মুক্তির দিশারি ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের খয়রা অধ্যাপক বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য মধ্যমপুত্র ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে ‘বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া’ এই আপ্তবাক্যটি সর্বাংশে সার্থক ও সর্বজনগ্রাহ্য। অপরিসীম মেধা, তীক্ষ্ণবুদ্ধিমত্তা, স্বাদেশিকতা, প্রবল শিক্ষানুরাগ, নির্ভীক, দৃঢ়চেতা ও প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মহামতি মানুষটি ১৯০১ সালের ৬ জুলাই কলকাতার তৎকালীন ৭৭, রসারোডের (বর্তমানে ৭৭, আশুতোষ মুখার্জি রোড) বাড়িতে বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও যোগমায়াদেবীর মধ্যম পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ করেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাত সন্তান। তিন কন্যা ও চার পুত্র। বাংলার বাঘ তার ব্যাপ্তিতে যেখানে সীমিত করেছিলেন শিক্ষা, আইন ও স্বল্প পরিসরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে, সেখানে তার এই স্বনামধন্য মধ্যম পুত্রটি নিজেকে প্রসারিত করেছিলেন সমুদ্রের ন্যায়। শিক্ষার অঙ্গন থেকে আইন (কলকাতা উচ্চ আদালতের বার কাউনসিলের সভাপতি রূপে), অপর দিকে রাজনীতি ও জনসেবা। খানিকটা আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপ্ত। কিন্তু আপামর বাঙ্গালি তথা সমগ্র ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য যে আজও এই মহান প্রাণের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনকে জোতিষ্কের ন্যায় বিচ্ছুরিত করে মাত্র ১১ বছরকাল অতি স্বল্প সময়ে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনকে আলোকিত করে উন্মেষ ঘটিয়ে ছিলেন এক রাজনৈতিক নব দিশার। অধুনা হুগলী জেলার জিরাট নিবাসী এই মুখোপাধ্যায় কুলপতি তাই আজও বাঙালি হৃদয়ে মুকুটহীন সম্রাট হিসাবে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত।অধুনা গুপ্তিপাড়া নিবাসী, কৃষ্ণনগরবাসী মধ্যবিত্ত সদ, ব্রাহ্মণ শ্রীরামনারায়ণ ভট্টাচার্যের সুযোগ্য কন্যা যোগমায়াদেবীর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়েছিল ড. গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই সময়ে খ্যাতির শিখরে থাকা অত্যন্ত সুযোগ্য পাত্র আশুতোষের বিবাহ উপলক্ষ্যে এক পয়সা দানসামগ্রী ড. গঙ্গাপ্রসাদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। এদিকে বিবাহের দীর্ঘদিন পরও কোনো সন্তানসন্ততি না হওয়ায় যোগমায়াদেবীর প্রসঙ্গে ড. গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পত্নী শ্রীমতী জগত্তারিণীদেবী ও অন্যান্য আত্মীয়রা নানান সমালোচনা শুরু করেন। এমনকী তিনি পুত্রের পুনরায় বিবাহ দিতে আগ্রহ দেখান। ড. গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই ঘটনা উপলব্ধি করে এই বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধ মতামত শুধুমাত্র ব্যক্ত করেননি, বরং মৃত্যুর আগে তার বসতবাড়িটি একমাত্র পুত্র আশুতোষের নামে না দিয়ে আদরের পুত্রবধূ যোগমায়াদেবীর নামে উইল করে দেন। কালক্রমে যোগমায়াদেবীর প্রথম কন্যা, ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদের বড়ো ভগ্নী শ্ৰীমতী কমলাদেবীর জন্মের মধ্য দিয়ে এই আশঙ্কার স্থায়ী অবসান ঘটে। ১৮৮৯ সালে যখন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বয়স মাত্র ২৪ বছর ৬ মাস, তখন মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ড. গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অতর্কিতে সামান্য রোগভোগের পর পরলোকগমন করেন।
অতঃপর একে একে আশুতোষের বাকি সন্তানদের জন্ম হয়। ছোটোবেলা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ (তখন ডাকনাম ছিল বেণী, যোগমায়াদেবী আদর করে ডাকতেন ভোতন বলে) ছিলেন খানিকটা ডাকাবুকো, নিজ অধিকার সম্বন্ধে প্রখরভাবে সচেতন, প্রতিবাদী এবং অন্যান্য সমবয়সিদের তুলনায় আলাদা। ভারিক্কি চালচলন,। প্রখর মেধা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, মানসিক বিকাশেও বহুযোজন অগ্রগণ্য। এই সন্তানের মধ্যে তাঁর নিজ সত্তার পূর্ণবিকাশের বীজ নিহিত রয়েছে, এই সত্য উপলব্ধি করতে দূরদর্শী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কোনো অসুবিধা হয়নি। তাই তিনি শ্যামাপ্রসাদকে তৈরি করেছিলেন নিজের মতো করে, তার প্রকৃত উত্তরসূরি হিসাবে, যা শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক