ঠা ঠা রোদে চল্লিশ ডিগ্রি গরম। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই এক ঘন্টা চার মিনিটের বক্তৃতা।
কিন্তু ‘লাইনটা’ কী দিদি?
ব্যালটে ফেরা? ব্ল্যাকমানি ফেরত চাওয়া? মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা দূর করা?
বহুদিন পর একুশের মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই যেন দিগভ্রান্ত। যে মন্ত্র দিতে চাইলেন, তা কর্মীদের গলা দিয়ে নামানো মুশকিল শুধু নয়, অনেকে বলছেন না মুমকিন! পর্যবেক্ষকরা কেউ কেউ জানাচ্ছেন, এক্কেবারে ‘ডি-ফোকাসড’!
অথচ এক বছর আগেও কিন্তু এ রকম ছিল না। বাংলার মা-মাটি-মানুষ অ্যাদ্দিনে জানে একুশের সমাবেশ মানে তৃণমূলের বার্ষিক সাধারণ সভা। ওই সভায় গত এক বছরের ‘স্টক টেকিং’ করেন দিদি, আগামী এক বছরের রাজনৈতিক মন্ত্র দেন। তা শুনে, বুঝে নিয়ে যে যাঁর ঘরে ফিরে যান।
গত পঁচিশ বছরে তাই হয়েছে। এক সময়ে মূল মন্ত্র ছিল সিপিএম বিরোধিতা। সে জন্য এই একুশের মঞ্চেই শপথ পাঠ করিয়েছেন দিদি। আরও তীব্র, আরও আগ্রাসী আন্দোলনের আগুন ঢেলে দিয়েছেন কর্মীদের মনে। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়েও তা শুনে রক্ত গরম হয়ে গেছে কর্মীদের, তাঁরা আবেগে ভেসেছেন। ডিম ভাত খাওয়াতে হয়নি, জল না পেলে তাও ভি আচ্ছা। আবেগই ক্যালোরি জুগিয়েছে।
পরে বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর সিপিএম বিরোধিতার বিষয়টি লঘু হয়েছে। নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছেন দিদি। আরও বড় হয়ে ওঠার। জাতীয় দল হওয়ার। যা সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছিল গত বছর। একুশের মঞ্চ থেকে দিদি বলেছিলেন, বাংলায় ৪২ এ ৪২ চাই। বাংলাই পথ দেখাবে দিল্লিকে। সবার মধ্যে না হোক তাতেও অনেকের মনে আবেগ ছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন দিদি।
কিন্তু এ বার, উনিশের ভোটে জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্নকে দুরমুশ করে দিয়েছে মোদী-অমিত শাহ-র একাই তিনশ পার। বাংলায় ৪২ দূরের গ্রহ, ২২ এ আটকে গিয়েছে তৃণমূল। উত্তরবঙ্গে মালদহ পর্যন্ত পুরো সাফ। জঙ্গলমহলের চার জেলায় একটাও আসন নেই। উপরি কাটমানি ফেরতের দাবির মুখে পড়ে জর্জরিত অবস্থা বহু নেতার।
একুশের মুড এ বার তাই ছিল ঢিলেঢালা। একে তো আগের তুলনায় লোক অনেক কম। তাও খাপছাড়া। আর তাঁদের যে মন্ত্র দিলেন দিদি, সেটাই তো মানুষকে বোঝানো কঠিন,-‘ইভিএম নয় ব্যালট চাই।’ রাজ্যের হাতে যত ভোট রয়েছে, পঞ্চায়েত-পুরসভা সবই ব্যালটে হবে। আমেরিকায়, বিলেতে, জাপানে যদি ব্যালটে ভোট হয়, তা হলে বাংলায় নয় কেন? দেশেই বা কেন নয়? দিদি-র কথায়, “ইভিএমে ভোট হল ‘মিস্ট্রি’!” মানে রহস্য!
