রাওয়ালপিণ্ডির বাসিন্দা মজিদ জাইদি ভারতীয় মুসলমান সমাজে একটি পরিচিত নাম। এই পাক নাগরিক সম্পর্কে আরও পরিষ্কার করে বললে আই এস এবং জামাত সমর্থক ভারতীয় সন্ত্রাসবাদীর কাছে তিনি খুব জনপ্রিয়। জাইদি নিজেকে তার দেশের মদতপুষ্ট কাশ্মীরের ইসলামিক জঙ্গিদের একনিষ্ঠ সমর্থক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক বলে দাবি করেন। তবে পাকিস্তানের কোন গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি যুক্ত, কারও কাছে সেই তথ্য নেই। খোলাখুলি তিনি বলেন পাক গুপ্তচর সংস্থা আই এস আই তাঁর অন্যতম মদতদাতা। এই লোকটির একমাত্র এজেন্ডা ভারত বিরোধিতা করা। বিশেষ করে মোদীকে আক্রমণ করে মিথ্যে কিছু তথ্য দেওয়া। তিনি মনে করেন একমাত্র গান্ধী পরিবারের ছত্রছায়ায় কংগ্রেস ভারতীয়দের মুক্তি দিতে পারে।
এহেন ব্যক্তিটিকে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যম ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্যে আলোচনার টেবিলে বসায়। পুলওয়ামা কাণ্ডের পর সদ্য চালু হওয়া সর্বভারতীয় একটি হিন্দি মাধ্যমের বৈদ্যুতিন চ্যানেলে জাইদি বলেন, ভারতে এই মুহূর্তে একটি মাত্র রাজ্য আছে যেখানে মুসলমানরা সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন। সেই রাজ্যটি হলো পশ্চিমবঙ্গ। যদিও চ্যানেলের সঞ্চালক এবং উপস্থিত চার অতিথির মধ্যে কংগ্রেস সমর্থক আলোচক ছাড়া বাকি তিনজন এর প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু স্বঘোষিত সন্ত্রাসবাদী সমর্থক জাইদি উচ্চ কণ্ঠে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা কলকাতার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে গিয়েছেন। তাকে বোঝানোই যায়নি ভারতের অঙ্গ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কখনই প্রধানমন্ত্রী নন। এই রাজ্যের মুসলমানরা ‘নিজেদের দেশের মতো করে’ কতটা ভালো আছেন তার হরেক উদাহরণ দিয়েছেন জাইদি। তার মধ্যে একটি হলো এখানে আজান দিতে এবং ইদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে কোনও সমস্যা হয় না। এই রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মুসলমানদের কতটা কাছের তারই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিজাব পরার নজির সামনে এনেছেন জাইদি। সচেতন ভাবেই তার মন্তব্য ইনশাল্লা বাংলা একদিন ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হবে এবং মুসলমানদের আরেকটি নতুন দেশ হবে। তা হবে পাকিস্তানের মিত্র। এই নয়া দেশও ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। জাইদি মনে করেন বাংলার মুসলমানরাও চায় নিজেদের আলাদা স্বাধীন দেশ।
ধরে নেওয়া যাক, এই লেখার পাঠকদের একাংশ ভারতের সংখ্যাগুরু সমাজের হলেও প্রবল ভাবে তথাকথিত সেকুলার। ফলে যে কোনও কট্টর মুসলমানদের থেকেও বড়ো হিন্দু বিদ্বেষী। এই ব্যক্তিদের কাছে সেকুলারিজমের মানে হলো দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং হিন্দু বিরোধিতা। অন্তত তারা মুসলমানদের কোনো দোষ বা ত্রুটি খুঁজে পান না। একজন মুসলমান যা খুশি করতে পারে কিন্তু তার দিকে আঙ্গুল তোলা যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই তথাকথিত সেকুলার হিন্দুরা গোমাংস ভক্ষণ করে আর এস এস বা বিজেপির ‘সাম্প্রদায়িকতার’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারে। তবে এই সেকুলারদের শূকরের মাংস খাওয়ার প্রস্তাব দিলে ‘সরল মুসলমান ভাবাবেগে আঘাত লাগবে’ এই আশঙ্কায় শিউরে ওঠে।
