বাঙালির বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হল, বাঙালি কাঁকড়ার জাত। এই জাতির মধ্যে কোন একতা নেই। কোন বাঙালি আক্রান্ত হলে, তার পাশে দাঁড়ানোর মত আরেকটা বাঙালি পাওয়া যায় না। ভ্রাতৃত্ববোধ জিনিসটার বড় অভাব আমাদের মধ্যে। এগুলো খুব নির্মম সত্য। কিন্তু এর একটাও বাঙালির রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। আমাদের আসল রোগ হল, আমাদের এমন কিছু নেই, যেটা দিয়ে গোটা জাতিটাকে একই সুতোয় বেঁধে রাখা যায়। “আমাদের রবীন্দ্রনাথ”, “আমাদের নেতাজি”, “আমাদের বিবেকানন্দ” বলে বাঙালিরা গর্ব করেন ঠিকই। কিন্তু ওগুলো তো নেতাজি-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের ব্যক্তিগত সাফল্য। এতে জাতির কৃতিত্ব কোথায়? তাছাড়া, কোন ব্যক্তি যত মহানই হোন না কেন, এত বড় একটা জাতিকে ধরে রাখতে তা যথেষ্ট নয়। 

এখানে অনেকে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ নিয়ে আসেন। বাঙালিরা সর্বত্রই দুর্গা পূজা করেন। অতএব “আমাদের দুর্গাপূজা”-ই সমস্ত বাঙালিকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে। বিশ্বাস খুব শক্তিশালী বাঁধন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাঙালির বিশ্বাস যেটুকু রয়েছে, সেটা হল ঠাকুরে বিশ্বাস। ধর্ম বিশ্বাস আর ঈশ্বরে বিশ্বাসের মধ্যে খুব স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাস জাতিকে একত্রিত করতে পারে, যেটা শুধুমাত্র ঠাকুরে বিশ্বাস দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ  ঠাকুরে বিশ্বাস নিতান্তই ব্যক্তিগত আচরণ কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস জাতিগত চর্চার বিষয়। 
অনেকে মনে করেন, জাতি হিসেবে সাফল্য পেলেই বাঙালির সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিগত সাফল্যের উদাহরণ কি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা সাফল্যের নাম। এই সাফল্যের ভাগ সবাই পেতে চায়। তাই “আমেরিকান” হবার জন্য আপাততঃ সকলেই উদ্যোগী। কিন্তু সুদিন তো কারও চিরকাল থাকে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যতদিন গোটা বিশ্বের উপর ব্রিটিশরা ছড়ি ঘুরিয়েছে, গ্রেট ব্রিটেনে কোন সমস্যা ছিল না। যবে থেকে ব্রিটেনের পতন শুরু, তবে থেকেই স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ডে আবার মাথা চাড়া দিতে লাগল বিচ্ছিন্নতাবাদ। সমষ্টির লাভ যতদিন, জাতিগত সাফল্য-এর বাঁধনও ঠিক ততদিন।

এই সত্যটাকে উপলব্ধি করেই, একদম অন্য রাস্তায় হেঁটেছিলেন ইহুদি এবং আর্মানী-রা। তাঁরা বুঝেছিলেন, সাফল্যের থেকেও জাতিকে চিরস্থায়ী বাঁধনে বাঁধতে পারে ব্যর্থতার ইতিহাস। কারণ ব্যর্থতা একটা দগদগে ঘায়ের মত। তার ক্ষত টিকিয়ে রাখা যায় বহুদিন। জাতিগত ব্যর্থতা দিয়ে কিভাবে একটা জাতিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে হয়, সেটাকে পুরো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ইহুদি এবং আর্মানী-রা। 

বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদি জাতিকে ধরে রেখেছিল তাদের বিতাড়নের ইতিহাস, সমবেত গণহত্যার ইতিহাস। যে যেখানেই থাকুন, বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিনে ইহুদীরা নিজেদের ধর্মীয় মন্দিরে মিলিত হয়ে স্মরণ করতেন, নিজভূমে কচুকাটা হবার পুরোনো ইতিহাস। আশা রাখতেন, ইহুদি বাসভূমি ইজরায়েল পুনরুদ্ধার করবেন কোন একদিন। 
সেই সুযোগ এনে দিল আরেক গণহত্যা। জার্মানিতে ইহুদি গণহত্যার উপর ভর দিয়েই বিশ্বজুড়ে একটা ইহুদি শক্তিকেন্দ্র গড়ে ওঠে। জার্মানির গণহত্যাকে “জার্মানির ইহুদিদের ব্যর্থতা” বা “জার্মান ইহুদিদের কাপুরুষতা” বলে দায় এড়ানোই যেত। কিন্তু এই বিরাট মাপের গণহত্যাকে ইহুদীরা প্রচারের আলোয় এনেছেন, প্রতিটা ঘটনাকে খুঁজে খুঁজে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই গণহত্যা যেন শুধু একটা সংখ্যা হিসেবে মানুষের মনে থেকে না যায়। অত্যাচারের প্রতিটা অভিজ্ঞতা যেন আলাদা আলাদা ভাবে মানুষের হৃদয়কে বিদ্ধ করে। কারণ একটি ছোট ইহুদি শিশুর অভিজ্ঞতা আর একজন ইহুদি বৃদ্ধের অভিজ্ঞতা আলাদা। পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে চাওয়া ইহুদি পিতা আর নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ইহুদি মায়েদের অভিজ্ঞতা আলাদা। ছবিতে, ভিডিওতে, সিনেমায়, গল্পে তারা এই প্রত্যেক রকম অভিজ্ঞতার সার্থক প্রকাশ করেছেন। যাতে এই গণহত্যার স্মৃতি কোনোদিনও ইহুদিদের মন থেকে মুছে না যায়। সাফল্য তো যাবে-আসবে; কিন্তু ব্যর্থতাগুলো ভয় পাওয়াবে। একত্রিত থাকার প্রয়োজন বোঝাবে। গণহত্যার শোক জাতিকে ধরে রাখবে। 

এই একই অভিজ্ঞতা আর্মানী-দের ও রয়েছে। তুর্কী বাহিনী যখন আর্মেনিয়ার দখল নিয়ে লাখে লাখে আর্মানী-দের খুন করছে, বাকি খ্রিস্টান জগৎ তখন সম্পুর্ন নীরব। আর্মানী-রা খ্রিস্টান ঐক্যের দোহাই দিয়ে ইউরোপের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে, মাথা ঠুকেছে, কিন্তু কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। অবশেষে আর্মানী-রা বুঝেছিল অন্য খ্রিস্টানদের সাথে তাদের তফাৎ-টা ঠিক কোথায়। ২৫ শে ডিসেম্বরের জায়গায় আর্মানী-রা যীশুর জন্মদিন পালন করে ৬ই জানুয়ারি। সিজারিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে মান্য করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। তাই অন্যদের চোখে আর্মানী-রা “সহি খ্রিস্টান” না। ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হলেও, জাতিগত কারণে অন্য খ্রিস্টানদের কাছে অবহেলিত। তাই গণহত্যা দিয়েই আর্মানী-রা বানিয়ে নিয়েছিল তাদের জাতীয় পরিচয়ের সঠিক সংজ্ঞা। আর্মানী কে? যিনি আর্মানী গির্জার সভ্য, শুধুমাত্র সে।  যারা আর্মানী গির্জার সভ্য নন, তারা আর্মেনিয়ার কেউ নন।  জাতিগত ব্যর্থতার চরম নিদর্শন গণহত্যাকে যিনি নিজের স্মৃতি ও চেতনায় ধারণ করেন না, তিনি সেই জাতির মানুষ হতে পারেন না।

