পোস্টাল ব্যালটেও নাস্তানাবুদ মমতা

গণতন্ত্রের থাপ্পড়টি যে এভাবে নিজের কাছেই ফিরে আসবে তা ঘুণাক্ষরেও হদিশ পাননি তৃণমুল সুপ্রিমো। কার্যত ভোটব্যাঙ্কের ফাকা ঝুলি নিয়ে তাকে যেমন ফিরতে হয়েছে, তেমনই দারুণ ফল করে নিজেদের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে গেরুয়া শিবির। কথায় বলে— ‘আগে ঘর তারপর বাহির’ প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়েতিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন। যে তার ঘরটি আর সামলানো গেল না। আর এই সুযোগে মোক্ষম জবাবটি দিল গেরুয়া শিবির। ইভিএম ভোটের পাশাপাশি নজিরবিহীন ভাবে পোস্টাল ব্যালটেও যার প্রভাব বিলক্ষণ পড়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনে আসা সরকারি কর্মচারী, প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকা থেকে শুরু করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত প্যারাটিচার সকলেই তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছে পোস্টাল ব্যালটে। ডিএ’-কে ‘দয়ার দান’ বলে উল্লেখ করা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির চরম অপমান যে তারা ভোলেনি আক্ষরিক অর্থে তার প্রমাণ দিলেন। পে-কমিশনের নামে যে চূড়ান্ত বিলম্ব । তৈরি হয়েছে তাতে শাসকদলের উপর কর্মীরা আর আস্থা রাখতে পারেনি।
খেলা, মেলার নাম করে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, অথচ কর্মীদের তাদের যোগ্য পারিশ্রমিকটুকু দেওয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতিও এর একটি বিশেষ কারণ বলে উল্লেখ করা যায়। শিক্ষা দপ্তরের বঞ্চনার শিকার অহরহহতে হচ্ছে। কম্পিউটার টিচার থেকে শুরু করে প্যারা টিচারদের। সময় বয়ে গেছে কিন্তু সরকারের দেওয়া ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি।
ফি বছর শীতকালীন সময়ে পাড়ার ক্লাবগুলিকে লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া যেতে পারে, অবলা, সবলা মেলার নাম করে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষকে তোষণ করা যেতে পারে, অথচ কর্মীদের যোগ্য পারিশ্রমিক দিতে দিদির যত আপত্তি। তথাকথিত এই উন্নয়ন যজ্ঞে শামিল করা হয়েছে পুজোয় ক্লাবগুলিকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে। হায়রে গণতন্ত্র ! সরকারি কর্মীরা যাদের হয়ে সারা বছর মুখে রক্ত তুলে কাজ করবে তারাই যদি তাদের এতটুকু পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে গণতন্ত্রের থাপ্পড়টি খেতে হয় বই কি!
আমরা এমনই এক অদ্ভুত রাজ্যে বাস করছি যেখানে বিষমদ খেয়ে মৃত্যু হলে লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়, কিন্তু সেই রাজ্যেরই সপ্তম বেতন কমিশনের প্রস্তাব সুপারিশ করতে বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। তুলনামূলক ভাবে কেন্দ্রের কর্মীদের প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট, পে-কমিশন সবই হচ্ছে। দিনের শেষে রাতে তারা শান্তিতে ঘুমাতে যেতে পারছে এই ভেবে যে, সারা দিনের পরিশ্রম সার্থক হচ্ছে, স্বীকৃতিস্বরূপ তারা তাদের বেতন পাচ্ছে।
এইসব কারণেরই যোগ্য জবাব পেয়েছে রাজ্য সরকার। ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ৪০টিতেই পোস্টাল ব্যালটে কার্যত অনেক পিছিয়ে শাসকদল। যেখানে বিজেপির ভোট চারসংখ্যায় পৌঁছে গেছে, সেখানে তৃণমূলকে তিন সংখ্যার মধ্যেই আটকে থাকতে হয়েছে। বীতশ্রদ্ধ, রাগের প্রতিফলন ঘটেছে তাদের ভোটে। তবুও এই হার থেকে শিক্ষা নেওয়া তো দূরের কথা, খাঁড়ার ঘা-এর মতো আবার আঘাত হানলেন মুখ্যমন্ত্রী। গত ২৭ মে ষষ্ঠবেতন কমিশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলো, সরকারের পক্ষ থেকে আবার সেই মেয়াদ সাত মাস বাড়ানো হলো। এই নিয়ে পর্যায়ক্রমে পাঁচবার এই মেয়াদ বাড়ানো হলো। বিদ্বজ্জনদের কথায় পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম’– কিন্তু অতিরিক্ত অহংবোধ, ঔদ্ধত্যে শাসকদলের পা যে আর মাটিতে নেই তা তাদের এই কার্যকলাপ দ্বারা প্রমাণিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে— মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের উপর প্রতিশোধ নিলেন।
লোকে বলে, পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ’ বলতে যা বোঝায় শাসকগোষ্ঠীর অবস্থা এখন সেই রকম। তারা ভেবে নিচ্ছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটই শেষ, সামনে ২০২১-এ বিধানসভা ভোটটি অপেক্ষা করে আছে তা দিদি ভুলে গেছেন। এই ভাবে চলতে থাকলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে যে শুধু সময়ের অপেক্ষা, তা বোধ করি সবাই আঁচ করতে পারেন।
সরকারি কর্মচারীরা একটি মজবুত সরকারের পক্ষে। সঠিক বিকল্প যেমন খুঁজে নিয়েছেন, ঠিক তেমনই এই স্বৈরাচারী সরকারকে ছুঁড়ে ফেলতে তাদের বেশি সময় লাগবে না। রাজনীতি সচেতন, শিক্ষিত চাকুরিজীবী মানুষরা যত শাসকদলের বিরোধী হবে ততই মজবুত হবে লোকসভা ভোটে রাজ্য থেকে সব থেকে ভালো ফল করা বিজেপির। তাদের হাতে মজুত আছে কঠিন অস্ত্র। তারা এটুকু বলে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে পারবে— কেন্দ্রে তাদের সরকার তারা কর্মীদের যোগ্য সম্মান, পারিশ্রমিক দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
সমাজের শিক্ষিত, চাকুরিজীবী মানুষরা এভাবে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলে, সমাজের অন্য অংশের মানুষরাও এটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েই এগোবে। শিক্ষিত সমাজের কাছে সবসময় কাম্য উন্নত, মেদহীন, দুর্নীতিমুক্ত সরকার, যেটি বর্তমান রাজ্য সরকার দিতে অপারগ। তাই তারা এগিয়ে এসে মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যের যবনিকা পতনে শামিল হয়েছেন।
রণিতা সরকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.