ও পিসি তুই চলে যা, জয় বাংলায় চলে যা, হেতায় তোকে…

দেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ এখনো পর্যন্ত জয় শ্রীরাম স্লোগানকে গালাগাল মনে করেননি, যারা এই স্লোগান তুলেছেন তাদের ক্রিমিনাল বলে আখ্যা দেননি। এই স্লোগানের মোকাবিলায় মমতা প্রথমে জয়হিন্দ স্লোগান দিতে বলেন। পরে যখন বুঝলেন জয় শ্রীরাম জয়হিন্দের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই অর্থাৎ জয় শ্রীরামওয়ালারা অনায়াসেই ইসলামি গন্ধহীন স্লোগান জয়হিন্দ বলতে শুরু করবেন তখন তিনি মত পরিবর্তন করে জয় হিন্দের জায়গায় প্রতিবেশী ইসলামিক বাংলাদেশের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আমদানি করলেন। একাত্তরে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনার সময় মুক্তি ফৌজের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। ভারতের বন্দে মাতরমের মতো এখনো বাংলাদেশের অন্তরাত্মার স্লোগান জয় বাংলা। এর আগে একাধিকবার এ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে বাংলা রাখার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে বাংলা রাখার প্রয়াস ও জয় বাংলা স্লোগান শোনার পর কেন জানি সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে শোনা ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’-এর রিমেক ‘ও পিসি তুই চলে যা বাংলাদেশে চলে যা হেতায় তোকে মানাইছে না রে, এক্কে বারে মানাইছে না রে…’ মনে পড়ছে। নির্বাচনের সময় সভ্যতা ভব্যতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে জেহাদিদের মনের ভাষায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গাল দিয়েছেন, অপমান করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশনেনা গিয়ে ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক আন্দোলন তৈরি করে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের আমজনতা তথা আন্তর্জাতিক মহলে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরিতে সচেষ্ট হয়েছেন। একটু বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে মমতার কার্যশৈলী অনেকটা আরবান নকশালদের মতো উপরে গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতার ছাপ ভেতরে ভয়ংকর।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরও রণংদেহি মমতা। নৈহাটি-ভাটপাড়ায় গোলমালের জেরে ভয়ানক খাপ্পা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, নির্বাচন কমিশন চলে গিয়েছে, এখন আমার হাতেই সবকিছু। কাউকে ছাড়ব না। জানবেন রেগে গেলে আমি ভয়ংকর। ভাটপাড়ার ধরনামঞ্চে যাওয়ার সময় রাস্তার ধারে কিছু লোক ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেন। এতে মমতা ক্ষিপ্ত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে হনহন করে এগিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার খাবে, পরবে আর গোলমাল পাকাবে? সবকটাকে তাড়িয়ে ছাড়ব। সব ডাকাত, ক্রিমিনাল। জয় শ্রীরাম ধ্বনির মোকাবিলায় তৃণমূল এখন থেকে জয়হিন্দ ধ্বনিকে হাতিয়ার করবে। মমতার নিদান, কেউ ফোন করলে জয়হিন্দ বলুন। দেখা হলে জয়হিন্দ বলুন’। পরে নৈহাটির ধরনামঞ্চ থেকে বলেন, “গাড়ির সামনে এসে গালাগালি করছে! সঙ্গে সঙ্গে অ্যারেস্ট করতে পারতাম। লোকগুলিকে চিনে রেখেছি।
মুখ্যমন্ত্রীর মতো রাজ্যে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন ব্যক্তি এরকম ভাষায় কথা বলতে পারেন কিনা, কিংবা সভ্য সমাজের সদস্য হয়ে একজন সাধারণ ব্যক্তিও এই রকম ভাষায় কথা বলতে পারেন কিনা তা বিচারের ভার না হয় পাঠকের দরবারেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু রাজ্যে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আছেন বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার প্রয়োগও আমরা দেখতে পাচ্ছি। শুধু মাত্র মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গালি মনে হওয়ার জন্য ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি’ দেওয়া অপরাধ। এই অপরাধের জন্য পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কেস দিচ্ছে। মজা করে মানুষ বলছেন পশ্চিমবঙ্গে কাজীর শাসন চলছে। কারণ কাজীর শাসনে চৈতন্য মহাপ্রভুকে হরেকৃষ্ণ মহানাম করতে বারণ করা হয়েছিল। পরে অবশ্য মহাপ্রভুর অহিংস অভ্যুত্থানের চাপে প্রাণভিক্ষে চেয়ে কাজি নিষ্কৃতি পান।
