মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্রটি কী? এ প্রশ্ন এখন এই কারণেই উঠতে বাধ্য। কেননা, তার মুখ্যমন্ত্রিত্বের আট বছরের মাথায়। রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির যে সার্বিক অবনতি হয়েছে, সেই সূত্র ধরেই। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতার এক এক রকম রাজনৈতিক চরিত্র থাকে। চরিত্রগতভাবে কেউ উদারনৈতিক, পরমতসহিষ্ণু। কেউ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। কারো বা প্রখর দূরদৃষ্টি রয়েছে। কেউ ব্যক্তিত্ববান। কেউ বা দুর্বল চিত্ত। ভারতের রাজনীতিতে এইরকম। বিভিন্ন চরিত্রের রাজনীতিকদের বারংবার দেখা মিলেছে। দেখা মিলছেও। রাজ্যের রাজনীতিতেও এরকম নানাবিধ চরিত্রের সমাহার দেখেছি আমরা। একজন রাজনৈতিক নেতা যখন অধিষ্ঠিত হন, তখন তার রাজনৈতিক চরিত্রটি কিছু না কিছু প্রভাব বিস্তার করে রাজ্য পরিচালনায়, দল পরিচালনায়। ড. প্রফুল্ল ঘোষ, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশংকর রায়, জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন এঁদের রাজনৈতিক চরিত্রটি কোনো না কোনো ভাবে এদের প্রশাসন পরিচালনায় এবং দল পরিচালনায় ছাপ ফেলেছে। তেমনভাবেইমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্রটিও তার প্রশাসন এবং পরিচালনায় ছাপ ফেলেছে। কাজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্রটি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলেই বোঝা যাবে শাসন ক্ষমতার মাত্র আট বছরেই সর্বত্র এইমাৎস্যন্যায়। পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস দলটির কোনো মহৎ রাজনৈতিক মতাদর্শ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে— এমনটা কেউই বলবেন না। বিরোধী থাকার সময় তার একটিই মাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। তা হলো—সিপিএম বিরোধিতা। শাসক হিসেবে তার বর্তমান রাজনৈতিক কর্মসূচি-বিরোধী নিধন। এর বাইরে তার কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ বা কর্মসূচির পরিচয় পায়নি দেশের মানুষ। এছাড়াও তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই নানাভাবে অসম্ভব রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সা তার ভিতর প্রকাশ পেয়েছে।রাজ্য কংগ্রেসের নেতৃত্ব দখলে ব্যর্থ হয়েই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসটি গঠন করেন। এবং গঠন করার মুহূর্ত থেকেই এই দলটির ভিতরে সবরকম গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে এটিকে তার স্বেচ্ছাচারিতায় চলা একটি সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। এই দলটিতে তার সমকক্ষ কেউ হয়ে উঠুন তা তিনি কখনই চাননি। যে কারণে, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মুকুল রায় প্রমুখ বহু নেতাই বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হয়েছেন তার কাছে। এর ভিতরে মুকুল রায়ের মতো কোনো কোনো নেতা তার সংশ্রব ত্যাগ করে দল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো কোনো কোনো নেতাতা পারেননি। তারা সমস্ত অপমান সহ্য করেই এই দলটিতে রয়ে গেছেন। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীনই নিজের দল পরিচালনায় যার ভিতর স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মাত্র তিনি যে নখ দাঁত বের করা স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠবেন—এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। কার্যত তিনি তাই হয়েছেনও। প্রথমাবধি মানসিকতার স্বৈরাচারী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম লগ্ন থেকে এই পর্যন্ত রাজনৈতিক আচরণ যদি ব্যাখ্যা করেন, তাহলে দেখবেন সেখানে ধ্বংসাত্মক এক ভুমিকাই প্রাধান্য পেয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম রাজনৈতিক প্রচারের আলোয় আসেন সত্তর দশকের মাঝামাঝি। তখন তিনি ছাত্র পরিষদের এক উঠতি কর্মী। ওই