দশক উপাচার্য থাকাকালীন একজন কিংবদন্তী প্রশাসক হিসেবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ সর্বজন বিদিত। আর উপাচার্য থাকাকালীন খানিকটা বোধহয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এই প্রিয়তম পুত্রের সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করতেন। এই ঘটনাও শ্যামাপ্রসাদকে একজন কালজয়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসক হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিল। স্যার। আশুতোষ শিক্ষাবিস্তারে ভবানীপুরে মিত্র ইনস্টিটিউশনের শাখা চালু করলেন। শ্যামাপ্রসাদকে তিনি এই স্কুলেই ভর্তি করে দেন। প্রখর মেধাবী, উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও নিরহংকারী, বন্ধুবাৎসল্য ও শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ শ্যামাপ্রসাদকে গড়ে তুলেছিল একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে। মেধার কারণে। বয়স অপেক্ষা কম সময়ে অসামান্য সাফল্যের নিদর্শ হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশনে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে প্রেসিডেন্সি (তৎকালীন হিন্দু কলেজ) কলেজে ভর্তি হলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। স্নাতক পরীক্ষায় ইংরেজি সাহিত্যে সাম্মানিক সহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সমকালীন সময়ে স্যার আশুতোষের নির্দেশে সদ্য চালু হওয়া বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হলেন ও পুনরায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। এরপর আইন নিয়ে পড়া। জীবনে কোনোদিন দ্বিতীয় না হওয়া এই অসামান্য মেধাবী ছাত্রটির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে প্রবেশ মাত্র ২৩ বছর বয়সে। ১৯২৪ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে পদ। খালি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ক্ষেত্রের এই কনিষ্ঠতম সদস্যটি তার অবিসংবাদী কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন অসামান্য দূরদর্শিতা ও প্রখর বুদ্ধির জন্য। এরপর বিদেশে ব্যরিস্টারি পড়তে যাওয়া ও ব্যরিস্টার হয়ে দেশে ফিরে কলকাতা উচ্চ আদালতের বার কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া। প্রতিক্ষেত্রেই যেন। এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন! এরপর ১৯৩৪ সালে প্রথমবার ও ১৯৩৬ সালে। দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে মনোনীত হলেন। বিশ্বের কনিষ্ঠতম উ পাচার্য হিসেবে রচিত হলো শিক্ষা পরিচালনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত, যা আজও অকল্পনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে স্যার। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। সুনিপুণভাবে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমাকে বর্ধিত করেছেন বহুগুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলমোহর, কেন্দ্রীয় পাঠাগার নির্মাণ,ইসলামিক ইতিহাস বিভাগ চালু করা, বাংলায় গবেষণাপত্র লেখার অনুমতি প্রদান, ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বাংলা ভাষায় পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা, অভিধান রচনা, সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার ক্যাম্পাসে শারীরবিজ্ঞানে স্বতন্ত্র স্নাতকোত্তর বিভাগ চালু করা, রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ অধ্যাপক রূপে (শত সমালোচনা উপেক্ষা করে) নিয়োগ, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষণ মাতৃভাষায় দেওয়ানোর মতো কালজয়ী সিদ্ধান্তগুলো তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতম উপাচার্য হিসেবে অক্ষয় ও অমর করে রেখেছে।
ব্যক্তিগত জীবনে এমএ পড়াকালীন বিশিষ্ট কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পৌত্রী শ্ৰীমতী সুধাদেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ১৬ এপ্রিল ১৯২২ সালে। একটি গোটা ট্রাম নিয়ে বরযাত্রী গিয়েছিল ভবানীপুর থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সেই প্রথম ট্রামে চড়া।
