প্রথম পর্ব
সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে
সংবাদে ছিল না মুখরিত
নিস্তব্ধ খ্যাতির যুগে–
আজিকার এইমতো প্রাণযাত্রাকল্লোলিত প্রাতে
যাঁরা যাত্রা করেছেন
মরণশঙ্কিল পথে
আত্মার অমৃত-অন্ন করিবারে দান
দূরবাসী অনাত্মীয় জনে,
দলে দলে যাঁরা
উত্তীর্ণ হন নি লক্ষ্য, তৃষানিদারুণ
মরুবালুতলে অস্থি গিয়েছেন রেখে,
সমুদ্র যাঁদের চিহ্ন দিয়েছে মুছিয়া,
অনারদ্ধ কর্মপথে
অকৃতার্থ হন নাই তাঁরা–
হ্যাঁ তাঁদের প্রণমি, তাঁরা আমাদের গর্বের ইতিহাস দিয়েছেন ,তাঁরা আমাদের বীর ইতিহাস দিয়েছেন ,দিয়েছেন উন্নত এক নাগরিক সভ্যতার ইতিহাস । তাঁদের নির্মিত সেই নগরী এখন অতীতের ধূসরতায় হারিয়ে গিয়ে অন্য নাম নিয়ে বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী মানুষের করায়ত্ত হয়েছে , কারণ আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে তা রক্ষা করার চেষ্টা করি নি। ফলে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে সেসব ইতিহাসের সৌধ কিন্তু সত্য ইতিহাস আজও আকাশে বাতাসে গুমরে গুমরে কেঁদে বেড়ায় সেখানে। সেই এক অতীত ইতিহাসের কথাই বলব আজ। হয়তো অনেকের কাছেই সে সত্য হবে তিক্ত, অপ্রিয়, কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না।
রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় বলেছিলেন, ” ইতিহাস এক নিরপেক্ষ সময় প্রবাহ, যা পরবর্তী সময়ে মানুষের পছন্দ – অপছন্দের দায় বহন করে না । সে শুধু ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরে।”
তাই উক্ত সত্যের নিরিখে এই প্রবন্ধে আমার নিজস্ব কোনো পক্ষপাত নেই। শুধু এক বিশেষ অতীতকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করব। তবে যুগ থেকে যুগন্তে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেন সচেতন মানুষ।
ইতিহাস বিখ্যাত জগদ্দল মহাবিহারের নিঃসংশয় অবস্থান নির্ণয় আজো অপেক্ষিত। ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধিৎসা বজায় রয়েছে। তবে অবস্থান নির্ণয় প্রসঙ্গে বিতর্ক চলতে থাকলেও একটি বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে , সাবেক দিনাজপুর জেলার জগদ্দল থানা নামক ভূখণ্ডেই ছিল এর অবস্থান।
একটি প্রাচীন পথ , ঘোড়াঘাট থেমে শুরু হয়ে সোজা পশ্চিম মুখে হিলি, বালুরঘাটের দক্ষিণ হয়ে মালদা জেলায় প্রবেশ করেছে। সেই প্রাচীন পথের ধ্বংসাবশেষ আজো স্পষ্টত দৃশ্যমান। ধর্মপালদেবের খালিমপুর তাম্রশাসনে ক্রৌঞ্চশুভ্র গ্রামের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা যায় – পূর্বোত্তরের রাজপুত্র দেবটকৃত্যালি বাক্যটিতে জনৈক দেবট নামক রাজপুত্রের নির্মিত একটি পথের কথা উল্লিখিত হয়েছে। যা সমকালে নির্মাতার নামেই চিহ্নিত হয়। অনুমান , আলোচ্য ভূখণ্ডে দৃশ্যমান রাস্তাটিই সেদিনের দেবটকৃত্যালি। অর্থাৎ ,পথটি পালরাজবংশের শাসন কালে নির্মিত হয়েছিল। তবে কে এই দেবট তা জানা যায় না। পরে যেমন প্রায় ভারতের অনেকাংশ বা অনেকস্থানকেই বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা আপন আপন নাম দিয়ে নিজেদের অধিকার প্রকাশ করেছিল , এই পথও সেই আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়নি। সুলতানি আমলে পথটি বাদশাহী সড়ক নামে পরিচিত হয় ।