সময়ই কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলের সামনে জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির বনেটে উঠে নাচানাচি করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। ওই আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়েই প্রকাশ পেয়েছিল তিনি প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষিত কোনো রাজনৈতিক কর্মী নন। তিনি নিতান্তই একজন স্ট্রিট ফাইটার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢিল ছোঁড়া ব্যতীত যাঁর আর কোনো রাজনৈতিক গুরুত্বই নেই। বস্তুত তার তখনকার রাজনৈতিক দল কংগ্রেসও তাকে স্ট্রিট ফাইটার ব্যতীত অন্য কোনো গুরুত্ব দিত না। ১৯৮৪ সালে প্রবল ইন্দিরা হাওয়ায় যাদবপুর কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে রাজনৈতিক আঙিনায় নিজেকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন মমতা।
১৯৮৪ থেকে ২০১১–এই সময়কালটুকু ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিপিএম বিরোধিতার যুগ। এই সিপিএম বিরোধী আন্দোলনেই বারবার মমতার রাজনীতির নঞর্থক রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। এই পর্যায়ের সব আন্দোলন যে সব সময় যুক্তিপূর্ণ হয়েছে— তাও বলা যাবে না। বরং, অনেক আন্দোলনকেই তিনি ধ্বংসাত্মক রূপ দিয়েছেন, তার নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে। যেমন একুশে জুলাইয়ের আন্দোলন। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। এবং সেই অভিযান থেকে বিনা প্ররোচনায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মদন মিত্রের নেতৃত্বে একদল যুব কংগ্রেস কর্মী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পরিণতিতে পুলিশ গুলি চালায়। তার রাজনৈতিক ফায়দাটি লুটে। নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনই, নিছকই প্রচারের আলোয় থাকার উদ্দেশ্যে ফেলানি বসাকনাম্নী একমূক বধিরমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে মহাকরণে ধরনায় বসে পড়ার স্মৃতিও অনেকের মনে রয়েছে এখনও। রাজনৈতিক প্রয়োজন মিটে যাওয়ার পর আর ফেলানি বসাককে মনে রাখেননি মমতা। সিঙ্গুর আন্দোলন পর্বে বিধানসভায় ঢুকে ভাঙচুর চালানোতেও প্রমাণ হয়েছে তার নৈরাজ্যবাদী চরিত্রটি। নিছক নৈরাজ্যবাদই তার রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার বলেই তিনি এই রাজ্যের একজন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র হয়েও বলে উঠতে পারেন, “আমি গুন্ডা কন্ট্রোল করি।”নৈরাজ্যবাদী বলেই তিনি শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কলকাতার আয়কর দপ্তরে দলীয় কর্মীদের দিয়ে হামলা সংঘটিত করতে পারেন।
এইরকম একজন নৈরাজ্যবাদী যখন রাজ্যের শাসন ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার এই নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী মানসিকতারই প্রভাব প্রশাসন এবং দল পরিচালনায় পড়বে— সেটাই স্বাভাবিক। এবং সেই নৈরাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলনই তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার ছ’মাসের মধ্যে তিনি ভবানীপুর থানায় ছুটে গিয়েছিলেন সমাজবিরোধীদের। ছাড়াতে। সমাজবিরোধীদের ছাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী থানায় ছুটে যাওয়া ইতিপূর্বে কখনও দেখেনি কলকাতার মানুষ। তাঁর ওই আচরণই সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল তিনি আইনের শাসন চান না। আইনের শাসন যে তার না পসন্দ— এরপর যতদিন গিয়েছে, তা তাই প্রকট হয়েছে। রায়গঞ্জে তার দলের উচ্চুঙ্খল কর্মীদের হাতে কলেজের অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত হলে তিনি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।বরং, বাচ্চা ছেলে’বলে তাদের আড়াল করেছেন। পার্কস্ট্রিট কাণ্ডে তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিককে বদলি করে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, ন্যায়বিচার দেওয়ার । পক্ষপাতী তিনি নন। তারই শাসন আমলে অবাধ নির্বাচনী সন্ত্রাস এবংতাতে তার প্রত্যক্ষ মদত— প্রমাণ করে চূড়ান্ত দমনপীড়নের পথে পা বাড়াতে তিনি কুণ্ঠিত নন। তার এইসব কর্মকাণ্ড কোনোটাই গঠনমূলক নয়, সদর্থক তো নয়ই।
