কোন্নগরের শিশির, তাঁর নামে চাঁদের গহ্বর, জগদীশ বসুর এই ছাত্রকে ক’জন বাঙালি মনে রেখেছে

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পরে বেতার গবেষণায় আলোড়ন তুলেছিলেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী। বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মনে বেতার সংযোগ ও পদার্থবিদ্যার শিকড় গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিদ্যা বিভাগের সূচনাও তাঁরই হাত ধরে। দেশে প্রথম রেডিয়ো সম্প্রচার চালু করেছিলেন তিনি। তাও আবার কলকাতা থেকে, ‘রেডিও টু-সি-জেড’ (2CZ) কেন্দ্রের মাধ্যমে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন। একের পর এক অকাল মৃত্যু দেখেছেন। চিরকাল থেকেছেন প্রচারের আড়ালে। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এই বাঙালি এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন নিঃশব্দে। অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র। তাঁরই নাম আজ চাঁদের বুকে।

চাঁদের পিঠের ৪৩৭৫ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে বিক্রম ল্যান্ডারের টেরেন ম্যাপিং ক্যামেরা-২ (TMC-2) চাঁদ মুলুকের উত্তর মেরুর ছবি তুলে পাঠিয়েছে। চাঁদের গহ্বর বা ক্রেটারের ছবি ধরা পড়েছে সেই ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ে। অজস্র গহ্বরের মধ্যে একটির নাম ‘মিত্র ক্রেটার।’  ইসরো জানিয়েছে, ৯২ কিলোমিটার চওড়া এই গহ্বরই বাঙালি পদার্থবিদ, বিজ্ঞানী শিশির কুমার মিত্রের নামে। মহাকাশ গবেষণায় কী ভাবে নিজের অবদান রেখে গেছেন শিশির কুমার সেটা আজও এক বিস্ময়।

গোঁড়া হিন্দু পরিবারের রীতি মানেননি বাবা জয়কৃষ্ণ, সেই আদর্শেই অনুপ্রাণিত শিশির

হুগলির কোন্নগরের মেধাবী ছেলেটি তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন। ঠিক তাঁর বাবা জয়কৃষ্ণের মতো। ব্রাহ্মসমাজের আধুনিকতায় অনুপ্রাণিত ছিলেন জয়কৃষ্ণ। পরিবারের সংস্কার ভেঙে বিয়ে করেছিলেন শরৎকুমারীকে। অমতের বিয়েতে পাশে ছিলেন জয়কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শরৎকুমারী আধুনিকা। ১৮৯২ সালে ডাক্তারি পাশ করেন। তার দু’বছর আগেই জন্ম হয় শিশির কুমারের। তখন ভাগলপুরে পুরসভায় সামান্য চাকরি করেন জয়কৃষ্ণ। চার সন্তানের মধ্যে কণিষ্ঠ শিশির কুমার। মেধাবী। ছকভাঙাতেই তার আনন্দ।

“উঠল বেলুন গড়ের মাঠে
নামল গিয়ে বসিরহাটে”..

এই ছড়াটা লোকমুখে তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। মাটিতে না নেমে, বেলুন আকাশে উঠছে কী করে? কিসের টানে? ঝড় উঠেছিল শিশু মনে। শিশির কুমারের বয়স তখন ৭ বছর। পড়ার বইয়ের বাইরে বিজ্ঞানের বই পড়ার নেশা তৈরি হয় তখন থেকে।

দুই দাদার মৃত্যু, বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, লড়াই শুরু করলেন শিশির কুমার

কম দিনের ব্যবধানে দুই দাদা সতীশকুমার ও সন্তোষকুমারের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি বাবা জয়কৃষ্ণ। হার্ট অ্যাটাকে দেশের একটা অংশ অসাড় হয়ে যায়। ভাগলপুরের হাসপাতালে তখন ডাক্তারি করছেন মা শরৎকুমারী। মাইনে খুব কম। অভাব আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে মিত্র পরিবারকে। হার মানেনি কিশোর শিশির। মায়ের অনুপ্রেরণায় ভাগলপুরের টিএনজে কলেজ থেকে ভালো নম্বর নিয়ে এফ-এ পাস করে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। সালটা ১৯০৮। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে এলেন। বদলে গেল ভাবনার জগৎ।

১৯১২ সাল। এমএসসি পাস করলেন ফার্স্টক্লাস নিয়ে। পদার্থবিদ্যায় ভয়ানক আগ্রহ। জগদীশচন্দ্র বসু তখন বেতার গবেষণায় মগ্ন। উদ্ভিদের বৃদ্ধি মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। আচার্য বসুর সহকারী হিসেবে শুরু হল গবেষণার জীবন। বেতার গবেষণায় হাতেখড়ি জগদীশ বসুর কাছ থেকেই।

স্যর আশুতোষের ডাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে

১৯১৬ সাল। বাঁকুড়ার একটি মিশনারি কলেজে শিশির কুমার তখন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। ডাক পাঠালেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ তৈরি হয়েছে, তবে পদার্থবিদ্যার গবেষক-অধ্যাপক নেই। বাঙালি ছেলেদের পদার্থ বিজ্ঞানে আগ্রহ তৈরি করতে আধুনিক ল্যাবোরেটরি চাই। হাল ধরলেন শিশির কুমার। পড়ানোর পাশাপাশি চলল বাংলায় বিজ্ঞানের বই লেখা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন রত্নের ছড়াছড়ি। একদিকে সিভি রমণ, দেবেন্দ্রমোহন বসু অন্যদিকে মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

