দোসরা মে, ভাটপাড়া ময়দানে নির্বাচনী প্রচারে এসে আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ মাঠ ভরেনি সেভাবে। দুই ‘গদ্দারকে ভােট মিটলে তিনি দেখে নেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসলেন। এই গদ্দার’দের সবাই চেনে, এরা বলাই বাহুল্য মুকুল রায় ও অর্জুন সিংহ। প্রায়শই মমতার থেকে এধরনের হুমকি রাজ্যবাসী এবং তার পুরনাে দলীয় সহকর্মীরা শুনে থাকেন। তবে সেদিন যে তাঁর কণ্ঠে বাড়তি উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তা নিশ্চয়ই নজর এড়ায়নি। আসলে ২৯ এপ্রিল এই মাঠেই জনসভা করে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মােদী। সভায় প্রবল গরম উপেক্ষা করে এমন ভিড় হয়েছিল যে তিল ধারণের স্থান ছিল না।
এবারের ভােটে মমতা একটা স্ট্র্যাটেজি নিয়েছেন, যে স্ট্র্যাটেজি তিনি বিগত বেশ কিছুদিনই অনুসরণ করছেন, সেটি হলাে মােদী বা অমিত শাহ বাঙ্গলায় যেখানেই সভা করুন না কেন তার পালটা কর্মসূচি সেখানে মমতা বা তার ভক্তেরা নেন। উদ্দেশ্য ধমক চমক দিয়ে এলাকাবাসীকে সন্ত্রস্ত করে রাখা, যাতে মােদী প্রভাব তাদের ওপর না পড়ে। এই স্ট্রাটেজি এবার গােড়া থেকেই বেসুরাে বাজছে। ব্যারাকপুর লােকসভা কেন্দ্রে যেমন। মােদীর সভায় তিল ধারণের জায়গা না থাকলেও, মমতার জনসভা বেশ ফাঁকা ফাকা দেখিয়েছে। তার মানে ধমক-চমক আর সেভাবে কাজ করছে না। তার মানেই তাে মােদী জাদু শুরু হয়ে গিয়েছে ঠিক গতবারের মতাে। এর মানে আবার মােদী ঝড়ের পূর্বাভাস।
মােদীর ঝড় যে উঠবে তা টের পাওয়া গিয়েছিল গত ৩ এপ্রিলই, শিলিগুড়ি আর কলকাতার ব্রিগেডে তার জোড়া সভার মধ্যে দিয়ে। ১৯ জানুয়ারি দুনিয়ার ধান্দাবাজ এক হও’ স্লোগান দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মােদী বিরােধী রাজনীতিকদের ব্রিগেডে একজোট করে নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। বিজেপি এরপর নরেন্দ্র মােদীকে এনে ব্রিগেডে সভা করার আয়ােজন করতে যায়। কিন্তু স্বল্প সময়, তার আগে রথ নিয়ে জটিলতা ইত্যাদি কারণে ব্রিগেডে সেই সভার আয়ােজন করা যায়নি। মমতার ধামাধরা সংবাদমাধ্যম রটিয়ে দেয় ব্রিগেডে মােদীর সভায় লােক জড়াে করা যাবে না বুঝেই নাকি কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব ওখানে সভা আয়ােজনে নিষেধ করে। যদিও আদর্শ নির্বাচন বিধি বলবৎ হওয়ার দৌলতে মমতার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কমতেই একই দিনে অর্থাৎ ৩ এপ্রিল শিলিগুড়ি ও ব্রিগেডে মােদীর জোড়া সভা আয়ােজনের সুযােগ পায় বিজেপি।
ব্রিগেডের সভায় লাগানাে হয়েছিল বড়াে বড়াে পাঁচটি ‘হ্যাঙার’, মূলত রােদের হাত থেকে কর্মী-সমর্থকদের বাঁচাতেই। সােশ্যাল মিডিয়া, আর মিডিয়া দু’ জায়গাতেই রসিকতার বান ডাকল, কেউ বলল সভায় লােক হবে না তা আড়াল করতেই হ্যাঙার লাগানাে হয়েছে। আবার কারাের বক্তব্য, মূলত সমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণাতে, কালােটাকা খরচ করে টাঙানাে হয়েছে হ্যাঙার। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল মােদীর ব্রিগেড ও শিলিগুড়ি— একইদিনে দু’দুটো জনসভায় ভিড় উপচে পড়েছিল। ব্রিগেডে জনগণের মাথায় রােদ না লাগার ব্যবস্থা থাকলেও, ভিড়ের চাপে ওই সামান্য পাঁচটা হ্যাঙারে কোনও কাজ হয়নি। হ্যাঙার উপচে ভিড় ব্রিগেড ভরিয়ে দিয়েছিল।
