ভোট বিপর্যয়ের নৈতিক দায় মাথায় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ ছাড়তে চেয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যাও যে তেমন করতে পারেন সেই আশঙ্কা দলের মধ্যে ছিলই। হলোও তাই। নির্বাচনী বিপর্যয়ের ঠিক পরের শনিবার কালীঘাটে দলের সব জেলা সভাপতি, লোকসভা ভোটে জয়ী সব সাংসদ, হেরে যাওয়া প্রার্থী এবং মন্ত্রীদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠক শুরু হয় নাটকীয় ভাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়াতেই বলেন, নির্বাচন কমিশনের জন্য তিনি সরকারের কাজই বহুদিন ধরে করতে পারছেন না। এভাবে কাজ করা যায় না। ক্ষমতাহীন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকতে চাই না। চেয়ার ইজ নাথিং ফর মি। আমি দলের সভাপতি হয়ে কাজ করতে চাই।
মমতার যেই একথা বলা, অমনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, তাপস রায়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ফিরহাদ হাকিমরা উঠে দাঁড়িয়ে না না করে ওঠেন। দলের বর্ষীয়ান নেতা তথা রাজ্যের পঞ্চায়েত ও জল সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা ছিলেন পিছনের সারিতে। সুব্রত ও কল্যাণ চেয়ার ছেড়ে উঠে মমতার সামনে চলে আসেন। সুব্রতবাবুবলেন, মমতা যেও না, যেও না। এরকম সিদ্ধান্ত নিও না। কল্যাণের চোখ ছলছলে।
স্ক্রিপ্ট মেনে শেষমেশ রণে ভঙ্গ দেন তৃণমূলনেত্রী। তবে তার পরেই শুরু হয়ে যায়। ভোটে হারজিতের ময়না তদন্ত। মন্ত্রী, নেতাদের বকাবকি, ধমকধামক। একে সরিয়ে ওকে মাথায় তোলা। কিন্তু দিদি নিজের দোষ খুঁজলেন না। একবারও ভাবলেন না তিনি। নিজে গোটা দু’মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চে মঞ্চে মন্ত্র পাঠ করে আসলে ধর্মীয় মেরুকরণের কাজটাই করে গিয়েছেন।
ভোট বিপর্যয়ের পর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে অভিমান ঝরে পড়ল দিদির গলা থেকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “মানুষের জন্য অনেক করেছি। আর না। এবার দলে একটু বেশি সময় দেব।” মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য যে শপথ নিতে হয় তাতে এই কথাটা বলা যায় না, অথচ তিনি বললেন। অবশ্য এই রাজ্যে তিনিই আইন, তিনিই সংবিধান। তাই তো তিনি বলতে পারেন “বেশি করতে আবার একটু …এখন মনে হচ্ছে একটু বেশিই করে ফেলেছি। এবার আমি একটু দল করব।” সেই সঙ্গে দিদি এও বলেন, মানুষের প্রজেক্ট করতে গিয়ে যারা শুধু নিজেদের প্রজেক্ট করেছে আমি তাদের জন্যও এবার একটু কড়া হব।” মানে তিনি মেনে নিলেন। মানতে তো হবেই। তিনি যতই বলুন যে, এই নির্বাচনের ফল তিনি মানবেন না তবুমানতে তো হবেই। তেমনই এটা মানতে হবে যে, মানুষের প্রকল্পকে তৃণমূলের বানানোর জন্যই এইরায়। শুধু মেরুকরণ মেরুকরণ করে জনতার এই রায়কে ছোটো করে দেখা ঠিক হবে না।
লোকসভা ভোট হলেও, এবারের প্রচারে তৃণমূলের অন্যতম হাতিয়ার ছিল রাজ্য সরকারের উন্নয়নের কর্মসূচি। দেওয়াল লেখা থেকে বক্তৃতা, সবেতেই জায়গা করে নিয়েছিল সবুজ সাথী,কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর মতো প্রকল্প। তৃণমূল ভেবেছিল এগুলো দিয়েই। বাজিমাত হবে। আর গ্রামাঞ্চলে এইসব প্রকল্পের সুযোগ পাওয়া মানুষের সংখ্যা বিরাট। কিন্তু দেখা গিয়েছে গ্রামাঞ্চলেই তৃণমূলের ভোটে ধস নেমেছে। গ্রামীণ ১৫টি কেন্দ্র জিতে নিয়েছে বিজেপি। কিন্তু সেটা আদৌ শুধু ধর্মের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, সারা দেশেই মানুষ মোদী সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রাজ্যের মানুষই বা তার থেকে বাদ যাবেন কেন?
