রাজনীতি কৌশলের খেলা। এখানে কোনও ব্যক্তি বা দল সম্পর্কে মানুষের ধারণাটাই সব। সেই ধারণার বশেই কেউ জেতে, কাউ হেরে যায়।
একুশের ভোটে সেই ধারণা গড়ে তোলার খেলাতেই এখন চড়াই উতরাই চলছে।
অনেকের মতে, এই মুহূর্তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর টিমের মোক্ষম চাল এখন রীতিমতো ব্যস্ত রেখেছে তৃণমূলকে। শনিবার বাংলায় দুটি সভা করেছেন মোদী। প্রথমটি হুগলির তারকেশ্বর ও পরেরটি সোনারপুরে। এবং এই দুই সভা থেকেই প্রধানমন্ত্রী কৌশলে এই ধারণা বাংলার মানুষের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছেন, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হারছেন। আর মমতার হারা মানেই তৃণমূলের হেরে যাওয়া। দুই, বাংলায় সরকার গড়তে চলেছে বিজেপি। সেই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় আসবেন তিনি। এমনকি রাজ্যের আমলাদের উদ্দেশেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়ণের জন্য ফাইল রেডি করুন।
একদিকের ছবিটা যখন এরকম, তখন দেখা গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটা সভাতে গিয়ে বলছেন, নন্দীগ্রামে আমিই জিতছি। আমিই জিতছি। সেই সঙ্গে সমস্বরে তৃণমূলের বাকি নেতারাও বলছেন, হ্যাঁ দিদিই জিতছেন। কেউ কেউ আবার নিজেদের মতো করে জয়ের ব্যবধানও দাবি করছেন।
এই ধারণা তৈরির খেলা একপেশে ছিল না কখনও। ভোটে পরামর্শ দেওয়ার জন্য এবার এক চৌখস কুশলীর সাহায্য নিচ্ছে তৃণমূল। তিনি প্রশান্ত কিশোর। তিনি বিশাল টিম সাজিয়ে গুছিয়ে প্রতিনিয়ত রণকৌশল সাজাচ্ছেন। যেমন, দশ বছরের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আড়াল করতে চেয়েই সম্ভবত তৃণমূল ধারণা তৈরি করতে চেয়েছে বিজেপি বাইরের পার্টি, মমতা বাংলার ঘরের মেয়ে। দুই, নির্বাচন কমিশন বিজেপির হয়ে কাজ করছে, তৃণমূল তার ফলে আক্রান্ত। তা ছা়ড়া কিছুদিন আগে বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশ নিয়ে বিপর্যয় (সোমেন মিত্রর স্ত্রী শিখা মিত্র সংক্রান্ত ঘটনা) এবং ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়ায় জেপি নাড্ডার সভায় ভিড় না হওয়াকে কেন্দ্র করেও গেরুয়া দলের বিরুদ্ধে ভাল রকম আলোচনার পরিবেশ গড়তে তুলতে পেরেছিল তৃণমূল। অনেকেই তখন বলতে শুরু করেছিলেন, বিজেপি এখানে পারবে না। শনিবার আবার প্রেস কনফারেন্স করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা অধুনা সর্বভারতীয় তৃণমূলের নেতা যশবন্ত সিনহা বলেন, তিনি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছেন, গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ ও জেপি নাড্ডা বৈঠক করেছেন। তিনি এও দাবি করেছেন,মোদী-শাহদের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট হচ্ছে বাংলায় প্রথম দুদফার ভোটে বিজেপির অবস্থা শোচনীয়। তাই এবার তাঁরা মাইন্ড গেম খেলতে নামবেন।
কিন্তু প্রথম দফার ভোটের পর থেকেই সেই খেলা অনেকটা ঘুরিয়ে দিয়েছে বিজেপি। প্রথম দফার ভোটে দেখা গিয়েছে, দিনভর কমিশনের বিরুদ্ধে নালিশ করে গেছে তৃণমূল। আর বিজেপি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য কমিশনের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। বাংলার ভোটে গত দশ বছর ধরে বিরোধীদেরই ভোটের দিন কমিশনে যেতে দেখা যেত। সবার অভিযোগ থাকত তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কিন্তু এ বার উলোটপুরাণ ঘটতেই বিজেপি দাবি করতে শুরু করে তারা প্রথম দফায় স্যুইপ করছে। তা ছাড়া নন্দীগ্রামের বিজেপি নেতাকে মমতার ফোনের অডিও টেপ ফাঁস হওয়ায় প্রাথমিক ভাবে রক্ষণাত্মকও হয়ে পড়েছিল তৃণমূল।
একই ভাবে দ্বিতীয় দফায় নন্দীগ্রামে ভোটের দিন শুভেন্দু অধিকারী সকাল থেকে যে প্রত্যয় দেখিয়েছেন, সেই হাবভাব তৃণমূলের ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুপুরে বয়ালের বুথে বসে পড়ে লাগাতার নানান অভিযোগ করে গেছেন। এবং সেই মুহূর্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করতে শুরু করেছেন, নন্দীগ্রামে মমতাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে উনি হার স্বীকার করে নিয়েছেন।
এদিনও মোদী বলেন, ভোটের সময়ে কারা কমিশনের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ তোলেন? যাঁরা বুঝতে পারেন যে হার অনিবার্য, যাঁরা দেওয়াল লিখন দেখতে পান, তাঁরাই কান্নাকাটি করেন। মমতাও হার স্বীকার করে নিয়েছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরাজয়ের সম্ভাবনার কথা শুধু বলেননি প্রধানমন্ত্রী। এমন আত্মবিশ্বাস কৌশলে দেখিয়েছেন যে বিজেপি সরকার গড়তে চলেছে। তা বোঝাতে বলেন, বিজেপি জেতার পর যিনিই মুখ্যমন্ত্রী হবেন তাঁকে বলব ভাই দিল্লি থেকে আমাকে টাকা পাঠাতে হবে, আপনি দ্রুত এই বিষয়টা মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে পাশ করুন। মমতা দিদি যে টাকা চাষীদের দিতে দেননি, সেই বকেয়া টাকা সহ সব কৃষক ১৮ হাজার টাকা করে পাবেন।
এখানেই থামেননি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দশ বছর ধরে এখানে সরকার ঘুমোচ্ছিল। সেই মেশিন সচল করতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি, দুর্গাপুজোর আগে সব কৃষকের অ্যাকাউন্টে ১৮ হাজার করে টাকা ট্রান্সফার করা হবে। শুধু তা নয়, রাজ্য সরকারের অফিসারদের উদ্দেশে বলেন, বাংলার সরকারের আমলাদের বলছি, যেখানে যেখানে ভোট হয়ে গেছে, সেখানে কৃষকদের নামের তালিকা তৈরি করুন। তাদের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার নম্বরের সংযুক্তিকরণ হয়েছে কিনা দেখুন। সব রেডি করে রাখুন। যাতে বিজেপি সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ফটাফট টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এই ধারণা গড়ে দিতে চেয়েছেন যে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চলেছে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।
তবে একেই চূড়ান্ত বলে ধরে নিলে হয়তো সরলীকরণ হবে। বাংলায় আট দফায় ভোট গ্রহণ হবে। তার মধ্যে সবে দু’দফায় ভোট গ্রহণ হয়েছে। ধারণা তৈরির চড়াই উতরাই আপাতত চলবে।