী যাঁরা ভাইপোরাজে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, মমতার একচোখা শাসনে ও অপমানে যাঁরা ফুঁসছেন, এতদিন যাঁদের কাছে কোনও বিকল্প ছিল না, আজ তাঁরা বিজেপিকে বিকল্প হিসেবে পেয়েছেন। তাঁরা এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে তৃণমূলের পতাকাতলে থাকলেও, তাঁরা মুখে যা বলছেন মনে তা ভাবছেন কি? এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং মমতার কাছে আছে কিনা সন্দেহ।
মুকুল রায় ইতিমধ্যেই বলেছেন, উনিশের শেষে বিধানসভা নির্বাচন। বলেছেন, নভেম্বরেই বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আসবে। বলেছেন, মমতা আর মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না। বলেছেন, বিজেপির সরকার হবে রাজ্যে।
রত্নাকরের পাপের বোঝা কেউ কোনও দিন নেয় না। হয়তো সেই কারনেই তৃণমূল ছেড়েছেন মুকুল। এবারের ভোটের ফল আন্দাজ করা গেলেও, স্বাভাবিকভাবেই এখনও চোখে দেখা যায়নি। চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তা হল অনিশ্চয়তায় ভোগা হরিশ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিটের মুখচোখ।
যাঁরা মমতার কথায় ভয় পাচ্ছেন, তাঁরা একবার মুকুলের কথায় ভরসা করতে পারেন। তৃণমূলের প্রাণ ভোমরা কোন কৌটোয় লুকোনো, তা মমতা ছাড়া আর যদি কারও জানা থাকে তিনি একমাত্র মুকুল রায়।
দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়