আইনি ব্যবস্থা যতটা ব্যর্থ হলে, আইনের প্রতি যতটা আস্থা হারালে, আইনি ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে যতটা বেপরোয়া হলে মানুষ আইন হাতে তুলে নেয়, ততটা ব্যর্থ ও অপদার্থ পরিস্থিতিই এখন পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গে অঙ্গে। না হলে বারবার রোগীর পরিবারের হাতে জুনিয়ার ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে কেন? কেনই বা রোগীর মৃত্যুর জন্য অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় প্রকৃত দোষী ডাক্তার বা নার্সরা নিরপেক্ষ তদন্তে শাস্তি পাচ্ছেন না? এর জন্য হসপিটাল বা রাজ্য প্রশাসনের দায় অনেক, কিন্তু স্বভাববশেই তাঁরা হয় উদাসীন থাকেন, নয় দায় ঝেড়ে নির্বিকার!
মূলত এঁদের অপদার্থতার জন্যই স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো জরুরি পরিষেবা দুদিন ধরে বন্ধ রইলো। এটা কোন সুস্থতার পরিচায়ক নয়, সভ্যতারও নয়। চন্দ্রিমার দৌত্যে কোন কাজ হয়নি, ভোগান্তিই সার। জট কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী এনআরএস-এ ছুটে এলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে জট কাটল না, অসন্তোষের আগুনও নিভল না। হুমকিতে হাওয়া গরম হল মাত্র। অসন্তুষ্ট জুনিয়ার ডাক্তারদের বহিরাগত বলে গেলেন, সেইসঙ্গে অস্বীকার করে গেলেন হামলার সত্যতাও। সরকারি হাসপাতাল থেকে পরিষেবা বঞ্চিত রোগীদের সরকারি খরচে বেসরকারী নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর হাস্যকর প্রস্তাবও রেখে গেলেন। এসব রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবার সঙ্গে তাঁর আন্তরিক যোগহীনতাকেই প্রমাণ করে। এবং দায়ী করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার আন্তরিক চেষ্টার অভাবের দায়ে।
জুনিয়ার ডাক্তার বা ডাক্তারদের ওপর যে হামলা হয়েছে সেটা যেমন ন্যক্কারজনক, নিন্দনীয় এবং ঘৃণ্য; ঠিক ততটাই নিন্দনীয় ও ন্যক্কারজনক সম্পূর্ণ চিকিৎসা পরিষেবাবন্ধের সিদ্ধান্ত। এদেশেই জন্ম হয়েছিল একটি প্রবাদের, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ এবং এদেশেই চালু আছে একটি প্রথার, ‘একের বাঁশ দশের পাছে’। এরই নাম হালে, প্রতিবাদ। একজনের রোষ দশজনের ওপর মেটাবো, দেখ শালা কেমন লাগে! সে প্রতিবাদ সরকারের বিরুদ্ধে হলেও বনধ-ধর্মঘট-চাক্কাজ্যামে পাবলিকের নাভিশ্বাস ওঠে, কয়েকজন পাবলিকের বিরুদ্ধে হলেও সমবেত পাবলিকের নাভিশ্বাস ওঠে। ধর্মঘটের সময় ধর্মঘটিরা কখনোই পাবলিক নয়, পাবলিকের কেউ নয়! হলে, পাবলিকের দুর্ভোগ হত না। ওই হামলাকারীরা ছাড়া রাজ্যশুদ্ধ রোগীদের কি দোষ? তাঁরা কেন জরুরি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন? প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানবতাটুকুও বিসর্জন দেব? ডাক্তারদের প্রতিবাদটা নিশ্চয়ই বাসসিন্ডিকেটের রাস্তায় হতে ওয়ারে না, তাই না? মরণমুখী রোগী যখন সুস্থ হবার আশ্বাস পেয়ে আপনাদের হাত ধরে বলে, ‘ডাক্তারবাবু, আপনার জন্যই বাঁচলাম এ যাত্রায়, আপনি ভগবান!’, কথাটা বলতে গিয়ে যখন তার চোখ জলে ভরে যায়, তখন আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি আসে না বলুন?
চৌত্রিশ বছরে বামফ্রন্ট না হয় কিছুই করেনি। কিন্তু এই ন বছরে আপনি কি করেছেন দিদি? আপামর সরকারি হসপিটালের রঙ, সিংদরোজা বানানো আর সুপারস্পেশ্যালিটি বোর্ড ঝোলানো ছাড়া। এখনো রোগীর জন্য পর্যাপ্ত বেডের ব্যবস্থা করা যায়নি, মেঝেয় করিডোরে পড়ে থাকার ট্র্যাডিশান রোখা যায়নি, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্সের ব্যবস্থা করা যায়নি, সরকারি টাকায় কেনা সমস্ত মেশিন মেইনটেইন করে পরিষেবায় লাগানোর ব্যবস্থা করা যায়নি, অধিকাংশ সময়ই তা নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, হসপিটালে কুকুরবিড়ালের উপদ্রব আটকানো যায়নি, আয়াদের দৌরাত্ম্য ও দালালদের উৎপাত ঠেকানো যায়নি, রোগীর খাবারে জালিয়াতি ঠেকানো যায়নি, সর্বোপরি রোগী ও ডাক্তারদের নিরাপত্তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাও করা যায়নি, এক শ্রেণির ডাক্তার ও নার্সের মধ্যে সেবার সংস্কৃতিও ফেরানো যায়নি। সেরকম ইচ্ছে থাকলে এই ন বছরে এগুলো সমাধান করা যেত না, এমন তো নয়। এই ব্যর্থতার দায় কার দিদিমণি? যে রাজ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সমানভাবে অবহেলিত, সে রাজ্যের কুশ ফলায় সাধ্য কার! সেখানে শুধু হাওয়া গরমের সংস্কৃতি, হাওয়া গরমই নিয়তি!