জগদ্দল থানা অংশের অবস্থান ছিল বর্তমানের নালাগোলা ও পাকুয়াহাটের মধ্যবর্তী অংশে। ১৮১৩ সালে মালদহ এবং জগদ্দল থানা সাবেক দিনাজপুর থেকে পৃথক হয়ে মালদা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় থানার সদর স্থাপিত হয় টাঙ্গন নদীর তীরে বামনগোলায়। থানাটির নাম স্থাননামে বামনগোলা থানা হয়ে যায়। আরো পরে থানাটির দক্ষিণ অংশ ভাগ করে হবিবপুর থানা গঠিত হয়। পুরো অঞ্চলটিই প্রাচীন বঙ্গের সমৃদ্ধতম প্রদেশ বরেন্দ্রীর সুদিনের সাক্ষী হিসাবে আজও বক্ষে ধারণ করে রেখেছে।
আলোচ্য ভূভাগ অজস্র প্রত্নরাজি সমকীর্ণ এক বিস্তৃত ভূভাগ। এই মৃত্তিকায় সমাহিত হয়ে গেছে দেবটকৃত্যালি, জগদ্দল মহাবিহার, নন্দদীঘি মহাবিহার , পাল নগরী মদনাবতী সহ অনেক অনেক অতীত গর্ব , বরেন্দ্রীর গৌরব স্মারক।
বরেন্দ্রীর কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল বহু চর্চিত। দ্বিতীয় মহীপাল ছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর ওপর ভাতৃদ্বয় ছিলেন শুরপাল এবং রামপাল। দ্বিতীয় মহীপাল মোটেই তাঁর পূর্বপুরুষগণের ন্যায় রণনিপুন বা রাজনৈতিক দূরদর্শী ছিলেন না। তাঁর চরিত্রে অসম্ভব সন্দিগ্ধচিত্ততা তাঁর ক্ষতির কারণ হয়েছিল। আপন ভ্রাতাগণ তাঁর শত্রু হতে পারেন বা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন ; এই সন্দেহে তিনি সিংহাসনে বসেই শুর ও রামকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু এতে তিনি কতটা শত্রুমুক্ত হন তা জানা নেই , তবে শত্রু বৃদ্ধি ভালোই করেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত তিনি সামন্ত বিদ্রোহের সম্মুখীন হলেন । দিব্য বা দিব্বোক বা দিবোক নামক কৈবর্ত বংশীয় সামন্তের হাতে নিহত হন। বরেন্দ্রীর রাজা হন দিব্য। ইতিহাস একেই কৈবর্ত বিদ্রোহ বলে। তবুও এই ঘটনাকে ঠিক কতটা বিদ্রোহ বা আন্দোলন বলা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
যা হোক , প্রায় দুদশক পরে রামপাল সেই তথাকথিত কৈবর্ত বা সামন্ত বিদ্রোহ দমন করেন। রাজবংশের হৃতগৌরব এবং বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেন। বলা হয় এই বিজয়ের পর রামপাল বরেন্দ্রীতে দুটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি হল #রামাবতী। #রামচরিতম সাক্ষ্যে নিঃসংশয় ভাবে জানা যায় যে রামাবতীর স্থাপনা – পৃষ্ঠপোষণা সকলই রামপালের কীর্তি। রামাবতী ইতিহাসপ্রসিদ্ধ নগরী, কিন্তু এর অবস্থান নির্ণয়ে বিতর্ক রয়েছে। লুপ্ত নগরী রামাবতীর অবস্থান বিতর্ক থাকলেও পালনগরী #মদনাবতী নিয়ে বর্তমানে আর কোনো বিতর্ক নেই।
