তৃতীয় পর্ব
সালটা ১৭৯৪। নীলকুঠির ম্যানেজার হিসেবে ঘুমন্ত মদনাবতীতে সপরিবারে হাজির হয়েছিলেন উইলিয়াম কেরী। তিনি মদনাবতী গ্রামেই কাটিয়েছিলেন পাঁচ বছর। ১৭৯৯ সালে মদনাবতী গ্রাম ছেড়ে তিনি চলে যান শ্রীরামপুরে। তবে রেখে গিয়েছিলেন অনেক স্মৃতি। আজও তাঁর স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই গ্রামে।
তিনি নিজেই টিন কেটে তৈরি করেছিলেন বাঙ্গালা হরফের ছাপাখানা। গ্রামের মানুষকে শিক্ষার আলোয় আনতে গড়ে তুলেছিলেন স্কুল। গ্রামের গরিব ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সঙ্গেই দুপুরের খাবার ও পোশাকও দিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের সাধারণ মানুষদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের পাশাপাশি চাষেও উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে ১৭৯৬ সালের ১১ অক্টোবর সংক্রমণ ঘটিত রোগে মৃত্যু হয় উইলিয়াম কেরির পাঁচ বছরের ছেলে পিটারের। গ্রামেই মেঘডম্বর দিঘির ধারে প্রিয় পুত্রকে সমাধিস্থ করেছিলেন তিনি। আজও দীঘির ধারে রয়েছে সেই সমাধি। যদিও তিনি একজন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীও ছিলেন এবং সকল বিদেশী ডেভিড হেয়ার হন না।
যে সময়ের কথা বলছি,তার আগেই মদনাবতী কসবা হয়ে গিয়েছিল। আসলে, বঙ্গে বিভিন্ন জনপদের নাম পাল্টে মরুদস্যুদের সাম্রাজ্যবাদের সূচনায় নানা নামকরণের ব্যাপক সূচনা হয়। বর্তমান জনপদগুলি কসবা নামাঙ্কিত করে একে অপরের সাথে যাতে গুলিয়ে না যায় তার জন্য দিক্ নাম যোগ করে দেওয়া হয়। এভাবেই উত্তর কসবা ( মদনাবতী) , দক্ষিণ কসবা, পূর্ব কসবা , পশ্চিম কসবা নামগুলি এসেছে। মদনাবতীর নির্মাণ পালযুগের শেষভাগে হয়েছিল, তার কিয়দকাল পরেই এসেছিল বঙ্গের বুকে ঘোর দুর্দিন। তাই এই নগরীর কোনো সাহিত্য খ্যাতি অথবা কোনো লেখে তার উল্লেখ মেলে না।
প্রসঙ্গত , বামনগোলা ও সংলগ্ন গাজোল ব্লকে আছে পাঁচটি কসবা নামের মৌজা। যাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য দিক্ নাম যুক্ত হয়। তবে বতর্মানে বামনগোলায় মদনাবতী গ্রাম পঞ্চায়েত আছে।
পালনগরী মদনাবতীর অবস্থান নিয়ে এক সময় বিতর্ক হয়েছিল। জে. সি. সেনগুপ্তা সম্পাদিত ” ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার্স , ওয়েস্ট বেঙ্গল ১৯৬৫ ” – তে মদনাবতীর অবস্থান দেখানো হয় পশ্চিম দিনাজপুরের বংশীহরি থানায়। এর কারণ ও ভ্রম নিরসন প্রসঙ্গে অধ্যাপক হিমাংশু সরকার ” পালনগরী মদনাবতী ও উইলিয়াম কেরী” – তে বিস্তৃত ব্যাখ্যা সাপেক্ষে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন। আজ অবশ্য সেসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবু জেনে রাখার স্বার্থে একটু আলোচনা করি -…
জে. সি. সেনগুপ্তা পশ্চিম দিনাজপুর জেলা গেজেটিয়ারসম্পাদন কালে এফ.ডব্লিউ. স্ট্রং এবং জি.ই. ল্যাম্বর্ন – এর গেজেটিয়ারগুলি পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। এফ.ডব্লিউ.স্ট্রং তাঁর ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার দিনাজপুর ১৯১২ – তে লিখেছেন ” The later established at Madanabati a little place on the Tangan River in Bansihari Thana.” কেরী প্রসঙ্গে মদনাবতীর স্থান নির্দেশিত হয়েছে বংশীহরি থানা। আবার জি.ই. ল্যাম্বর্ন তাঁর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার মালদা ১৯১৮ – তে কেরী প্রসঙ্গে লিখেছেন ” Who settled as an Indigo planter on the Tangan just beyond the present border of the District.” ― এই রিপোর্ট দুটিই ভুল ছিল। কারণ মদনাবতী বংশীহরি থানাতে ছিল না।
