বিখ্যাত সাহিত্যিক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্পের নাম, ‘জাগ্রত দেবতা’। গল্পের স্থান, সনাতনপুর গ্রাম। সেই গ্রামে মহাদেবের মহিমায় প্রতিবছর গাজনের সময় কেউ না কেউ পাগল হবেই হবে–এমনটাই নিয়ম; বহুকাল ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। কিন্তু সে বছর গ্রামের লোক পড়ে গেল খুব মুশকিলে। কারণ, গাজন শুরু হয়ে গেছে, অথচ এদিকে তখনও অব্দি জানা গেল না এবার পাগল হয়েছে কে! এটাই মহাঅস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল গ্রামবাসীর কাছে! সব থেকে বেশি চিন্তিত হলেন গ্রামের প্রবীণ নীলমণি। পাগলটাকে খুঁজে বার না করা অব্দি তাঁর যেন কোন স্বস্তি নেই। তিনি চৈত্রের রোদ মাথায় নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ান গ্রামের রাস্তায় এবং বাড়ি বাড়ি, কেউ পাগল হল কিনা খুঁজে বার করতে। এই প্রখর রোদে পাগলের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে একসময় নীলমণির নাক ফুলে উঠল, চোখ জবা ফুলের মতো লাল হয়ে গেল এবং তিনি নিজেই পাগল হয়ে গেলেন। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সনাতনপুরের অধিবাসীরা। যাক, শেষ পর্যন্ত মহাদেবের মহিমায় পাগলটাকে তাহলে খুঁজে পাওয়া গেল!
আমাদের প্রিয় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা, শুধু পশ্চিমবঙ্গই বা কেন, ভারতবর্ষের অবস্থাটাই ওই গল্পের সনাতনপুরের মতো। সেই কবে থেকে আমরা একজন মনীষী বা মহীয়সীকে খুঁজে মরছিলাম, শুধু নীলমণির মতো চৈত্রে নয়, বৈশাখ থেকে চৈত্র বারোমাস ধরে, বহুবছর ধরে। যে বঙ্গভূমির সুজলাসুফলা কোলে চৈতন্যদেব, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীর জন্ম হয়েছে; মা সারদা, বেগম রোকেয়ার মতো মহিয়সীর জন্ম হয়েছে–সেই বঙ্গভূমি হঠাৎ বন্ধ্যা হয়ে গেলেন! এই সমস্ত মনীষী ও মহিয়সীর সবারই জন্ম স্বাধীনতার আগে; তাহলে স্বাধীনতার পর বঙ্গসহ সারাদেশের এই দুরবস্থা হল কী করে! পূর্ববর্তী মনীষীদের পাশে বসানোর মতো একালের তবে কি কেউ রইলেন না! আমরা ‘হায় হায়’ বলে বেজায় কান্না কাঁদতে যাবো, এমন সময় বঙ্গে তৃতীয়বার রেনেসাঁ হল–এলো পরিবর্তনের কাল, দু’হাজার এগারো সাল। তারপরই লেকটাউনের রাস্তায় ত্রিফলা ও একফলার গায়ে গায়ে দেখলাম হঠাৎ একদিন ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ছবির পর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ছবি; ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের ছবির পর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ছবি—এভাবে দু’তিন জন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী মনীষী ও মহিয়সীর ছবির গ্যাপে গ্যাপে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ছবি। সেদিন সনাতনপুরের বাসিন্দাদের মতোই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম; যাক একজন মহিয়সীকে এতদিনে আমরা পেলাম, যিনি এঁদের পাশে বসার যোগ্য! জয় গুরু! আসলে, মুখ্যমন্ত্রী তো আমাদেরই ‘লোক’; আমাদের সঙ্গে তিনিও হয়তো সেই যুগপুরুষ বা যুগমহিলার খোঁজ করছিলেন; খুঁজতে খুঁজতে মাথা গুলিয়ে… যাক সে কথা। ওসব দুর্জনের কথা কলমে আনতে নেই! তবে লেকটাউন থেকে যে সংস্কৃতির শুরু হয়েছিল, তারই শেষতম সংযোজন ছিল ‘ফেমাস বেঙ্গলি লেজেন্ডস’। এই ছবিতে স্পষ্টই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে শেষতম তীর্থঙ্করের মতো বাংলার শেষতম মহিয়সী কে। তবে এই ছবিটির বিশেষত্ব হল, এতে অনুপ্রেরণাদাত্রীর নামধাম নেই। এযাবৎ কালে যা রেয়ার!