সিভি রমণের অধীনে আলোকবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন শিশির কুমার। ১৯১৮ সালে ফিলোজ়ফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো শিশিরকুমারের প্রথম গবেষণাপত্র। ‘Interference and diffraction of light’  থিয়োরির জন্য পরের বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-এসসি ডিগ্রি পেলেন। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯২০ সালে প্যারিসের সোরবোন ইউনিভার্সিটিতে শুরু হল গবেষণার নতুন দিক।

দেখা হল মেরি কুরির সঙ্গে। রেডিয়ো-ফিজিক্স, আয়নোস্ফিয়ার নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন বাংলার ছেলে

১৯২৩ সালে তামার বর্ণালী নিয়ে কাজ করে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন শিশির কুমার। মেরি কুরি তখন ইনস্টিটিউট অব রেডিয়ামের প্রধান। তাঁর দলে নাম লেখালেন শিশির কুমার। তেজস্ত্রিয়তা নিয়ে কাজ করলেন দীর্ঘদিন। আবার রাস্তা বদল। প্যারিসের ন্যান্সি ইউনিভার্সিটিতে শুরু হল বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা।  রেডিয়ো-ফিজিক্সে একের পর এক অজানা দিক সামনে আনলেন শিশির কুমার। কাজ করলেন ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি নিয়ে। পরে তাঁরই উৎসাহে রেডিয়ো-ফিজিক্সের পাঠ শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

১৮৮২ সালে বায়ুমন্ডলের তড়িৎ-চুম্বকীয় স্তর আয়োনোস্ফিয়ার নিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ব্যালফোর স্টুয়ার্ট। পরে এই স্তর নিয়েই গবেষণা করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড ও আমেরিকার আর্থার কেনেলি। বায়ুমণ্ডলের এই আয়োনোস্ফিয়ার নিয়ে কাজ শুরু করলেন বাঙালি বিজ্ঞানী শিশির কুমার। পাশাপাশি, নিজের গবেষণাগারে রেডিয়ো ট্রান্সমিটার বানিয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু করে দিলেন। এই সম্প্রচার কেন্দ্রের নাম ছিল রেডিও টু-সি-জেড (2CZ)।

থিওরি অব অ্যাকটিভ নাইট্রোজেন

আবহাওয়ার বদল, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ে বায়ুমণ্ডলের স্তরে কী কী পরিবর্তন হয় তার স্বচ্ছ ধারণা দিলেন শিশির কুমার। ১৯৪৩ সালে তাঁর থিওরি ‘night sky luminescence’ সাড়া ফেলে দিল দেশে-বিদেশে।  আয়োনোস্ফিয়ারের এফ-স্তর (F-Region) নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানী জানালেন, এই স্তরেই রয়েছে আয়ন ও ইলেকট্রন। N2 আয়ন নিয়ে তাঁর গবেষণা বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। Three body collision process নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন শিশির কুমার। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হল তাঁর বই ‘অ্যাকটিভ নাইট্রোজেন— এ নিউ থিওরি।’ কলকাতার বাইরে হরিণঘাটায় একটা গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন শিশিরকুমার। ভারতে এটিই প্রথম আয়োনোস্ফিয়ার ফিল্ড স্টেশন।

১৯৪৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আলাদা রেডিও ফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগ। ১৯৫১-৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন শিশিরকুমার। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে শিশির কুমারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বই তা হল, ‘The Upper Atmosphere’। বায়ুমণ্ডল নিয়ে এত বিস্তারিত তথ্যে ঠাসা বই এর আগে কেউ কোনও দিন লেখেননি।

মহাকাশ গবেষণায় শিশির কুমারের বইয়ের তথ্য ধার নেয় রাশিয়া

১৯৫২ সাল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতিতে বিভোর। মহাকাশ তখন বিজ্ঞানীদের কাছে এক অজানা রহস্য। বায়ুমণ্ডলের স্তর ভেদ করে পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের মায়া কাটিয়ে মহাকাশে প্রেরণ করা হবে উপগ্রহ। রাশিয়ার মহাকাশ বিজ্ঞানীরা যোগাযোগ করলেন শিশির কুমারের সঙ্গে। ‘The Upper Atmosphere’ অনুবাদ করা হল রুশ ভাষায়। সালটা ১৯৫৫। একে একে নানা দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে পড়ল এই বই।

শিশির কুমার মিত্র শুধু বিজ্ঞানী নন, একজন আদর্শ শিক্ষকও ছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন সিলেবাস চালু করেছিলেন তিনিই। ১৯৫৮ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন শিশিরকুমার মিত্র। ১৯৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক দেয়া হয় তাঁকে। ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি পান অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্র। ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ করেছিলেন ১৯৬২ সালে। বায়ুমণ্ডলের তরিৎ-চুম্বকীয় স্তর নিয়ে আলোচনার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন ইসরোর প্রাণপুরুষ বিক্রম সারাভাই। আজও মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণায় শিশির কুমারের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। মৃত্য়ুর (১৯৬৩) ৫৬ বছর পরেও।

চৈতালী চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.