সামান্য এক রাজনীতির দল বদলের কারণে ভারতের ও বাংলার রাজনীতিতে হঠাৎ করে একটি নাম বহুজনের চর্চায় এসে গিয়েছে। বহুচর্চিত এই নামটি হল মনিরুল ইসলাম। বীরভূমের এক রাজনৈতিক নেতা। বোলপুর এর কাছে লাভপুর কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়ক। বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল। এখন তৃণমূল থেকে দিল্লিতে গিয়ে সগৌরবে যোগ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপিতে।
এই নামটি অনেকের কাছে নতুন হলেও আমার কাছে যে অনেক পুরোনো এই নাম। এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সঙ্গে আমিও ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছি। আজ তিনি যখন গোটা দেশের প্রচারের আলোয় এসেছেন, তখন দেশবাসীকে জানাই সেই অধ্যায়টির কথা।

বীরভূমের মহম্মদ বাজার থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ডের দুমকা পর্যন্ত কয়েক শত পাথর খাদান এর পাথুরে জমির মালিক আদিবাসীরা। উভয় রাজ্যেই আইন অনুসারে আদিবাসীদের জমি অন্য কেউ কিনতে পারে না। তাই সেখানে অনেক মুসলমান (কিছু হিন্দুও আছে) আদিবাসীদের কাছ থেকে ওই জমি অল্প টাকায় লীজ নিয়ে পাথর কাটার ও স্টোনচিপ তৈরী করার জন্য Crusher বসিয়েছে। তাতে ওই এলাকারই আদিবাসীরা এবং মুর্শিদাবাদ থেকে আনা মুসলমানরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, ওই ক্রাশার গুলির মুসলিম মালিক এবং লেবার সরদারদের সবসময় কু-নজর থাকে আদিবাসী রমণীদের উপর। তাদের লালসা ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ওই এলাকার আদিবাসী গ্রাম মোড়লরা একযোগে সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার পর সকল বহিরাগতদের সমস্ত আদিবাসী গ্রামে প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞার আসল কারণ মুসলমানরা। কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। তাই অনেক দুশ্চরিত্র মুসলমান ওই নিষেধাজ্ঞা না মেনে গোপনে অসদ উদ্দেশ্যে আদিবাসী গ্রামগুলোতে ঢুকতো। আজ থেকে ৯ বছর আগে মহম্মদবাজার থানার পাঁচামি অঞ্চলে ২০১০ সালে এক রাতে তালবন্দী নামে একটি আদিবাসী গ্রামে বশিরুল শেখ (৫০ বছর) নামে এক মুসলমান ঢুকে গোপনে এক সাঁওতাল রমণীর সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায় ধরা পড়ে যায়। তখন ঐ রমণীর স্বামী ক্রোধে কুড়ালের কোপ মেরে ওই মুসলমান দুষ্কৃতকারীকে হত্যা করে। তখন ঐ এলাকার মুসলিম শ্রমিক ও মুসলিম ক্রাশার মালিকরা একযোগে ওই গ্রামটিকে লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। তার প্রতিবাদে বিস্তীর্ণ এলাকায় আদিবাসীরা একত্রিত হয়ে অনেকগুলি ক্রাশার ভেঙ্গে জ্বালিয়ে দেয় এবং গোটা বীরভূম জেলায় অবস্থিত সমস্ত পাথর খাদানের কাজ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন এই ধর্মঘট চলে।[http://hindusamhati2014.blogspot.com/2010/04/hindu-villagers-attacked-by-muslim.html?view=flipcard] ফলে স্টোন চিপের দাম প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে কলকাতায় নির্মাণ কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকমাস এই ধর্মঘট চলার পর অনেক কষ্টে সরকার এই সমস্যার সমাধান করে, আদিবাসীদের বেশ কিছু দাবী মেনে নিয়ে।
সমস্ত আদিবাসীরা এই ধর্মঘট চলার সময় খুব কষ্ট করেছে। কারণ ওখানে পাথুরে মাটিতে চাষ প্রায় হয় না। ক্রাশারে কাজ করেই তাদের পেট চলে। ক্রাশার বন্ধ থাকলে অনাহার। সেই সময় আদিবাসী গাঁওতা এবং অন্য কিছু সংগঠন সামান্য অর্থ সাহায্য করে কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে তাদের কোনরকমে অন্ন সংস্থান করে। আমিও তখন ওই পাঁচামি এলাকা ঘুরে যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করি।
এই ঘটনার পর মুসলিমরা বাধ্য হয়ে কিছুটা সংযত হয়। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব সুযোগ খুঁজছিল বীরভূম থেকে দুমকা পর্যন্ত সম্পূর্ণ আদিবাসী বেল্টে সাঁওতালদের এই প্রতিরোধ কী করে ভেঙ্গে দেওয়া যায়।
সেই সুযোগই এসে গেল ২০১২ সালে লাভপুর থানার সুবলপুর গ্রামে। সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ অন্যত্র আমি দিয়েছি। আদিবাসী যুবতী বালিকা মুর্মু র সঙ্গে এক মুসলিমের অবৈধ সম্পর্ক হাতেনাতে ধরে ফেলে গ্রামবাসীরা ওই দুজনকে সারা রাত গ্রামের মোড়লের বাড়িতে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং সকালে ওই মুসলমান যুবকের বাড়িতে খবর দিয়ে তার দাদাকে ডেকে এনে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। এবং বালিকা মুর্মু ও তার মা কে সাবধান করে দেয় যে আবার এই ঘটনা ঘটলে তাদেরকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কারণ বালিকা মুর্মু র এইরকম আচরণের ফলে গ্রামের অন্য মেয়েদের উপর খারাপ প্রভাব পড়ছে।
এই খবর স্থানীয় এম.এল.এ (বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল হওয়া) মনিরুল ইসলাম এর কাছে যায়। তিনি এক দারুণ ছক কষেন, পাঁচামি-র বদলা নেওয়ার জন্য। লাভপুর থানার পুলিশ তো তাঁর অর্থভোগী। তার উপর তিনি শাসক দলের এম.এল.এ। তাই তাঁর পরিকল্পনায় বালিকা মুর্মু কে ফোনে থানায় ডেকে এনে তাকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে ১৩ জনের নামে গণধর্ষনের কেস দিয়ে দেওয়া হল। মিডিয়া সেটা নিয়ে বিরাট হইচই করল। কিমাশ্চার্যম! মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই ঘটনায় সুয়ো মোটো কেস শুরু করে দিলেন। প্রথমে বোলপুর ও পরে সিউড়ি আদালতে বিচারের নামে প্রহসন হল। আমাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল। ওই ১৩ জন আদিবাসী যুবকের (একজন বৃদ্ধ মোড়ল সহ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেল। [https://www.thehindu.com/news/cities/kolkata/13-convicted-for-labhpur-gangrape/article6427530.ece]