জানি না ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি’ নিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর স্টাইলে পশ্চিমবঙ্গে অহিংস অভুত্থান হবে কিনা। তবে টেলিভিশনের পর্দায় মুখ্যমন্ত্রীর জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে রাস্তার নেমে তেড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আমার বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ছে। হয়তো বা এই সমস্ত ঘটনা থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। ছাত্রাবাসে কেউ একজন বুঝতে পারল কম্পিউটার সাইন্সের একনবাগত পড়ুয়াকে বাঘা বললে সে ভীষণ ক্ষেপে যায়। কখনো কখনো তেড়ে আসে। জানা জানি হওয়ার পর অনেকেই একটু মজা নেওয়ার জন্য বাঘা বলেই ছুটে পালাতো। আড়াল থেকে যারা বাঘা বলে চিৎকার করতো বাঘা তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করত। এক সময় এমন হলো যে ছাত্রাবাসের শুধুমাত্র ‘বেয়াদপ’ ছাত্ররা নয় নিপাট ভদ্রলোক আবাসিকরাও একটু মজা নেওয়ার জন্য বাঘা বাঘা বলে চিৎকার করে উঠতো। শেষে যাতনা সহ্য করতে না পেরে বাঘা ছাত্রাবাস ছেড়ে দিল। তাতেও কিন্তু নিষ্কৃতি মিলল না। কারণ বাঘা এতটাই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল যে ডিপার্টমেন্টে, ক্যাম্পাসে ওকে দেখলেই সবাই বাঘা বাঘা বলে চিৎকার করে উঠতো। এমনকী অধ্যাপকরাও নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে বাঘা বলে হাসি মজা করতো। কিছুদিন পর দেখা গেল বাঘা আর ক্যাম্পাসেই ঢুকছে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঘার আর পড়া সম্ভব হলো না।
এবার কলেজের একটি ঘটনা বলি। বাণিজ্য বিভাগের এক নতুন তরণী অধ্যাপিকা ক্লাসে ঢুকে দেখলেন ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে একটি উলঙ্গ মেয়ের ছবি আঁকা রয়েছে। ছাত্ররা মুখ টিপে টিপে হাসছে। সবাই ম্যাডামের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। অধ্যাপিকা ক্লাসে ঢুকে শান্তভাবে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চক হাতে নিয়ে উলঙ্গ ছবিটিতে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন। এবার বলোতো কেমন লাগছে?’ সমস্ত ক্লাস নির্বাক। অধ্যাপিকা বলতে লাগলেন ছবিটি যে এঁকেছে সে ভালো শিল্পী হলেও ওর ভাবনায় কিন্তু একটু ভুল হয়েছে। কারণ কোনও বাথরুমের দৃশ্যে আগের ছবিটি উপযোগী ছিল কিন্তু এটা শ্রেণীকক্ষ, এখানে পোশাক-আশাকের প্রয়োজন আছে। ক্লাসে সবাই মাথা নীচু করেই কথাগুলি শুনছিল। সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন ওই অধ্যাপিকাকে কোনো রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
এবারের লোকসভা নির্বাচন চলার সময় প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে অনেক জায়গাতেই মোদী মোদী ধ্বনি শুনতে হয়েছে। মোদী মোদী ধ্বনি শুনে প্রিয়াঙ্কা তেড়ে গিয়েছেন এমন কথা শোনা যায়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এক জনসভায় যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের জনতা মোদী মোদী বলে চিৎকার করতে থাকলে প্রিয়াঙ্কা গাড়ি থেকে নেমে মোদী ভক্তদের শুভেচ্ছা দেন, হাত মেলান, হাসি মুখে ছবিও তোলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মোদী ভক্তরাই ব্যাকফুটে চলে যান। একই ঘটনা কলকাতায় মদন মিত্রের রোড শোয়ে হয়েছে। রোড শো চলাকালীন যারা মোদী মোদী বলে চিৎকার করছিল তাদের ব্যাপারে সংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মদন বলেন ওরা মুখে মোদী মোদী বললেও ভোট আমাকেই দেবে। ব্যাপারটি কিন্তু ওখানেই মিটে গেছে। এই সমস্ত ছোটোখাটো বিষয়। মমতা বোঝেন না তা হয়তো নয়। সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণের দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো তিনি জেনে বুঝেই এই ধরনের ভারসাম্যহীন আচরণ করছেন। অর্থাৎ জয় শ্রীরাম ধ্বনি শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এত সিরিয়াস হয়ে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের আবেগকে বিশ্বাসকে আহত করে এ রাজ্যের মৌলবাদী জেহাদিদের বার্তা দিতে চাইছেন। তবে এই বিষয়টি নিয়ে কিন্তু আট থেকে আশি সবাই হাসি মশররা করছেন এবং বলছেন বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি।
সাধন কুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.