১৯১৮ সালে মদনাবতী মালদা জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।মালদা জেলার গঠন হয় ১৮১৩ সালে। পূর্ণিয়া ও রাজশাহীর অন্যান্য থানাগুলি ছাড়াও দিনাজপুর জেলার দুটি থানা জগদল এবং পুরানো বা ওল্ড মালদহ থানা মালদা জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রসঙ্গত, জগদল থানা মালদা জেলার মালদা জেলার সঙ্গে সংযুক্তিকালে বামনগোলা থানা নামে পরিচিত হয়েছিল। পূর্ববর্তী জগদল থানা ছিল পুনর্ভবা নদীর তীরস্থ জগদলা গ্রামে।মালদাভুক্তিকালে থানাটির শাসনকেন্দ্র সরে আসে টাঙ্গন নদীর তীরে বামনগোলা গ্রামে। পরবর্তীকালে এই থানাদুটি যা মালদা জেলার সঙ্গে যুক্ত , ভেঙে চারটি থানা গঠিত হয় – ওল্ড মালদা, গাজোল, বামনগোলা এবং হবিবপুর থানা। মদনাবতী বর্তমান বামনগোলায় অবস্থিত।
সুতরাং, জগদল থানা মালদা জেলায় সংযুক্তিকালে মদনাবতী মালদা জেলায় সংযুক্তি হয়। বস্তুত পক্ষে জে. সি. সেনগুপ্তা মালদা ও তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুরের জেলা শাসকদের নিকট থেকে মদনাবতী মালদা জেলার বামনগোলা থানায় অবস্থিত বলে রিপোর্ট পেয়েছিলেন। তা ছাড়া সেনগুপ্তা নিজেও স্থানীয় কিংবদন্তিতে কেরী সাহেবের স্মৃতি জড়িয়ে থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবু তিনি দুজন পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পারেন।
একথা সত্য যে জনশ্রুতি সদাসর্বদা সঠিক তথ্য পরিবেশন করে না। ঐতিহাসিকগণ জনশ্রুতিকে সত্য বলে গ্রহণ করার সময় কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষ তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হল জনশ্রুতিটিকে ঘিরে আবর্তিত সেখানে কোনো প্রত্ন প্রমাণ উপস্থিত আছে কি না ? মদনাবতী নামক কোনো মৌজা বংশীহরি থানায় নেই। এদিকে বামনগোলায় কিন্তু মদনাবতী নিয়ে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি। রয়েছে বহু প্রত্ন উদাহরণ। স্বয়ং মেঘডম্বর দীঘি রয়েছে এখানে।পালিত মহাশয়ের প্রবন্ধে যার উজ্জ্বল বর্ণনা রয়েছে। একটি জনশ্রুতি বলে মহারাজ মদনপাল মদনাবতীতে অবস্থানকালে প্রতিদিন শিবডাঙ্গির শিবমন্দিরে পূজা করতে আসতেন। এক্ষেত্রে একটি কথা বলি – জনশ্রুতি তৈরি হয় অতীতকে ভিত্তি করেই। তাই বক্তার প্রমাণ উপস্থাপনের দায় থাকে না।
একটি জনশ্রুতি এও বলে যে শিবডাঙ্গির মন্দির মদনপালের প্রতিষ্ঠিত। একটি জনশ্রুতি বলে মন্দিরটি রামপালের প্রতিষ্ঠিত। তবে এসবের সঙ্গে তথ্যভিত্তিক সংকলন জেলা গেজেটিয়ারের তুলনা হয় না। জেলা গেজেটিয়ারে চূড়ান্ত সত্য পরিবেশনের দায় থাকে। ফলে পরবর্তী কালে ভুল বুঝতে পেরে সেনগুপ্তা স্বাধীনোত্তর কালের মালদা জেলার প্রথম গেজেটিয়ার সম্পাদন কালে , ১৯৬৯ সালে এই ভুল সংশোধন করে লিখলেন ” 1794 William Carey the famous Bapist missionary resided in the village of Madanabati in the mordern police station of Bamangola.”