মদনাবতীর ধ্বংসাবশেষের প্রত্যক্ষ বিবরণ প্রাপ্ত হয়েছে। রামপালের প্রতিষ্ঠিত এটি ছিল দ্বিতীয় নগরী। তবে , এটি রামপাল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মালদার প্রখ্যাত গ্রন্থকার এবং ঐতিহাসিক হরিদাস পালিত মহাশয় বলেছেন , যে রামপালই মদনাবতীর প্রতিষ্ঠাতা। তবে ডক্টর সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর #বঙ্গভূমিকায় মদনপালকে মদনাবতীর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হরিদাস পালিত রচিত মালদহের পাল নগরাদি এবং হিমাংশুকুমার সরকারের লিখিত প্রবন্ধ পালনগরী মদনাবতী ও উইলিয়াম কেরী – বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আলোচ্য অঞ্চলে জনশ্রুতি সংগ্রহ সাপেক্ষে উক্ত দুটি মন্তব্যের মধ্যে একটি ভুল। কিন্তু সেটি কোনটি সেটি আমার মতো ক্ষুদ্র জীবের নির্ণয় করার কথা নয়।
সম্ভবত যেকোনো একটি জনশ্রুতি প্রবঞ্চিত করছে এইজন্যই যে রামপালের সহধর্মিণী মদনাদেবী এবং রামপাল ও মদনাদেবীর সন্তান মদনপালের নাম সাদৃশ্য বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে। রামপালের ক্ষেত্রে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করার পর স্বনামে রামাবতী এবং পট্টমহিষীর নামে মদনাবতী প্রতিষ্ঠা করেন বলে একটি কিংবদন্তি আছে। আবার মদনপাল রাজা হয়ে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বীয় নামে মদনাবতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেও একটি লোকশ্রুতি আছে।
সন্ধ্যাকর নন্দীর রচিত রামচরিতমের মূল বর্ণিতব্য বিষয় বা ব্যক্তি রামপালের কীর্তিগাথা। তবুও এই কাব্য পরিশেষে দেখা যায় রাজা হিসাবে মদনপালের দীর্ঘজীবন কামনা করা হয়েছে। ফলত, এই বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে , কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রামপাল, রামপালের পুত্র কুমারপাল, কুমারপালের পুত্র চতুর্থ গোপাল এবং রামপালের অপর পুত্র মদনপালের রাজত্বকাল দেখেছিলেন। তাই কাব্য শেষে কবি মদনপালের সুদীর্ঘ রাজ্যভোগ ঈশ্বরের নিকট কামনা করেছেন। অর্থাৎ , কবি সন্ধ্যাকরের রামচরিতম কাব্য শেষ হবার পরেও মদনপালের রাজ্যত্ব চলে।
রামচরিতমের চতুর্থ পরিচ্ছেদের শেষ ৪৮ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে –
ইতি মদনোদিত – বৃত্তান্ত – সম্মতো – বন- কুশো – দক- শয়ঃ সততম্ ।
দাতা চিরায় রাজ্যম রাজা কুরুতা শ্চিতোরুতর কীর্তি – রয়ম।।
অর্থাৎ, অধার্মিকদের শত্রু , ধার্মিক রাজা মদনপাল, ধার্মিকদের দান করার জন্য যাঁর দুই হস্ত সদাই কুশ এবং জলে ভেজা থাকে , তিনি যেন তার চতুর্দিকে ব্যপ্ত যশের সাহায্যে দীর্ঘকাল রাজ্য শাসন করেন।
সন্ধ্যাকর নন্দীর রচনায় রামাবতী নগরের কথা সগৌরবে উল্লেখ হলেও কোথাও তিনি মদনাবতীর কথা বলেন নি। মদনপালের কথা একটা নির্দিষ্ট পর্ব পর্যন্ত আলোচিত হয়ে কাব্য সমাপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ , যে পর্যন্ত রামচিতম রচনা করা হয় , সেই পর্যন্ত মদনাবতী প্রতিষ্ঠিত হয় নি ? পরবর্তী পর্যায়েও কিন্তু মদনপালের রাজ্যত্ব চলে। তখনই কি নগরীটি প্রতিষ্ঠা হয়। সেই অনুমান অমূলক নাও হতে পারে। কারণ সমকালীন রাজনীতি সেই ইঙ্গিত প্রদান করে থাকে।