মােদীর নেতৃত্বে গেরুয়া ঝড় উঠেছিল ঠিক পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে লােকসভা নির্বাচনের সময়। পাঁচটা বছর পেরিয়েও ঝড়ের প্রাবল্য কোনও অংশে কমছেনা। এ রাজ্যে তাে বটেই। এখান মােদী ঝড়, ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য বিরােধীরা। একদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ যেমন তৃণমূলের সন্ত্রাস দেখেছে, অন্যদিকে যাদবপুরে মাওবাদী মার্কসবাদী তাণ্ডব, খাড়ড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ড, রাজ্যজুড়ে মৌলবাদী তাণ্ডব, হিন্দুদের ধর্মাচরণে বাধা, কংগ্রেসের দেশদ্রোহিতা গত পাঁচ বছরে মােদী-বিরােধিতার চরিত্র বাঙ্গলা হাড়ে হাড়ে চিনে নিয়েছে। তাই ব্রিগেডে মােদীজী তার প্রথম জনসভাতেই বলে দিয়েছিলেনমােদী বিরােধিতা করতে গিয়ে বিরােধীরা বিষয়টি দেশ বিরােধিতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। বাঙ্গলার মানুষকে দেশভক্তি ভুলিয়ে দিতে, ভারতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করতে বামপন্থী-তৃণমূলি বুদ্ধিজীবীরা যতই সচেষ্ট হন না কেন, মােদী ঝড়ের তীব্রতা যেন তাতে আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
চতুর্থ দফার নির্বাচন অবধি মােদী সারা দেশে ৮৭টি নির্বাচনী জনসভা করেছেন, তিনটি বড়াে রােড শােও করেছেন একমাসের সামান্য বেশি সময় ধরে। তার নির্বাচনী জনসভার অধিকাংশটাই মূলত পাঁচটি রাজ্যকে কেন্দ্র করে, রাজ্যগুলি হলাে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ও গুজরাট। এরমধ্যে বাঙ্গলা ও ওড়িশা বাদে বাকি তিনটি রাজ্যেই বিজেপি সরকার এবং এই রাজ্যগুলি থেকে এবারের লােকসভাতেও বিজেপি খুব ভালাে ফলেরই আশা করছে, অন্তত মায়া-অখিলেশের ধান্দাসর্বস্ব জোট এক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধক হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বাকি থাকল ওড়িশা ও বাঙ্গলা। ওড়িশায় বিজেপির সাংগঠনিক ভিত্তি খুব ভালাে, তার ওপর নবীন পট্টনায়কের রাজনৈতিক অবস্থা এই মুহূর্তে মােটেও সুবিধের নয়। ফলে এই রাজ্যেও এবার ভালাে ফল করছে বিজেপি।
পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় নির্বাচন। চতুর্থ দফা অবধি মােদীজী যেভাবে ঘন ঘন প্রচারে এসে মাত করেছেন, তাতে মমতা আর মমতাপন্থী মিডিয়া অস্বস্তি বােধ করেছে, রসিকতার ঢঙে বলা হচ্ছে ‘মােদী ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। খােদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চতুর্থ দফার শেষে মােদীর প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন : ‘অন্ধ্রপ্রদেশ আসন পাবে না, ওড়িশায় আসন পাবে না, পঞ্জাবে পাবে না, রাজস্থানে আসন কমবে, উত্তরপ্রদেশে আসন কমবে, গুজরাটে আসন কমবে। আগে এগুলাে সামলাও, তারপর বাঙ্গলার দিকে তাকাতে আসবে। মমতার কথাতেই স্পষ্ট যে মােদীর জনসভা তাকে ভীত, সন্ত্রস্ত করছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল যে রাজ্যের প্রকৃত নির্বাচনী ছবি নয়, তা একটা বাচ্চাও বােঝে। তাই মমতা খুব ভালােভাবেই জানেন ২০১৯-এ ‘মােদী ফিনিশ’ স্লোগানকে বাস্তবায়িত না করতে পারলে, ২০২১-এ তিনি নিজেই ‘ফিনিশ’ হয়ে যাবেন। তাই মােদীর জনসভায় ভিড় তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটালে আশ্চর্যের কিছু নেই।
