ভোটে গোহারান হেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন? সাম্প্রতিক দুটি ঘটনায় সেই লক্ষণ কিন্তু স্পষ্ট! প্রথম ঘটনাটি নির্বাচনের কিছু আগের। মেদিনীপুরে একদল গ্রামবাসী জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেওয়ায় মমতা গাড়ি থেকে নেমে তাদের পিছু ধাওয়া করেন। গ্রামবাসীরা মমতাকে মারমুখী হয়ে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পালিয়ে গিয়েছিল। মমতা সেটা লক্ষ্য করে বলতে থাকেন, “কী রে পালাচ্ছিস কেন! আয় আয়। গালাগালি শিখেছে সব। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন বিজেপির চ্যালেঞ্জের সামনে দিশেহারা মমতা চাপে পড়ে এমন কাণ্ড বাধিয়েছেন। ভোট মিটতে দেখা গেল বিজেপি আঠারোটা আসনে জয়ী হয়েছে। মমতা বাইশটা আসন পেলেও নৈতিক পরাজয় ঘটেছে তার এবং তার দলের। এই অবস্থায় তার ওপর চাপ যে আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। এবং পাহাড়প্রমাণ চাপ সামলাতে না পেরে মমতা আরেক কাণ্ড বাধিয়েছেন। এবারও সমস্যা জয়। শ্রীরাম ধ্বনিতে। মমতা যাচ্ছিলেন নৈহাটিতে আয়োজিত বিজেপির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভায়। ভাটপাড়ার কাছে একদল বিজেপি সমর্থক তাকে দেখে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেয়। মমতা তৎক্ষণাৎ গাড়ি থেকে নেমে তাদের হুমকি দেন। তাকে বলতে শোনা যায়, সব ডাকাত ক্রিমিনাল। সব ক’টাকে তাড়িয়ে ছাড়ব। মেরে চামড়া গুটিয়ে দেব। এরপর তিনি রকের ভাষায় গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ। অভিযোগটি যে সারবত্তাহীন নয় তার প্রমাণ প্রতিটি নিউজ চ্যানেল মমতার বক্তব্যে গালিগালাজের অংশটি সম্পাদনা করে শোনাতে বাধ্য হয়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। নয়তো মমতার বক্তব্যের পরের অংশের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করা যাবে না। যারা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়েছিলেন তারা সকলেই অবাঙ্গালি। পরে নৈহাটির প্রতিবাদ সভায় মমতা বলেন, “আমাদের খাচ্ছ আমাদের পরছ আমাদের জন্য বেঁচে আছো তোমরা। আমরা যদি না দেখি তাহলে না খেতে পেয়ে মরবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথা থেকে মনে হতে পারে হঠাৎ কেন এমন বাড়াবাড়ি শুরু করলেন ? রাস্তায় কেউ জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিলে কেন একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গাড়ি থেকে নেমে বচসায় জড়িয়ে পড়তে হবে? উত্তরপ্রদেশে প্রিয়াঙ্কা বঢ়রার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। প্রিয়াঙ্কা গাড়ি থেকে নেমে জয়শ্রীরাম বলা প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করেন। সৌজন্যের রাজনীতি একেই বলে। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সৌজন্য তো দূর, জয় শ্রীরাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন, তেড়ে যাচ্ছেন, ছাপার অযোগ্য গালাগাল দিচ্ছেন। এমনকী বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি বিভাজন ঘটাতেও কসুর করছেন না। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই তিনি হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণে সচেষ্ট। তার ফল এবারের লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ভোট গেছে তৃণমূলের পকেটে। কিন্তু মমতা জানেন শুধু মুসলমান ভোট দিয়ে হবে না। রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিজেপির সমর্থক মূলত হিন্দুরাই। তাই হিন্দুদের ভাগ করতে হবে। বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি বিভাজন সেই হিসেব মেনেই। দেবতা রাম পশ্চিমবঙ্গে ততটা জনপ্রিয় নন। তিনি প্রধানত উত্তর ভারতের। দেবতা। তাই মমতা রাম এবং রামভক্তদের আক্রমণ করছেন। সেই সঙ্গে উসকে দিচ্ছেন বাঙ্গালির অহংবোধ। যেন এ রাজ্যে অবাঙ্গালিদের জীবন বাঙ্গালির দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল। উদ্দেশ্য একটাই। বিজেপিকে অবাঙ্গালিদের দল হিসেবে চিহ্নিত করে তৃণমূলের বাঙ্গালি ভোটব্যাঙ্ক যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রাখা।
আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চালটি ধূর্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু নেত্রীর মানসিক ভারসাম্য হারানোর লক্ষণ থেকে মুক্ত নয়। বামপন্থী পশ্চিমবঙ্গে দেবতা হিসেবে রাম গুরুত্ব হারালেও এক সময় যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তার প্রমাণ শ্ৰীম রচিত কথামৃত। যেখানে কোটি কোটি বাঙ্গালির আরাধ্য শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহুবার ভগবান ও ভক্তের সম্পর্ক বোঝাতে রাম ও হনুমানের উদাহরণ দিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত বাঙ্গালিদের কী জবাব দেবেন মমতা?মমতার হিস্টিরিয়ার আর একটি লক্ষণ, তার দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রতি বছর ঘটা করে হনুমান জয়ন্তী পালন করে। এবং সেটা করে অবাঙ্গালিদের কাছে টানবার জন্যেই। অথচ যে মুহূর্তে অবাঙ্গালিরা বিজেপিকে ভোট দিল মমতা পালটে গেলেন। অপমান করলেন তাদের। আসলে মমতা ভয় পেয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হবার ভয় তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হবার পরের ভয়। মমতা ক্ষমতায় না থাকলেও দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী থাকবেন। অমিত শাহ থাকবেন। ইতিহাস বলছে স্বৈরাচারী শাসকেরা এভাবেই একসময় মানসিক ভারসাম্য হারান। তখন বোঝা যায় তাদের শেষ লগ্ন উপস্থিত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও আসন্ন।
সন্দীপ চক্রবর্তী
2019-06-07