মদনপাল ১১৪৩ খ্রীষ্টাব্দ হতে ১১৬১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর উনিশ বৎসর রাজত্বকালের প্রথম দিকে #রামচরিতম রচনা সমাপ্ত হয়। মদনপালের রাজ্যকালের মধ্যবর্তী পর্বে সেনবংশীয় বিজয়সেন উত্তরবঙ্গের বৃহদংশ অধিকার করেন। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে মদনপালের সাম্রাজ্য উত্তরবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চল , নালন্দা, গয়া , মুঙ্গের এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।ফলে ,নতুন এলাকায় শাসনাধিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। সামরিক দিক থেকে মদনাবতীর অবস্থান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
পুনর্ভবা এবং টাঙ্গন নদী দিয়ে মহানন্দা এবং গঙ্গায় অবাধ প্রবেশাধিকার, সম্ভুমির যাবতীয় সুযোগ সুবিধা, নালন্দাদি অঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত সংযোগ রক্ষার সুবিধা ইত্যাদি কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্থানটির পূর্ব হতেই বর্ধিষ্ণু জনপদ বিষয়টি। এই ধারণার মূলে যে তথ্যটি আছে তা সুপ্রাচীন এবং বিখ্যাত শিবডাঙ্গির মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাকে ঘিরে আবর্তিত। সেই মন্দিরের শিব বিশালাকার। মন্দিরের শিব তিলভান্ডেশ্বর নামেও সুপরিচিত। বটবৃক্ষ জড়িত শিবমন্দির নিয়ে লৌকিক , অলৌকিক নানা কথায় শিবডাঙ্গি প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর হয়ে উঠেছে। জনশ্রুতি বলে , শৈব কৈবর্ত রাজা ভীম এই মন্দির নির্মাণ করেন। ভীম ও হরি ছিলেন হরিহর আত্মা বন্ধু। তাই মন্দিরটি হরিহর শিবমন্দির হিসাবেও পরিচিত হয়। রাজা রামপালের পট্টমহিষী মদনাদেবী মেঘডম্বর দীঘিতে স্নান সেরে পালকি চেপে সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে এই মন্দিরেই পূজা দিতে আসতেন। কেবল তিনিই নন , মদনপালও মদনাবতীর পল্লীনিবাসে বিশ্রামের জন্য এলে এখানে নিয়মিত পূজা দিতেন।
কথা হতে পারে যে পাল রা বৌদ্ধ ছিলেন, তাহলে কেন শিবমন্দিরকে ঘিরেই একটা নগর গড়লেন? পালরা বরেন্দ্রীই মানুষ ছিলেন এবং অধিকাংশ রাজাই সুশাসক ছিলেন। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রচনায় সে কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। বৌদ্ধ হল সনাতনের একটি মার্গ। তাতে পালরা একান্ত করণে বিশ্বাস রাখতেন। সকল মার্গের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ছিল। তাছাড়া বৌদ্ধ মার্গে শিব একটি বৃহৎ ভূমিকা পালন করেন। হেরুক, ভূতডামর ইত্যাদি রুদ্ররূপে তিনি পূজিত হন। সে অনেক বড় তত্ত্ব , সেইসব পরে কখনো আলোচনা করব। যাক, উক্ত কারণেই হয়তো সম্পূর্ণ পালযুগে বঙ্গ জুড়ে শিব মন্দির সহ নানা মন্দির নির্মাণ হয়েছিল।