মদনাবতীর পরিমাপ নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এটুকু বলা যায় যে , মদনাবতী খুব বৃহদাকার নগর ছিল না। রাজকীয় সরোবর তীরে নির্মিত প্রাসাদ ,অন্যান্য আনুষঙ্গিক রাজকার্য পরিচালনার জন্য ভবনাদি, মন্দির ইত্যাদি শোভিত পরিখা , বেষ্টিত প্রাকার রক্ষিত নগরীর চারটি প্রবেশদ্বার ছিল।
পালিত মহাশয় এই প্রাকারের ভগ্নস্তূপকে মালার মতো পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। এই বর্ণনা স্বাভাবিকভাবেই এমনই চিত্র উপস্থাপিত করে যে পূর্ববর্তী সমৃদ্ধ কোনো জনপদের মধ্যে রাজপ্রাসাদ অভ্যন্তরে সুরক্ষা বলয় বেষ্টিত রাজপ্রাসাদ স্থাপিত হয়েছিল। নিশ্চিত ভাবে জনপদটি সমৃদ্ধ ও বড় ছিল। নচেৎ মূল প্রাসাদের প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বে শিবমন্দিরটি কিভাবে নির্মিত হয়। মন্দির সাধারণভাবে জনসাধারণের অর্চনার সুবিধার্থে জনপদেই নির্মিত হয় বা নগরটি ওই একই কারণে মন্দিরের নিকটেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া মদনপালের পূর্বেই এই জনপদ খ্যাতনামা ছিল। তিনি কেন্দ্রস্থলে স্বনামে পুরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি তাঁর আমলেও অক্ষত ভাবে বিরাজমান ছিল এবং সেই মন্দির ঘিরে রাজা হয়ে সাধারণ সকলের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আবর্তিত হতো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনায় প্রাচীন যুগের অবসানে যখন ভারতীয় বঙ্গ সমাজ প্রবেশ করছে এক মধ্যযুগে , তখন এক ভিনদেশীয় ভয়াল এবং বিকৃত সাম্রাজ্যবাদ বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। বঙ্গের ভাবরাজ্যে তখন ভয়াল প্রেত গ্রাস করে। তুর্কিনাচন ও তুর্কানাতরিকায় জেরবার বাঙ্গালীর যাবতীয় পূর্ববর্তী ঐতিহ্য ও ইতিহাসে আসে এক করাল অমানিশা। যখন সব থেমে গেল ,তখন দেখা গেল বাঙ্গালীর গর্বের ইতিহাস ধ্রুপদী বরেন্দ্রীর ঐতিহ্য চির বিদায় নিয়েছে। অজস্র হিন্দু – বৌদ্ধ মঠ, মন্দির, বিহার, মহাবিহার, রাজপ্রাসাদ , সৌধ, গর্বোদ্ধত নির্মাণ সবই বিলুপ্ত হয়। বিলুপ্ত হয় হিন্দু নগরী লক্ষ্মণাবতী , পাণ্ডুয়া, পুন্ড্রবর্ধন , রামাবতী, দেবকোট , পঞ্চনগর , সোমপুরা সহ কত যে নাম করা তথা নাম না জানা প্রসিদ্ধ নগর , জনপদ , তীর্থ ….কে দেবে তার হিসাব?
বরেন্দ্রীর লুন্ঠিত সম্পদে সেই বিকৃত সাম্রাজ্যবাদী পর্বে গৌড় – পাণ্ডুয়ার যে অঙ্গসজ্জা, যে জাঁকজমক হয় তাতে মিশে ছিল এই ভারতের মানুষের দীর্ঘশ্বাস, রক্ত, কান্না আর পোড়া মাংসের গন্ধ। আবার যেদিন রাজধানী গৌড় থেকে ঢাকায় সরে গেল সেদিন শুরু হল গৌড় লুন্ঠন প্রক্রিয়া। এমনভাবে বঙ্গকে লুন্ঠন করা হল যে কেবলমাত্র ভিতটুকু ছাড়া কিছুই বাকি ছিল না। সে লুন্ঠিত সম্পদ কোথায় কোথায় না গিয়েছিল….! সর্বধর্ম সমন্বয় বার্তায় সেই বীর বরেন্দ্রীর প্রকৃত ইতিহাস আজ বিস্মৃত। তাই আজ একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে-
নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে
যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে,
যারা অন্যমনা, তারা শোনো,
আপনারে ভুলো না কখনো।
মৃত্যুঞ্জয় যাহাদের প্রাণ,
সব তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দীপ যারা জ্বালে অনির্বাণ,
তাহাদের মাঝে যেন হয়
তোমাদেরি নিত্য পরিচয়।
তাহাদের খর্ব কর যদি
খর্বতার অপমানে বন্দী হয়ে রবে নিরবধি।
তাদের সন্মানে মান নিয়ো
বিশ্বে যারা চিরস্মরণীয়॥
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. বরিন্দের ইতিহাস : প্রসঙ্গ শিবডাঙ্গির মন্দির
২. গৌড়লেখমালা
৩. বখতিয়ারের ঘোড়া
৪. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব
৫. মালদা জেলার ইতিহাস ও প্রত্নচর্চা