এনআরএসের জুনিয়র চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের মার খেয়ে কোমায় চলে গিয়েছেন সোমবার রাতে। তার ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি, মেদিনীপুর ও বর্ধমানের সরকারি হাসপাতালে ফের চিকিৎসক নিগ্রহের খবর এল মঙ্গলবার মধ্যরাতে।
তবে খোদ চিকিৎসা-মহলই বলছে, এমনটা বোধ হয় হওয়ারই ছিল। গুন্ডামি, তার প্রতিবাদে ধর্না, সেই ধর্নার প্রতিবাদে আবার পাল্টা প্রতিবাদ– দিনভর এমনটাই দেখেছিল এই শহর। তবে রাত বাড়তেই জেলার নানা প্রান্তের নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা জানান দিল, বিদ্রোহ আর শহরে আটকে নেই। গোটা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে দাউদাউ করে।
সোমবার রাতে এনআরএস হাসপাতালে এক বৃদ্ধের মৃত্যুতে তার পরিবারের লোকজন চড়াও হয় চিকিৎসকদের উপর। এর জেরে ২০০ গুন্ডা এসে বেধড়ক মারধর করে হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকদের। মাথার খুলির সামনের অংশ তুবড়ে গিয়েছে ২৪ বছরের সদ্য চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের। ঘটনার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে সামিল হন চিকিৎসকেরা। বন্ধ থাকে পরিষেবা। একটা সময়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না অ্যাম্বুল্যান্সও।
এনআরএস-এ এই বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণ পর থেকেই খবর আসতে শুরু করে, একই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এসএসকেএম, মেডিক্যাল কলেজ, আরজিকরেও। বেলা বাড়লে, এনআরএসের ঘটনায় সংহতি জানিয়ে কর্মবিরতির ডাক দেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বর্ধমান– সব হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা।
পরিস্থিতি তখন থেকেই সমস্যাজনক হতে শুরু করে। কারণ চিকিৎসা একটা এমন পরিষেবা, তা বন্ধ হলে মানুষের চরম সমস্যা। জীবন-মৃত্যুর সংশয় হয়ে দাঁড়াতে পারে অসুস্থ মানুষদের। আর ঠিক সেটাই হল। এমনিতেই এই চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। অনেকেই দাবি করেন পর্যাপ্ত পরিষেবা পাচ্ছেন না। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও অস্বীকার করেন না, যে পরিকাঠামোর খামতির কারণে, চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কারণে, কমতি থেকে যায় পরিষেবায়। অমানুষিক পরিশ্রম করেও সামাল দেওয়া যায় না।
সেই অমানুষিক পরিশ্রম করা মানুষগুলোই উপর্যুপরি মার খেয়ে আসছেন অনেক দিন ধরেই। সারা রাজ্যের নানা প্রান্তে বারবার রক্তাক্ত হয়েছেন চিকিৎসকেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনা অপরাধে। এই অবস্থায় পরিবহের ঘটনা যেন কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছে। গোটা চিকিৎসক মহলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে।
সরকারি ছেড়ে বেসরকারি, শহর ছেড়ে জেলা– সর্বত্র ‘শাটডাউন’-এর ডাক দিয়েছেন জুনিয়র ও সিনিয়র চিকিৎসকেরা।
