“যশোর-নগর ধাম, প্রতাপ আদিত্য নাম,
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়, কেহ নাহি আঁটে তায়,
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।।
বরপুত্র ভবানীর, প্রিয়তম পৃথিবীর,
বায়ান্ন হাজার যার ঢালী।
ষোড়শ হলকা হাতি, অযুত তুরঙ্গ সাতি,
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।।”
বিদ্যাসুন্দর কাব্যের সূচনায় এভাবেই বঙ্গবীর প্রতাপ আদিত্যের পরিচয় করিয়েছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। চিতোরের মহারাণা প্রতাপ, বা মহারাষ্ট্রের শিবাজী মহারাজের মতই বঙ্গের প্রতাপাদিত্যের কথা লিখিত থাকার কথা স্বর্ণাক্ষরে, বাঙালির মননে। কিন্তু ইতিহাস লিখিত হয়েছে বিজেতাদের দ্বারা, তাই বিজিত প্রতাপাদিত্য সেই সম্মান হয়তো পাননি আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু বৈদেশিক শাসনমুক্ত বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন তাঁর স্বজাতিকে, যে স্ফুলিঙ্গ বারবার ছাই চাপা পড়া সত্ত্বেও এখনো সম্পূর্ণ নির্বাপিত নয়।
বঙ্গে প্রথম দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে মুসলমান আক্রমণের মাধ্যমে পাঠান রাজত্বের সূচনা হলেও তা ছিল নগণ্য অংশে। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে আকবর কর্তৃক মোগল শাসন অবধি ছিল পাঠান শাসনের কাল, কিন্তু সেই শাসনভার বদলের মাঝেও অনেক ঘটনা ঘটে যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই তেমন অবগত নই। বাংলার বারো ভুঞাদের বীরত্বের কথা এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দ্বাদশ ভুঞা কারা সে নিয়ে নানাত মত থাকলেও, প্রতাপ আদিত্য প্রায় সকলের মতেই এঁদের মধ্যে অন্যতম।
আদিশূরের সময়ে আগত পঞ্চকায়স্থের মধ্যে বিরাট গুহ হলেন একজন। মহারাজা প্রতাপ আদিত্য এঁরই বংশধর।শ্রীহরি এবং তাঁর ভ্রাতা জানকীবল্লভ যশোরের রাজত্ব শুরু করেন। এঁরা দুইজন পরবর্তীতে বিক্রমাদিত্য এবং বসন্ত রায় নামে খ্যাত হন। প্রতাপ আদিত্য বিক্রমাদিত্যের পুত্র। বৈষ্ণব পরিবারের ধারা অনুযায়ী তাঁর পূর্বনাম ছিল গোপীনাথ। তাঁর পিতার মহারাজ এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি লাভের পরে তিনি যুবরাজ প্রতাপাদিত্য হিসাবে পরিচিত হন। প্রতাপের জন্মদাত্রী তাঁর জন্মের কয়েকদিন পরেই মারা যান। প্রতাপ মানুষ হন বসন্ত রায়ের এক পত্নীর কাছে, যিনি অপুত্রক ছিলেন। তাঁর খুল্লতাত বসন্ত রায় তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন, এবং প্রতাপের শিক্ষা ইত্যাদির বিষয়ে তিনি বিশেষ মনোযোগপরায়ণ ছিলেন। বসন্ত রায় নিজেও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন, এবং প্রতাপের শাস্ত্রের পাশাপাশি শস্ত্রের শিক্ষার ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট মনযোগী ছিলেন। প্রতাপ অল্পদিনেই সংস্কৃত, ফার্সি এবং বাংলা শিক্ষায় সুদক্ষ হয়ে ওঠেন। প্রতাপ রাজোচিত বিশাল বপুর অধিকারী ছিলেন। মল্লযুদ্ধ, তীরন্দাজী এবং অসি সঞ্চালনে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