আমার স্পষ্ট মত, দেশে হিন্দু বিরোধী ইকো সিস্টেম ও মিডিয়া দ্বারা সুপ্রীম কোর্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।
এই ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন অনেক জায়গায় বিরাট আন্দোলন করলেন। কিন্তু কোন ফল হল না। মনিরুল ইসলাম এর মনস্কামনা পূর্ণ হল, আদিবাসীদের সবক শেখানো।
ওই ১৩ টি পরিবারকে আমি আমার তৎকালীন সংগঠন হিন্দু সংহতি র পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি। এই কাজে একজন বিশিষ্ট ধর্মগুরুর কলকাতার শিষ্যরা আমাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছেন। তারাপীঠ এর একজন হোটেল মালিকও খুব আন্তরিকভাবে ওই অসহায় আদিবাসী পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন।
ওই গ্রামে এখনও আমি গেলেই আমার পিছন পিছন মনিরুল ইসলামের পা চাটা লাভপুর থানার পুলিশ ঢুকে পড়ে এবং ওই পরিবারগুলোকে হুমকি দেয় আমার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে।
তাই মনিরুল ইসলাম আমার বহু রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কারণ ওই গ্রামের সহজ সরল আদিবাসীদের মুখগুলি আমি কখনো ভুলতে পারি না। গ্রামের শিশুদের চোখে অবাক বিস্ময়, আদিবাসী রমণীদের চোখে ভয় ও কৌতূহল এবং পুরুষদের চোখে হতাশা ও নির্লিপ্ততা – এ দৃশ্য ভুলব কী করে? তাই মনিরুল ইসলাম কেও আমি ভুলতে পারি না।

তপন ঘোষ

সূত্র: https://tapanghosh.home.blog/2019/05/29/%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.