ফলত, সম্প্রতি নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যা ঘটছে—তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। গত আট বছর ধরে তিনি এইসব কাজেই ইন্ধন জুগিয়েছেন—তারইবিষময় রূপ এবার প্রকাশ পাচ্ছে। সম্প্রতি রেড রোডে ইদের নামাজে উপস্থিত থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন। তার পরই বসিরহাটের ঘটনা ঘটেছে। বসিরহাটের ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে কেউ যদি দায়ী থেকে থাকেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বসিরহাটের ঘটনায় যে মূল অভিযুক্ত সেই তৃণমূল নেতা শেখ সাজাহানকে তিনি গ্রেপ্তার করাননি। বরং শোনা যাচ্ছে, তাকে নিরাপদে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে পুলিশই। বোঝাই যায়, হামলাটি কার প্রশ্রয়ে, কার উস্কানিতে করা এবং কার রাজনৈতিক পরিকল্পনা মাফিক এই হামলার ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। বসিরহাটের ঘটনা মিটতে না মিটতেই এন আর এস হাসপাতালে ডাক্তারদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রীর কোনো সদর্থক ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়নি। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার বদলে আন্দোলনরত ডাক্তারদের হুমকি দিয়েছেন তিনি। তাদের বহিরাগত তকমা দিয়েছেন। ডাক্তাররা বেছে বেছে শুধু হিন্দুদেরই চিকিৎসা করেন’— এরকম অবমাননাসূচক উস্কানিমূলক কথাবার্তাও বলেছেন। ফলে, পরিস্থিতি আর জটিল হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যার সমাধান নয়, বরং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেওয়াটাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্য।
আর একটি ঘৃণ্য এবং প্ররোচনামূলক রাজনীতি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। রেড রোডে ইদের জমায়েত ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ধর্মীয় বিভাজন করেছেন। স্পষ্টতই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উস্কে দিয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরদ্ধে। পাশাপাশি বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি বিভাজনের রাজনীতিটিও করতে নেমেছেন নির্বাচনের পরে। প্রকাশ্যেই বলেছেন, আমাদের খাবে, আমাদের পরবে, আবার আমাদের বিরুদ্ধেই ভোট দেবেন। এ ধরনের বক্তব্য কার্যত দেশের অখণ্ডতা এবং ঐক্যের বিরোধী। মুখ্যমন্ত্রীর এই বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি যে পশ্চিমবঙ্গে বিষময় হতে বসেছে—এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, মুখ্যমন্ত্রী এই আচরণ করছেন কেন? একটু তলিয়ে দেখলেই বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর এই নৈরাজ্য। সৃষ্টির পিছনেও একটি রাজনৈতিক অপচেষ্টা আছে। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন এই রাজ্যটিকে সম্পূর্ণভাবে নৈরাজ্যের অন্ধকারে ঠেলে দিতে। যাতে, কেন্দ্র বাধ্য হয় এখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে। আর একবার যদি রাষ্ট্রপতিশাসন জারি হয় রাজ্যে, তাহলে শহিদ সেজে ঘোলা জলে আবার মাছ ধরতে নেমে পড়বেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, তার এই নােংরা রাজনৈতিক চালটি বিজেপি ধরে ফেলেছে। কাজেই বিজেপি এই রাজ্যে কখনই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছে না। বিজেপি জানে, জনরোষেই মমতার পতন হবে। ৩৫৬ ধারার প্রয়োজন হবে না। আর মমতা যেটা জানেন না, তা হলো— শেষের সে দিন ভয়ংকর।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-06-24