মদনপাল এইজনপদকে নতুন করে সাজিয়ে ছিলেন। দ্রুততার সঙ্গে নগর প্রাকার, মন্দির, প্রাসাদ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মিত হয়। যদি নগর মদনপালের রাজত্বের একেবারে শেষ ভাগে নির্মিত হতো, তবে তিনি এমন সুন্দর করে নগরটি সাজাতে পারতেন বলে মনে হয় না , আবার দ্রুত নগর সাজানোর বিষয়টিও প্রশ্ন তোলে। অনুমান দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দশকে মদনাবতী রাজনিবাসে পরিণত হয়। মদনাবতীর স্থায়িত্ব ছিল স্বল্পকাল ,তবে যদি রামপালের সময় নির্মাণ হয় তবে মদনাবতীর স্থায়িত্ব ছিল শতাব্দীকাল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনায় বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে বরেন্দ্রী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং মদনাবতী খন্ডহরে পরিণত হয়।
একদিন কালের কবলে পাল রাজবংশে ঘুণ ধরে। কর্ণাটক থেকে ব্রহ্মক্ষত্রিয় সেন বংশ এসে বঙ্গে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তখন পালবংশের একটি শাখা শেষ প্রদীপের জ্বলন্ত শিখার ন্যায় আপন রাজত্ব রক্ষা করতে লাগলেন এই উদ্দন্ডপুরে। পাল বংশের শেষ রাজা গোবিন্দ পাল যখন রাজত্ব করছেন , উদ্দন্ড , নালন্দা আক্রমণ করল ইবলিসের মালিক বখতিয়ার। ছোট রাজ্য, সীমিত ক্ষমতা কিন্তু গোবিন্দ পালের শিরায় উপশিরায় বহিত ছিল গোপাল, ধর্মপাল, দেবপালের মতো বীরের রক্তধারা। তাঁর তরবারির ধার একটুও কমেনি।
সে এক প্রচণ্ড লড়াই হয়েছিল। তথাকথিত ইতিহাস সেসব আর আমাদের মানে ভারতীয়দের মনে করায় না। তবুও , ইতিহাস কিন্তু ছাই চাপা আগুনের ন্যায় থেকে যায়। অশ্বারোহন করে যুদ্ধ করতে করতে দুজনে ভূমিতে নেমে এসে যুদ্ধ করেন। বখতিয়ার কেবল যুদ্ধ ব্যবসায়ীই ছিল না, সে একজন ধূর্ত এবং নৃশংস ব্যক্তিও ছিল বটে। জিহাদের জন্য সব রাস্তাই সঠিক এবং যুদ্ধের মূল কথা হল বিজয় এটাই ছিল জীবন , এটাই ছিল তার বিনোদন।
মরণপণ সেই দ্বৈরথে হয়েছিল এক বিপর্যয়। হ্যাঁ ,বিপর্যয়…তাতে বীর গোবিন্দ পালে জয়ী হবার সম্ভাবনা ছিল একশভাগ। গোবিন্দপালের তরবারির আঘাতে বখতিয়ারের তরবারি মাটিতে ছিটকে পড়ে। নিরস্ত্র বখতিয়ার প্রাণ ভিক্ষা চায় গোবিন্দের নিকট। রাজা গোবিন্দ যতই বীর হন না কেন তিনি সুবিশাল ভারতের মানুষ, তাঁর রক্তে সনাতনের দর্শন , ক্ষমাশীলতা প্রবাহিত হচ্ছে যুগ হতে যুগান্তরে। তাই নিরস্ত্র বখতিয়ারকে ক্ষমা করে তার হাতে অস্ত্র নিয়ে পুনশ্চ যুদ্ধের আবাহন করলেন। লাফিয়ে মাটি থেকে তরবারি তুলে বখতিয়ার ফলাটা আমূল গুঁজে দিলেন গোবিন্দ পালের বুকে। রক্তাক্ত নৃপতি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সাঙ্গ হল সব ,লুঠ হল উদ্দন্ড পুর, মাংস লোলুপ তুর্কিরা আক্রমণ করল নালন্দা। হাজার হাজার সন্ন্যাসীর রক্তে ভিজে উঠল মহাবিহারের মৃত্তিকা। লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়ে গেল নালন্দা , মূল্যবান পুঁথি, ভারতের কৃষ্টি, সংস্কৃতি। পোড়া মাংসের কটুগন্ধে সেদিন ভারতের একটি অংশের আকাশ ,বাতাস ভরে উঠেছিল।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. বরিন্দের ইতিহাস : প্রসঙ্গ শিবডাঙ্গির মন্দির
২. গৌড়লেখমালা
৩. বখতিয়ারের ঘোড়া
৪. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব
৫. মালদা জেলার ইতিহাস ও প্রত্নচর্চা