কালীপুজোর আনন্দে মাতোয়ারা ভুবন। মহানগরের পাশাপাশি মায়ের আরাধনায় পিছিয়ে নেই জেলার পুজোগুলিও। বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি মালদহ জেলার কালীপুজো মানেই রতুয়ার গোবরজনা। ভক্ত সমাগমে জেলার শীর্ষে গোবরজনা কালীমন্দির।
অনেকেই বলে থাকেন, ‘রাজপুত্রদের এই কালীপুজোয় দেবী চৌধুরানির জনশ্রুতির ছোঁয়া রয়েছে’। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানির জনশ্রুতির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া রতুয়ার গোবরজনা গ্রামে এই কালীপুজো ঘিরে ফি বছর হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। কালীমন্দিরের সামনে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না বলে জানা গিয়েছে।
ফলে মালদহ জেলার সবচেয়ে বড়ো কালীপুজো বলে এটিকেই গন্য করা হয়।
শুধু তাই নয়, এখানকার কালীপুজো উপলক্ষ্যে মালদহ শহর ছাড়াও, পাশের সীমান্তবর্তী রাজ্য বিহার—ঝাড়খণ্ড থেকেও মায়ের টানে ভক্তরা ছুটে আসেন। পাঁঠাবলির জন্যও নামডাক রয়েছে এখানকার। জনশ্রুতি আছে, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে অন্তত ৫০ হাজার পাঁঠাবলি দেওয়া হত এই গোবরজনায়। জানা গিয়েছে, মন্দির থেকে বলির রক্তের স্রোত গিয়ে মিশবে মরা কালিন্দী নদীর জলে, তারপরই নাকি ‘তুষ্ট’ হবেন মা কালী। এমনই বিশ্বাস ছিল ভক্তদের।
সূত্রের খবর, কালী পুজোর পাশাপাশি এই গোবরজনার গ্রামজুড়ে বসে মেলাও। এবারও জোর প্রস্তুতি চলছে তার। যাবতীয় পসরা নিয়ে চতুর্দশীর দিন থেকেই হাজির হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। গ্রামজুড়ে সারি সারি অস্থায়ী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, লুচি—তরকারি, জিলিপি, রোল, মোগলাই, ফুচকার পাশাপাশি প্রসাধনীর দোকানগুলিও বসতে শুরু করেছে। বসছে বিনোদনের জন্য নাগরদোলাও। শক্তির আরাধনার সঙ্গে উৎসবের এই বিশাল আয়োজন প্রত্যেক বছরই নজর কাড়ে জেলাবাসীর।
মালদহ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে রতুয়া—২ নম্বর ব্লকের আড়াইডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই গোবরজনা গ্রাম। একটা সময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল গোটা এলাকা। পাশ দিয়ে এখনও বইছে মরা কালিন্দী নদী। জনশ্রুতি আছে, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরানি উপন্যাসের নায়ক ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানি উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পথে কালিন্দী নদীর তীরে এই গোবরজনায় রাতযাপন করেছিলেন। তাঁদের বজরাটি নদীর পাড়ে আটকে গিয়েছিল। বজরা চলছিল না কিছুতেই। তারপর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মায়ের মূর্তি গড়ে এখানেই পুজো করেছিলেন ভবানী পাঠক। তারপর বজরা চলতে শুরু করেছিল।
এই জনশ্রুতি আবার অনেকে মানতে চান না। তাঁদের দাবি, ভবানী পাঠক আসার অনেক আগে থেকেই পুজো হয়ে আসছে। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন এই রতুয়ার গোবরজনা কালী মন্দিরের পুজো। তখন গোবরজনা সহ সংলগ্ন জঙ্গলে ঘেরা গ্রামগুলিতে রাজপুত্রদের বাস ছিল। সেই রাজপুত্ররাই ঘন জঙ্গলে মন্দির স্থাপন করে কালীপুজো শুরু করেছিলেন।
রাজপুত্রদের প্রবর্তিত এই পুজোর দায়িত্বে এখন রয়েছেন গোবরজনা গ্রামেরই চৌধুরী পরিবার। পুজোয় নিয়ম মেনে এখনও বলি প্রথা চালু রয়েছে। মা এখানে ভয়ঙ্করী। আগে পুজোর দিন মোষ বলি দেওয়া হত, এখন কালীপুজোর দিনের পরিবর্তে বৈশাখ মাসে মোষ বলি দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এই কালীপুজোকে দস্যুদের সৃষ্টি বলে মনে করেন। কালিন্দী নদী ছিল গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর সঙ্গে যুক্ত। বজরা চলাচল করত এই পথে। প্রবীণদের অনেকেরই বিশ্বাস, একটা সময় আড়াইডাঙ্গার সমগ্র এলাকা ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। হিংস্র পশুও বসবাস করত। বিহার থেকে একদল ডাকাত নদীপথে এসে এই জায়গায় বসবাস শুরু করে। জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিল তারা। জলপথে ঘুরে ঘুরে তারা ডাকাতি করত আর সাফল্যের পর এখানে মায়ের পুজো করত।
তবু মালদহের রতুয়ার ৩৫০ বছরের পুরনো গোবরজনা কালীমাতা ঠাকুরানির পুজোর সঙ্গে আজও জড়িয়ে রয়েছে দেবী চৌধুরানির নাম। এই পুজোকে আজও দেবী চৌধুরানির প্রবর্তিত পুজো বলেই মনে করেন স্থানীয়দের পাশাপাশি জেলার বহু বাসিন্দাই। দস্যুরা এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পর স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্থানীয় চৌধুরী পরিবার ওই পুজো শুরু করেন। কিন্তু পারিবারিক হলেও এই পুজো সার্বজনীনতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ।
কালিন্দী নদীর পাড়ে আমবাগান ঘেরা গোবরজনা মন্দির এলাকায় এখনও তেমন জনবসতি নেই। পাকা রাস্তা থেকে এক কিলোমিটার হেঁটে মন্দিরে পৌঁছতে হয়। আর দেবী প্রতিমা গড়া হয় দেড় কিলোমিটার দূরে চৌধুরী বাড়িতে। রীতি মেনে পুজোর সন্ধ্যায় আজও শূন্যে গুলি ছুঁড়ে দেবীকে নিয়ে মন্দিরের উদ্দেশে শোভাযাত্রা বের হয়। গোবরজনার কালীমাতা এলাকায় জাগ্রত দেবী হিসেবেই পরিচিত। তাই তার কাছে মনস্কামনা পূরণের আশায় হাজির হন দর্শনার্থীরা। এবারও ঐতিহ্যবাহী এই গোবরজনায় ঢল নামবে ভক্তদের আশাবাদী পুজোর উদ্যোক্তারা ।