প্রশ্ন হলো, জাইদির মতো ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন কী। কারণ আর কিছুই নয় ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সমর্থক তৃণমূলের তোয়াজনীতি কতটা দূরে পৌঁছেছে তারই একটি সামান্য নমুনা দেওয়া। সকলেই জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হলো মুসলমান ভোট নিজের দিকে আনা। স্বাধীনতার পর থেকে তোষণের কারণে সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ্যেও মুসলমান ভোট কংগ্রেসের দিকে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই রাজ্যে দীর্ঘদিন মুসলমান ভোট বামেদের সহায়তা করেছে। ২০০৪ সাল থেকে হাওয়ামোরগ ঘুরতে শুরু করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান কারিগর পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় দল গঠনের সময় বুঝেছিলেন এই রাজ্যে পায়ের নীচে মাটি শক্ত করতে হলে যে কোনও মূল্যে মুসলমান মন জয় করতেই হবে। এই রাজনৈতিক ‘বিচক্ষণতা’ তিনিই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেন। শুরতে কাজটা একটু শক্ত ছিল। কিন্তু বরকতি, কারি হোসেন, দিলচাদ রব্বানি, মৌলানা মহজার আলম-সহ প্রবল হিন্দু তথা দেশ বিরোধী মুসলমান ধর্মগুরুদের প্রচুর অর্থ, উপঢৌকন এবং ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে রফা করে মুসলমান সমাজে অনুপ্রবেশ করে তৃণমূল কংগ্রেস। সকলেই জানেন, মুসলমান সমাজে ধর্মগুরুদের ফতোয়াই তাদের কাছে শেষ কথা। তবে শিক্ষার পরিবেশ পেয়ে খুব সামান্য হলেও মুসলমান তরুণ-তরুণীরা এখন অন্যভাবে ভাবছেন। অতীতে দেখা গিয়েছে বিজেপি সরকারের সঙ্গে জোটে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে এই রাজ্যের ৬৭ জনকে রেল দপ্তরের চাকরি দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৪৪ জন ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের। রেল দপ্তরের সূত্রে জানা গিয়েছে সেই সময় এবং পরেও টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতিকে যাত্রী সুরক্ষা কমিটির সদস্য করা হয়েছিল। এর জন্য বরকতি মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাতা ও সরকারি গাড়ি-সহ অন্যান্য সুবিধা পেতেন। একই সুবিধা পেয়েছিলেন রুকবানুর মা। এভাবে প্রথমে বিভিন্ন মুসলমান ধর্মগুরুকে ও পরবর্তী সময়ে পাক সমর্থক মৌলবাদী নেতাদের দলে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মন পেতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উগ্রবাদী মুসলিম ছাত্র সংগঠন সিমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহমদ হাসান ইমরানকে রাজ্যসভার এবং বামেদের সময় তসলিমা নাসরিন কাণ্ডে উগ্র সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়ানোর প্রধান হোতা ইদ্রিশ আলিকে লোকসভার টিকিট দিয়ে মুসলমান সমাজের মন জয় করেছেন তৃণমূল নেত্রী। কামদুনির ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনার পরে প্রতিবাদী জনতার উপর পুলিশ লেলিয়ে গুলি চালানোর হুমকি দিয়েছিলেন সেই সময়কার বসিরহাটের সাংসদ তথা মৌলবাদী নুরুল ইসলাম। জামাতের সঙ্গে যুক্ত এই ব্যক্তি এখন বিধায়ক এবং হজ কমিটির প্রধান। উগ্র মুসলিম ছাত্র সংগঠন আইএসও এখন এই রাজ্যে বাড়ছে। সবাই বোঝেন, ক্ষমতা লাভের জন্য ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বাঘের পিঠে চড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বাঘের পিঠ থেকে নামার ক্ষমতা তার নেই। ইতিহাস থেকে দেখা গিয়েছে সুযোগ পেলেই এই বাঘ থাবা বসায়। পুলওয়ামার ভয়াবহ ঘটনার পরে সারা দেশ যখন পাকিস্তান তথা ইসলামিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে সেই সময় মোমবাতি পুড়িয়ে লোক দেখানো পথ হেঁটে ট্রেডমিলে চড়ার সময়টুকু বাঁচানো গিয়েছে। এরপর আর রাজ্যবাসীর প্রতিবাদ করার দরকার নেই এমন ফতোয়া জারি করা হয়েছে। এমনকী এখন আর সোশ্যাল মিডিয়ার মত প্রকাশের অধিকারও নেই। পুলিশের নজরদারি চলছে, পাকিস্তান বা সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করা যাবে না। ভারতমাতা কী জয় বললেও তৃণমূলের টাকায় তোষামোদে সিক্ত তাদের আসল ভোট ব্যাঙ্কাররা নজর রাখছে। পরে পুলিশ তাদের হেনস্থা করছে। পাক সমর্থিত সন্ত্রাসবাদের শিকার অমর শহিদদের প্রতি সারা দেশের মানুষ খোলা মনে শ্রদ্ধা জানালেও এই রাজ্যের মানুষের কাছে তাদের নিয়ে ভাবা এখন ভয়ের বিষয়।