গণহত্যা স্মরণ জাতিকে শিকড়ে ফেরায়, শত্রু চেনায়। শত্রু যখন দিকে দিকে, তখনই জাতি ঠেকে শেখে। বাঙালির ইতিহাস গণহত্যার ইতিহাস। ৮০০ বছর আগে বখতিয়ার খলজি দিয়ে যার সূচনা। তারপর তুর্কি, বর্গী, মগ, মোগল, আফগান, পাঠান সকলের তরোয়ালে রক্তাক্ত হয়েছে এই জাতি। পর্তুগীজ জাহাজে বন্দি ক্রীতদাস হয়ে বিক্রি হয়েছে ইউরোপের হাটে-বাজারে। এদেশে ইংরেজ রাজত্বের শুরু এবং শেষ, দুটোই বাঙালিকে শুকিয়ে মেরে। ইংরেজ সৃষ্ট দু-দুটো মহা দুর্ভিক্ষে কোটির উপর বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরেও ভারতে বাঙালি মরেছে, কাতারে কাতারে মরেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালি-বিরোধী গণহত্যা হয়েছে প্রায় এক ডজন। খোদ পশ্চিমবঙ্গেই বাঙালি মার খাচ্ছে রোজ রোজ। উত্তরে দার্জিলিং থেকে শুরু করে, দক্ষিণে সন্দেশখালী-দেগঙ্গা-ক্যানিং; নিস্তার নেই কোনখানে। এই ইতিহাস আমরা লুকিয়ে রেখেছি, প্রকাশ করতে লজ্জা পেয়েছি। যতবার আমরা এর থেকে পালাতে চেয়েছি, তত বার উপহার পেয়েছি আরো একটি গণহত্যা। 

আমরা কোথাও সুরক্ষিত নই। বাংলাদেশে যে বীভৎস গণহত্যা আমাদের উপর চালানো হয়েছে, তার কোন বিচার আজো হয়নি। সেই গণহত্যা এখনো চলছে। কোনোরকমে বেঁচে থাকা দেড় কোটি বাঙালি সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না। ভারতেও আমরা লাঞ্ছিত, আশ্রয়হীন। আর্মানীদের মত বাঙালিরাও ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং জাতিগত বিদ্বেষের একত্রে শিকার। এর সুষ্ঠু সুরাহা করতে আমরা অপারগ। জাতি হিসাবে আমরা চূড়ান্ত ব্যর্থ। কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিলে, সাফল্য চিরকাল অধরাই রয়ে যাবে। বাঙালিকে ফেরাতে হবে, এই গণহত্যার স্মৃতি। যত বেশি চর্চা হবে বাঙালি বিরোধী গণহত্যার, তত তাড়াতাড়ি আমরা শত্রু চিনতে শিখব। একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করব। জাতি হিসেবে সাফল্য যখন দুর্লভ, জাতিগত ব্যর্থতা-ই তখন জাতি গঠনের একমাত্র অনুপ্রেরণা।  

অতএব এবারের মহালয়া হোক গণহত্যা স্মরণের উৎসব। স্বর্গীয় পূর্বপুরুষ-দের স্মৃতি তর্পণ-এর পাশাপাশি তর্পণ হোক জাতির নিহতদের নামে। গণহত্যায় নিহত সমস্ত বাঙালির আত্মার শান্তি কামনা দিয়েই শুরু হোক আমাদের দেবীপক্ষ। তবে শুধু তর্পণ নয়, গণহত্যা স্মরণ জারি থাকুক আমাদের পুজোর অঞ্জলিতে, কালীপূজার প্রদীপে, লক্ষ্মীর পাঁচালিতে, সংক্রান্তির আল্পনায়। গণহত্যা নিবারণের প্রথম ধাপ, অতীতের গণহত্যা স্মরণ। আমাদের ভবিষ্যতের একমাত্র হাতিয়ার, মুক্তকণ্ঠে গণহত্যা স্বীকার। 

সমস্ত বাঙালি হিন্দুর উদ্দেশ্যে আবেদন, আপনারা তর্পণ শেষে #TarpanForBengaliHinduGenocide লেখা ব্যানার হাতে সেলফি তুলে পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। ইমেল করতে পারেন- [email protected] । টুইট করতে পারেন @sritiochetona . আমরা প্রত্যেকটি ছবি প্রকাশ করব আমাদের পেজে। মহালয়া তর্পণ দিয়েই শুরু হোক গণহত্যা স্মরণ।

স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.