শিলিগুড়ি, কলকাতার ব্রিগেড, ব্যারাকপুর ছাড়াও বােলপুরের ইলামবাজার, শ্রীরামপুর, ঠাকুরনগর, মােদীর একের পর এক জনসভায় ভিড়ের বহর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎকণ্ঠিত করেছে, এতটাই যে ১ মে হাওড়ায় একটি জনসভায় তিনি অভিযােগই করে বসেন যে বিজেপি নাকি এক একটি জনসভার পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এজেন্সি ভাড়া করে ফ্ল্যাগ-ব্যানার দিয়ে লােক পাঠিয়ে মাঠ ভরছে। এরপরই তিনি অভিযােগ করেন এতে গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে। সেদিন তৃণমূলের যে কর্মী সমর্থকরা ময়দান ভরিয়েছিলেন নেত্রীর এই কথা শুনে হাসি চাপতে পারেননি তারাও। কারণ সবারই মনে আছে মমতা প্রশাসনের বিজেপির রথযাত্রা রােখার কী ঐকান্তিক উদ্যম। সেই গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা কেবলমাত্র বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। দীর্ঘদিন এরাজ্যে হিন্দুদের অবদমিত করে রাখার প্রতিবাদও ওই সেই কর্মসূচির অন্যতম অঙ্গ ছিল। ‘সাম্প্রদায়িক হিংসা’ রােখার অজুহাতে বিজেপির যাত্রা কর্মসূচি বাতিল, যার জন্য মােদী-অমিত শাহকে এরাজ্যে আসতে না দেওয়া রাজ্যের সাধারণ হিন্দুদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। যার প্রতিফলন একদিকে যেমন এরাজ্যে মােদী, অমিত শাহ, যােগী আদিত্যনাথদের সভায় উপচে পড়া ভিড়ে পড়ছে, অন্যদিকে মমতা আর তার শাকরেদদের সভা শুরু হচ্ছে ফঁকা মাঠে। মমতা নিজে পর্যন্ত শিলিগুড়িতে কার্যত ফাঁকা জায়গায় তার সভা শুরু করতে বাধ্য হন। বিজেপির সভায় যাঁরা মাঠ দিতেন (যেখানে সভার জন্য সরকারি মাঠ পাওয়া যেত না), কিংবা বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যে কর্ম-সমর্থকদের বাড়ি সহভােজনে যেতেন তাদের ভিটেতে ঘুঘু চরানাের বন্দোবস্ত তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী করতাে। ফলে নাকে খত দিয়ে তৃণমূলে প্রকাশ্যে যােগদান না করে নিস্তার ছিল না।
রাজ্যের এই ‘হাড় হিম করা সন্ত্রাসের প্রতিকল্পে মােদী-অমিত শাহের জনসভাগুলি তাদের কাছে শ্বাসবায়ু নেওয়ার মঞ্চ তাে বটেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গের সন্ত্রাস-পরিস্থিতি, রােহিঙ্গা-বাংলাদেশি পরিস্থিতি নিয়ে ঘােরতর উদ্বিগ্ন। এমনকী নরেন্দ্র মােদী বারাণসীতে তার মনােনয়ন জমা দিয়ে এরাজ্যে প্রতিনিয়িত বিজেপি কর্মীদের ওপর লাগাতার আক্রমণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। রাজ্য জুড়ে আর্থিক প্রতারণা, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট রাজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মােদী, অমিত শাহ।
তাই তৃণমূলের চোখ রাঙানি আপাতত আর কার্যকরী হচ্ছে না, যে কারণে নরেন্দ্র মােদীর জনসভা ভিড়ে উপচে পড়ছে। তৃণমূল সুপ্রিমাের রক্তচাপ বাড়ছে। ঝড়ের স্থায়িত্ব ও ভয়াবহতা পাঁচ বছর ধরে অপ্রতিহত অর্থাৎ নট আউট, আবহবিজ্ঞান (প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক)-এ এমন বেনজির ঘটনা কেউ কোনওদিন শুনেছে!
অভিমন্যু গুহ
2019-05-09