সাধারণ মানুষের ক্ষোভও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এমনিতেই চিকিৎসা পরিষেবা পর্যাপ্ত নয় এ রাজ্যে, তার উপরে যদি চিকিৎসকেরা কাজই না করেন, তা হলে বহু আশঙ্কাজনক রোগীর জন্য তা নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে নানা জায়গায়।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে যেমন খবর, সেখানেও বিকেল থেকেই চলছিল অবস্থান, বিক্ষোভ। সেখানকার চিকিৎসক অরুণিমা ঘোষ ফেসবুকে জানান, হঠাৎ করেই বহিরাগত কিছু লোক এসে হাসপাতালে অশান্তি তৈরি করে। গেট ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। জুনিয়র ডাক্তারদের লক্ষ্য করে চলে ইটবৃষ্টি। সূত্রের খবর, পরিষেবা না পেয়ে রোগীর পরিবারের কিছু লোক হাঙ্গামা করে হাসপাতালে। ঘটনায় এক জনকে আটক করেছে পুলিশ। জানা গেছে, যে কোনও হামলা রোখার জন্য লাঠি, অ্যাসিডের বোতল নিয়ে প্রস্তুত সবাই। পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থিতি ক্রমশই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ঠিক তেমনই মেদিনীপুর পুলিশি হেনস্থার অভিযোগে নতুন করে আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তাররা। এনআরএস ঘটনার পরেই কর্মবিরতির পাশাপাশি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখাতে থাকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। বিক্ষোভ তুলতে এলে পুলিশের সঙ্গেও একচোট বচসা হয় পড়ুয়াদের। জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, শারীরিক ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে তাদের দুই ডাক্তারকে। ছাত্রদের অভিযোগ, পুলিশ ক্ষমা না চাইলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্মবিরতি চলবেই। তাঁদের দাবি, নিরাপত্তার স্বার্থে লিখিত আশ্বাস দিতে হবে প্রশাসনের তরফ থেকে।
এক জুনিয়র ডাক্তারের কথায়, “এনআরএস-এ আমাদেরই এক সহকর্মীর উপর আক্রমণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আমরা কর্মবিরতি শুরু করেছি। আমাদের পাঁচ দফা দাবি রয়েছে, সেগুলো পূরণ না হলে কর্মবিরতি চলবে।”
আন্দোলনকারীদের কথায়, হাসপাতালে রোগীর পরিবার-আত্মীয়রা ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করবেন তার একটা নির্দেশিকা থাকা দরকার। না হলে যখন তখন আক্রান্ত হতে হয় ডাক্তারদের। পাশাপাশই, রোগী কল্যাণ কমিটির সঙ্গেও কথা বলে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ডাক্তারের কথায়, “আমাদের হাসপাতালে কোনও পুলিশ পোস্টিং নেই। বহিরাগত রক্ষী আমরা চাই না, পরিবর্তে পুলিশি প্রহরা দরকার। তা না হলে বিক্ষোভ উঠবে না।”
ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালও। কর্মবিরতি, বিক্ষোভের মধ্যেই এ দিন অভিযোগ ওঠে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে আরতি বিশ্বাস (৬২) নামে এক মহিলার। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের নওদা থানার সরবঙ্গপুর এলাকায়। মৃতার পরিবারের দাবি, কোনও চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা করেনি। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে আরতীদেবীর। ঘটনার জেরেই ফের ধুন্ধুমার শুরু হয়ে যায় হাসপাতালে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের নানা ঝামেলা আরও বাড়বে। আরও আক্রান্ত হতে পারেন চিকিৎসকেরা। কারণ চিকিৎসার মতো একটা পরিষেবা এ ভাবে আচমকা বন্ধ হয়ে গেলে তা তুমুল সমস্যার কারণ গোটা সমাজের সমস্ত স্তরে। আবার উল্টো দিকে, এই সমস্যা যতই জোরদার হোক না কেন, চিকিৎসক মহল তাঁদের সিদ্ধান্তে অনড়। কারণ তাঁদের দাবি, এই নিয়ে এত জন চিকিৎসক বিনা কারণে মার খেয়েছেন, খাচ্ছেন, তাঁরা আর কোনও আলোচনার পথ খোলাই রাখতে চান না। ‘শাটডাউন’ ছাড়া আর কোনও পথেই হাঁটতে চান না তাঁরা।
এই শাটডাউনের জেরে নিরপরাধ রোগীদের শারীরিক অবস্থা বেহাল হলে, সে দায় কে নেবে, প্রশ্ন উঠেছে সব মহলেই। তবে এই উত্তাপ যে সহজে নামবে না, সে আশঙ্কা যেন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।