এখানেই বিষয়টি শেষ নয়। বর্তমান রাজ্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাতেও যেতে ভয়ের আবহ কাজ করছে। সন্দেহ, রক্তচক্ষু, সঙ্গে থেকে নজরদারি চালানো, অযাযিত ভাবে ভাব জমানোর চেষ্টা এই সব বিষয়গুলি দীর্ঘদিন থেকে চলছে। কামদুনি, পার্কস্ট্রিট, খাগড়াগড়, বলাগড়-সহ বিভিন্ন ঘটনা, এছাড়া মেটিয়াবুরুজ-খিদিরপুরকে মিনি পাকিস্তান বলে চিহ্নিত করা, বঁনগা এলাকায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ, অনুপ্রবেশ, গোরু পাচার, সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় প্রদান ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পরেও কেবলমাত্র ভোটের জন্য রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ের পরে হিংস্র ছুরির ঝলক দেখা যাচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগীর কাছে দেশভাগের সময়কার নোয়াখালি, ঢাকা, ময়মনসিংহ, এমনকী কলকাতার কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে।
একটা ব্যক্তিগত কাজে অতি সম্প্রতি বিষ্ণুপুরের আমগাছিয়ার কিছুটা ভেতরে যেতে হয়েছিল। কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের শহরতলির জোকা ছাড়িয়ে পৈলান থেকে কিছুটা দূরে আমগাছিয়া। পুলওয়ামায় পাক মদতপুষ্ট ইসলামিক জঙ্গি হামলার ঘটনার পরে সারা দেশের নাগরিক যখন ব্যথিত তখন রাজ্যের সমস্ত মুসলমান অধ্যুষিত জায়গার মতো আমগাছিয়ার এই অঞ্চলও সব ধরনের ‘আক্রমণের’ জন্য প্রস্তুত। সদর রাস্তা ছেড়ে ছোটো রাস্তার ভেতরে যেতেই অগুনতি খারিজি মাদ্রাসা, মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে হরেক প্রশ্ন। অযাযিত ভাবে সঙ্গে চলা। ইশারায় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা। ঘরের জানালা, দরজায় দাঁড়ানো কৌতূহলী মুখ, সন্দেহজনক চাউনি। সব মিলিয়ে যেন যে কোনও সময় কিছু হওয়ার আশঙ্কা। অথচ এই এলাকা থেকে কিছুটা দূরে ডায়মন্ডহারবার জেলা পুলিশের সদর দপ্তর। যেতে হয়েছিল সেখানেও। মনে হলো পুলিশ কর্মীরাও খুব স্বস্তিতে নেই।
প্রশ্ন হলো, এই রাজ্যের এহেন হাল কেন, কে দায়ী এর জন্য? সবটাই কি বিজেপি বা আর এস এসের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ভাবতে হবে। বিজেপির সঙ্গে তাদের সুবিধাবাদী জোট ভেঙে বেরিয়ে আসার পর থেকে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য ভারতীয় সংস্কৃতি, দেশ ও জাতীয়তা বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী। এমনকী দেশের শহিদ বীর জওয়ানদের আত্মত্যাগকেও উপেক্ষা করতে দ্বিধা করেন না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তার পেটোয়া সংবাদমাধ্যমগুলি প্রচার করে চলেছে যেন ‘দেবদূত’ ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী এবং তাদের সমর্থকরা গলা বাড়িয়ে রেখেছে আর হিন্দুরা ‘কচুকাটা’ করছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী আর তার দলের মিথ্যা প্রচার এতটাই লাভজনক হয়েছে যে সুদূর রাওয়ালপিণ্ডির একজন কট্টর সন্ত্রাসবাদীর সমর্থন পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর হয়তো দেখা যাবে মজিদ জাইদি ‘সমর্থকশ্রী’ উপাধি পাচ্ছেন আর পাকিস্তান সরকার বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ‘তোষণ-ই-হিন্দ’ সম্মাননা দিচ্ছে।
সুকল্প চৌধুরী