প্রতাপের দুই অভিন্নহৃদয় সহচর এইসময় থেকেই তাঁর সাথে ছিল। একজন কায়স্থবংশীয় সূর্যকান্ত গুহ, এবং অন্যজন ব্রাহ্মণবংশীয় শঙ্কর চক্রবর্তী। এঁদের সাথে প্রতাপ প্রায়শই মৃগয়া ইত্যাদিতে সময় অতিবাহিত করতেন। রাজকার্যের মতই অত্যন্ত অল্প বয়সেই প্রতাপের বিবাহের আয়োজন হয়। প্রতাপ তিনবার দার পরিগ্রহ করেন। তাঁর পাটরানি ছিলেন জিতামিত্র নাগের কন্যা শরৎকুমারী। এর পরে রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতাপ কিছু সময়ের জন্য উত্তর ভারতে প্রেরিত হন। সেইখানে অবস্থানের সময় তিনি জানতে পারেন মহারাণা প্রতাপসিংহের কথা। তিনি নিজে চিতোর দর্শন করেও আসেন, যা তাঁর মনের ভিতরের স্বাধীনচেতা সত্ত্বাকে সম্ভবত আলোড়িত করে। এছাড়া, বিভিন্ন রাজপুত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মোগল রীতি, এবং খোশরোজের দিন হিন্দু নারীদের উপর অত্যাচারের কথা হিন্দুদের মনে মোগলদের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়, যার প্রভাব হয়তো প্রতাপের উপরেও পড়ে।
রাজধানী থেকে যশোরে ফেরার কিছুদিন পরে মহারাজা বিক্রমাদিত্যের জীবনাবসান হয়, এবং প্রতাপের অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। এর অনতিবিলম্ব পরেই মা যশোরেশ্বরীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়, এবং প্রতাপ মায়ের মন্দির নির্মাণ করলেন। সাথে সাথে তিনি রাজগুরু পণ্ডিত কমলনয়ন তর্কপঞ্চাননের কাছে শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। ইতিপূর্বে প্রতাপ ছিলেন বৈষ্ণব। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসের প্রতি তিনি ভক্তিমান ছিলেন, এবং তাঁর সাথে তাঁর আলাপও ছিল। যশোরের রাজসভায় গোবিন্দদাস এসেছিলেন। শাক্তমন্ত্রে দীক্ষার পরে প্রতাপ তন্ত্রের চর্চাও আরম্ভ করেন। এছাড়া প্রতাপ কাশীতে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরের কাছের গঙ্গার ঘাট পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দেন। শুধু শাক্ত মন্দিরই নয়, গোপালপুরের গোবিন্দদেব মন্দির, যা বেদকাশীর শিবমন্দিরও প্রতাপের সাহায্যে নির্মিত। হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রতাপের ছিল আস্থা, এবং তিনি বিশ্বাস করতেন মা যশোরেশ্বরীর অধিষ্ঠানকালে ঈশ্বর তাঁর সমস্ত কাজে সহায় হবেন। প্রতাপের উৎকলবিজয় তাঁর এই বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে। প্রতাপ ক্রমশ তাঁর সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী এবং পরাক্রমশালী করতে থাকেন। প্রতাপ খুবই প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন, এবং মগ পর্তুগিজ ইত্যাদি দস্যুদের অত্যাচার তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিরোধ করেন। তিনি দানবীর হিসাবেও খ্যাত ছিলেন, এবং কল্পতরু হয়েছিলেন।অসংখ্য পণ্ডিত তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন, এবং তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। তাঁর গুণকীর্তন স্বরূপ অসংখ্য কাব্যেরও নিদর্শন পাই আমরা।