অথচ দিদি বলছেন, এবার সরকার আর মানুষের জন্য কাজ করবে না। সরকারি প্রকল্প নিয়ে এমন কথা বলার অধিকার আদৌ আছে। কি তাঁর? অথচ আক্ষেপের সুরেই দিদি বলছেন, “কী করিনি। মরে গেলেও এখন টাকা পায়। মানুষের জন্য সব করেছি। সব কমপ্লিট। এবার দলে সময় দেব।”
মেরুকরণ নয়, নীচু স্তরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও যে জঙ্গলমহল-সহ একাধিক জায়গায় তৃণমূলের ধস নামিয়েছে সেই রিপোর্টও রয়েছে দিদির কাছে। তবু চুপ থেকে দিদি অন্যদিকে নজর ঘোরাচ্ছেন। কারণ দিদি জানেন, তাঁর নীচুতলার কর্মীরা যেভাবে জনগণের টাকা লুটপাট করেছে তা জনসমক্ষে বলা যায় না।
সামনে ইদ আসছে। তিনি অবশ্যই ইফতারে যাবেন। তার কথায়, “ আমি তো মুসলমান তোষণ করি। যে গোরু দুধ দেয় তার লাথও খাব।”মমতার বিরুদ্ধে তোষণের রাজনীতির অভিযোগ কম নয়। বরং বহুদিনের। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেই ইমাম ভাতা চালু করেছিলেন মমতা। তখন থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। তারপর ইদের দিন রেড রোডে গিয়ে নমাজ পড়া ইত্যাদি তোষণের রাজনীতির উদাহরণ অনেক। এমনকী সম্প্রতি পুলওয়ামায় সেনাবাহিনীর কনভয়ে সন্ত্রাসবাদী হানার পর মোদী সরকার যখন পাকিস্তানকে দায়ী করে, তখনও মমতা বলেছিলেন তদন্ত না করেই কেন দোষারোপ করা হচ্ছে। তাতেও স্পষ্ট হযেছিল, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি রাখতেই দিদি পাকিস্তানের পক্ষ নিতেও পিছপা হন না। ভাবুন তো, বাস্তবে যাই হয়ে থাক কোনও শপথ নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী কি এভাবে বলতে পারেন,“যারা হিন্দু-মুসলমান করে ভোট দেননি, আমার ওপর সন্তুষ্ট হননি, তাদের কিছু বলার নেই। এতে যদি আমাকে একা থাকতে হয়, রাজি আছি। সারাজীবন লড়াই করেছি। আরও লড়াই করে যাব।”
তবে দিদি কিন্তু ভুল নন। ১৮টি আসনে তৃণমূলের পরাজয়ের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ হিন্দুপ্রধান এলাকাতেই ভরাডুবি হয়েছে দলের। বিপরীতে, মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে দলের জয়ের ব্যবধান বেড়েছে। এমনকী বাম বা কংগ্রেসের হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে, তখন মুসলমান ভেটের মেরুকরণ। হয়েছেতৃণমূলের অনুকূলে। যে ২২টি আসনে তৃণমূল জিতেছে তার প্রধান কারণ হলো মুসলমান ভোট। উলুবেড়িয়ায় সাজদা আহমেদ, জঙ্গিপুরে খলিলুর রহমান, মুর্শিদাবাদে আবু তাহের, যাদবপুরে মিমি চক্রবর্তী, ডায়মন্ডহারবারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, বসিরহাটে নুসরত জাহান এরা সকলেই জিতেছেন মুসলমান ভোটের তাকতেই। তাই তাদের প্রতি কৃজ্ঞতা স্বীকার করে নিলেন দিদি। যাতে ভবিষ্যতেও ষোলো আনা শক্তি ও ভালোবাসা দিয়ে তারা তৃণমূলের পাশে থাকেন।
দিদি আপনিই ঠিক। কিন্তু আপনি যে গোরুর দুধ খান তাদের আর কতদিন গোরু বানিয়ে রাখতে চান। উন্নয়নের ডাকে সাড়া দিয়ে আর আপনার বঞ্চনার জবাব দিতে গিয়ে তারা দুধ দেওয়া যেদিন বন্ধ করবে সে দিনটার মুখোমুখি হতে পারবেন তো?
সুন্দর মৌলিক
2019-05-31