কিন্তু মমতা যখন মাইকে এ কথা বলছেন, তখনই যেন পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে অদৃশ্য অন্য কোনও মাইক থেকে। দিদি, ব্যালটের অভিজ্ঞতা বাংলার ঢের হয়েছে। বাংলার মানুষ জানে, ব্যালট মানেই ছাপ্পা। বুথ লুঠ। এক বছর আগেই পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে ব্যালটে। কত লক্ষ মানুষ বুথে গিয়ে দেখেছে, তাঁদের ভোট পড়ে গিয়েছে। ভোটের দিন ব্যালট বাক্স ফেলে দেওয়া হয়েছে পুকুরে। গণনার দিন গণনাকেন্দ্রের মধ্যেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যালট পেপার। সুতরাং মানুষকে কি ব্যালটের যুক্তি বোঝানো যাবে? তৃণমূল পারবে?
এ দিন দিদি-র দ্বিতীয় মন্ত্র ছিল, ব্ল্যাকমানি ফেরতের দাবি। কদিন আগে দলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি নেতাদের যে ভাবে কাটমানি ফেরতের কথা বলেছেন, তা দৃশ্যত বুমেরাং হয়েছে বাংলায়। গ্রামে, ব্লকে তৃণমূলের নেতারাই প্রতিবাদের মুখে পড়ছেন। কাটমানি ফেরতের দাবি সংক্রমিত হয়ে গিয়েছে বাংলা জুড়ে। তার থেকেও বড় কথা হল, মানুষের ভয় কেটে গিয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতার বাড়িতে গিয়ে যে টাকা ফেরত চাওয়া যায় সেই সাহস পেয়ে গেছেন তাঁরা।
রবিবার তৃণমূলের সেই নেতা কর্মীদেরই দিদি বলেছেন, বিজেপি-র কাছে দাবি তুলতে ব্ল্যাকমানি ফেরত দাও। ভোটে যে এত হাজার কোটি টাকা খরচ করলে কোথা থেকে পেলে? কে দিল?
দিদি-র তৃতীয় মন্ত্র হল, তৃণমূলের শুদ্ধিকরণ। একুশের মঞ্চ থেকে এ দিন তিনি বলেছেন, তৃণমূল উন্নততর চরিত্র তৈরি করুক। আদর্শ দল হয়ে উঠুক। চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি করুক। মানুষের বাড়ি বাড়ি যাক। বুথে বুথে সংগঠন তৈরি করুক।
কিন্তু তাঁর সেই বার্তাও কোথাও যেন ধাক্কা খাচ্ছে। দলের পুরনো নেতারাই ঘরোয়া আলোচনায় প্রশ্ন তুলছেন, কাটমানি বন্ধ করতে বলেছেন দিদি। মানে করে খাওয়ার রাজনীতি চলবে না। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে গেলে, চায়ের দোকানে বসার লোক পাওয়া যাবে তো? কারণ, এতদিনে মোটামুটি ভাবে এই সিস্টেম তৈরি হয়ে গিয়েছে যে তৃণমূল করা মানেই জীবিকা। কাটমানি বন্ধের পর সেই অর্থনৈতিক মেকানিজম বিকল হয়ে গেলে, তৃণমূল তারা করবে কেন? হয়তো সে কারণেই বার বার করে কর্মীদের তাঁকে বলতে হল, প্রলোভনে পা দেবেন না, টাকা দিলেও যাবেন না, সিলিন্ডার দিলেও যাবেন না, পেট্রল পাম্প দিলেও না।
পর্যবেক্ষকদের মতে, আরও একটি বিষয় এ দিনের ছবিটায় স্পষ্ট। তা হল, কোনও কোনও বিষয়ে তিনি নিজেই রক্ষণাত্মক। স্বাভাবিক ভাবে যে কথাগুলো তিনি বলেন, তার অনেক ব্যাপারেই সংযত। ধর্মের কথা বলছেন না, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার কথা বলছেন না, যেন কেউ এক জন তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। সেই মোতাবেক চলছেন। আর তাতে যেন আরও ছন্দপতন ঘটছে।
দিদিকে আগের মতো করে যেন পেলেন না ভাইয়েরা।