আমাদের মধ্যেই কেউ বলবেন, ভাই, এসব তো পুরোনো খবর; এসব আমরা সয়েবয়ে নিয়েছি–ওসবে কিচ্ছু হয় না। নেতাজীর জন্মদিনে, নজরুলের জন্মদিনে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁদের ছবি কি আমরা সরকারি হোর্ডিং-এ দেখতে পাই? দেখি তো আমরা দিদিকে; আর তাতেই বুঝি বিরাট কিছু একটা হতে চলেছে। এই যে দৃষ্টিভঙ্গির একটা ব্যাপক পরিবর্তন—বলুন তো এটা বাংলার বিরাট একটা অ্যাচিভমেন্ট নয়? আর তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নোবেল এনে বাংলাসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন, দিদি কন্যাশ্রীর পুরস্কার এনে গোটা বাংলাকেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন! তাঁর দৌলতে বাংলা এখন শুধু বাংলা নয়, ‘বিশ্ববাংলা’। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-র যদি ইংরেজি থেকে থাকে, দিদিরও আছে ‘কথাঞ্জলি’র ইংরেজি। রবীন্দ্রনাথ স্কুলপাঠ্যে আছেন, দিদিও আছেন। রবীন্দ্রনাথ গান-গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস-ছড়া লিখেছেন, সুর দিয়েছেন; দিদিও তাই। শুধু নাটকটা লেখেননি এখনও। কিন্তু সেটা তো লেজেন্ড হওয়ার বাধা হতে পারে না। তাই না? সে তো রবীন্দ্রনাথও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। তার বেলা?
আমি বলব, বটেই তো, বটেই তো! তবে কিনা, মিডিয়া যা ভুলে যায়, তাই নিয়েই উড়াইয়া দেখ ছাই আমার কাজ তো, সেজন্যেই আর কি…হেঁ হেঁ…বলেই আমার বেড়ালে গোঁফে আর ছাগুলে দাড়িতে মিনিট দুয়েক তা দেব!
আমাদের মধ্যেই কেউ বলে চলবেন, পশ্চিমবঙ্গে ছবি-কালচার এই লেভেলের ক্রিয়েটিভিটিতে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব কার? অবশ্যই বর্তমান বঙ্গসরকারের, ঠিক কিনা! সেই ছবির ওপর আবার কিনা অনীক দত্ত খোদকারি করতে গিয়েছিলেন, দিয়েছি কড়কে! সেই ছবি নিয়ে কিনা ফাজলামো করতে গিয়েছিলেন অম্বিকেশ, দিয়েছি কড়কে! আঁকা ছবি নিয়ে বেশি ভ্যানতাড়ামো করতে এলে না…।
আমার আবার সম্বল বেড়ালে গোঁফ আর ছাগুলে দাড়ি। সেগুলো এই মুহূর্তে আবার একটু কম পয়সার কম্বলের মতো কুটকুট করছিল, বেশ করে চুলকে বললাম, সে আর বলতে! তবে একটাই দুখ্যু বুঝলেন দাদা, সুচিত্রা সেনকে ভোটে নামানো কি ঠিক হল? না মানে, যিনি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারপ্রস্তাবে নির্দ্বিধায় না করেছেন, যিনি এত বছর ধরে লোকের সামনে বেরুলেন না, আজ মৃত্যুর পর সেই তিনিই পাড়ায় পাড়ায় মেয়ের জন্য ভোট চাইবেন, এটা কি ভালো দেখায়?
আমাদের মধ্যেই কেউ অবাক হয়ে বলবেন, মানে?
আমি বলব, ওই যে পোর্টালের খবরে দেখলাম, আসানসোলে মুনমুন সেনের নির্বাচনী পোস্টারে সুচিত্রা সেনের ছবিতে ছয়লাপ, তাতে তো দিদির জায়গা হওয়াই দায় হয়ে উঠেছে! এটা কি ঠিক হল?
এবার আমাদের মধ্যেই কারুর একটু রাগ হবে, এই ঠিক বেঠিক বলার তুই কে রে? আমরা জোর করে কিছু দিলেও কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে ছাড়ি! এই যে এসএসসি চাকরির জন্য ছেলেমেয়েগুলো আঠাশ দিন অনশন করলেন, তাতে কীই বা এসে গেল! এর চেয়ে ওঁরা যদি ওখানেই দিদির ছবির প্রদর্শনী করতেন আঠাশ দিন ধরে, তাহলেই দেখতে জয়েনিং লেটার হাতে হাতে, সঙ্গে এক বছরের ডিএ আগাম! ঠিক কিনা?
আমি বঙ্গের বুদ্ধিজীবী। আমার শুরুটা জঙ্গিপনায়, শেষ জাহাঁপনায়! আমার সম্বল বেড়ালে গোঁফ আর ছাগুলে দাড়ি এবং ভোঁতা কলম। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলব, ঠিক, ঠিক, ঠিক!