মোগলদের বিরুদ্ধে বাঙালি প্রতাপের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে রচিত থাকবে। প্রতাপের পথ তেমন সোজা ছিল না। তবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথেই তাঁর যুদ্ধের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। রাজধানী ধুমঘাটের দুর্গ ছাড়াও তাঁর আরো ১৩টি প্রধান দুর্গ ছিল। এর বাইরেও তাঁর অসংখ্য দুর্গ ছিল, যার মধ্যে কলকাতার সন্নিকটেই ছিল ৭টি। প্রতাপের নৌবহরও ছিল সুবিস্তৃত। তাঁর নৌবহরের কোন কোন নৌকায় ৬৪টি বা তার অধিক দাঁড় ছিল, এবং অবশ্যই অনেক নৌকায় কামান থাকত। প্রতাপের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ধরণের সৈন্য ছিল, যথা ঢালী, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, নৌসেনা, গুপ্তসৈন্য, রক্ষীসৈন্য, হস্তিসেনা।তাঁর সেনাবাহিনীতে বাঙালি রায়বেঁশে, ঢালী ইত্যাদি সেনা ছাড়াও ছিল কুকি, পাঠান, পর্তুগিজ ইত্যাদি সেনা। প্রতাপের যুদ্ধজ্ঞানে পারদর্শিতা প্রদর্শিত হয় তাঁর এই দুর্গ গঠন, তাদের স্থান নির্বাচন এবং সৈন্যগঠনের রীতির মধ্যে দিয়ে। যদি মোগলদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করতেন তাহলে হয়তো তাঁর ইতিহাস বাঙালি অন্যরূপে জানত। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি, কিছুটা হয়তো বাঙালি মানসিকতার জন্যই। প্রতাপের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র রচনা, এবং তাঁর শত্রুদের নানারূপে সাহায্য করেছিলেন বহু বাঙালিই। পরবর্তীতে তারা নানাভাবে অনুগ্রহ পান মোগল রাজাদের থেকে, এবং বাংলার ইতিহাসে এদের অনেকের পরিবারই পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই সময়ে নিজেদের স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সমগ্র জাতির পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতাপের সাহায্যে নামলে বাঙালিজাতির দুর্দশা হয়তো বা মোচন হত। বিশেষ করে সেই সময়ের বাংলার জাতিভিত্তিক অবস্থা বর্তমান, বা প্রাক দেশভাগের সময়ের অবস্থার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল স্বাভাবিকভাবেই। হয়তো সম্পূর্ণ বঙ্গদেশই বাঙালির নিয়ন্ত্রণে থাকত এই সময় পর্যন্তই।
রাজা মানসিংহ ছিলেন বঙ্গদেশের দায়িত্বে, মোগলদের তরফে। তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য শের খাঁকে রাজমহলে দায়িত্ব দিয়ে যান। সেই সময় শঙ্কর চক্রবর্তী প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মোগলদের যুদ্ধসরঞ্জাম বোঝার জন্য সেখানে উপস্থিত হন। শের খাঁ শঙ্করকে বন্দী করে, যদিও শঙ্কর সহজেই সেখান থেকে মুক্ত হন। এর ফলে প্রতাপ আক্রমণ করেন মোগলদের প্রথমবারের মত এবং সেই রণে বিজয়ী হন। কিন্তু এরপরে মানসিংহের সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। মানসিংহ তাঁর কূটবুদ্ধি এবং দক্ষতা, এই দুইয়ের বলে প্রতাপকে অনেকটা দুর্বল করেন। যদিও যুদ্ধ হয়েছিল ভীষণ আকারে, যা বেশ কিছুদিন যাবত চলেছিল। কথিত আছে যে প্রথমে দুইদিন মানসিংহ পরাজিত হন, এবং শেষদিন জয়ী হয়ে প্রতাপকে বন্দী করেন। তবে এই যুদ্ধ প্রতাপের শেষ যুদ্ধ নয়। তাঁর শেষ যুদ্ধ ইসলাম খাঁর সাথে, যেখানে তাঁর পতন ও মৃত্যু হয়। তবে তাঁর বিপ্লবর স্ফুলিঙ্গ কখনো নির্বাপিত হয়নি, যা তিনি বাঙালির মননে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন। প্রতাপ এবং তৎপুত্র উদয়াদিত্যের বীরগাথা, এবং মাতৃভূমির জন্য প্রাণত্যাগ আমাদের জাতীকে চিরকাল উদ্বুদ্ধ করবে।