শ্যামাপ্রসাদের সহোদর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনিকার উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবরণ অনুযায়ী সম্ভবত দৈহিক স্থূলতার জন্যই ড. মুখোপাধ্যায় খেলাধুলা থেকে খানিকটা নিস্পৃহ ছিলেন। ছোটাছুটিতে কাহিল হয়ে পড়তেন। কিন্তু মানসিক বিকাশের দ্রুততার কারণে সম্ভবত তাঁর মেলামেশার ক্ষেত্রটি ছিল বয়সে বড়োদের সঙ্গে। মজা করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য হলেও স্বভাবোচিত রাশভারী ছিলেন। কথা বলার ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয় মানসিকতার একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তার ছাত্রজীবনে। তিনি তখন হিন্দু কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র। স্থূলদেহ নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। তাকে দেখে কিছু অপরিচিত ছাত্র নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন করছে। প্রখর বুদ্ধির অধিকারী শ্যামাপ্রসাদের সন্দেহ হলো। হঠাৎ ওই ছেলেদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে অতিপরিচিতের ভাব করে তার স্থূল উদরের উপর হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করল “আরে ভাই কী খবর?” উনি তৎক্ষণাৎ তার বিশাল মুঠো তুলে তার পিঠে দুম করে কিল মেরে খাবল দিয়ে টিপে ধরে বললেন ‘এই তো! কদিন পরে দেখা’। পিঠের আঘাতে কাতর হয়ে সেই ছাত্রটি তখন আঁতকে উঠে কাঁচুমাচু মুখে বলে উঠল “ওঃ আর একজন ভেবে ভুল করেছি, তাই চিনতে পারিনি, ছাড়ুন ছাড়ুন। শ্যামাপ্রসাদ তখন পিঠের খাবল ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলেন ‘সত্যি! তাইতো? আমারও ভুল হয়েছে। দেখছি! মনে করবেন না কিছু। এই বলে তাকে ছেড়ে দিলেন। এক নির্মল রসিকতার মোড়কে প্রতিপক্ষকে তিনি সেদিন ‘টিট ফর ট্যাট’-এর যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা থেকেই তার চরিত্রের আপোশহীনতার এক অনন্য নজির দেখতে পাওয়া যায়। আর সম্ভবত এই চারিত্রিক দৃঢ়তাই পরবর্তীকালে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী অতিক্রম করে সমগ্র দেশ ছাপিয়ে সংসদ ভবনকে উত্তাল করে। তুলেছিল। আর ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের এই আপোশহীন সংগ্রামের মূল্য তঁাকে চোকাতে হয়েছিল আত্মবলিদানের মাধ্যমে। স্পষ্টবক্তা, নির্ভীক এই রাষ্ট্রযোদ্ধার শিক্ষা ছিল : ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করো, প্রতিবাদ করো, প্রয়োজনে নাও প্রতিশোধ। অন্যায়কে মুখ বুজে মেনে নেওয়াকে ঘৃণা করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈতনিক উপাচার্য ছিলেন তিনি। মনোনীত হয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। ঠিক তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৩২ সালে ঘটল তাঁর পত্নী বিয়োগ। কিন্তু পুনরায় বিবাহ না করে চার সন্তানকে স্বয়ং পিতা-মাতার স্নেহে লালন পালন করেছিলেন।
প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর পদচারণা স্বল্পকালীন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্রে প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশবরাও বলিরাম হেডগেওয়ার তথা সর্বজন সমাদৃত ডাক্তারজীর সান্নিধ্যে আসা ত্রিশ দশকের। মাঝামাঝি কলকাতায়। প্রত্যক্ষভাবে কখনও স্বয়ংসেবক না হলেও দেশভাগের পূর্বেই তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতি পোষণ করতেন সুগভীর শ্রদ্ধা। ১৯৪০ সালে লাহোরে সঙ্রে এক অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে ভারতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে আর এস এস হলো একমাত্র রুপালি রেখা।
রাষ্ট্রের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ ও ভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের উদগ্র বাসনা সঙ্ঘকে জাতীয় উন্নয়ন ও জাতীয় মেরুদণ্ড গঠনে এক সোপানে পরিণত করে তুলেছিল। দেশভাগের সময় শাসকগোষ্ঠীর তথা তৎকালীন সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মীদের সঙ্গে একত্রে রাষ্ট্রনির্মাণে ব্রতী হলেও গান্ধী হত্যার মিথ্যা অজুহাতে স্বয়ংসেবকদের উপর নেমে আসে এক নির্মম অত্যাচার। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো সঙ্ঘকে। সঙ্রে স্বয়ংসেবকদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সঙ্ঘ কখনই হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বরাবরই ছিল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত। কিন্তু এই ঘটনা কয়েকজন কার্যকর্তার মনে নতুন করে চিন্তার উদ্রেক ঘটালো। তারা চিন্তা করলেন সংসদীয় গণতন্ত্রে যদি লোকসভায় নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ না করেন। তবে এর কোনো আশু সমাধানসূত্র বেরোবে না। এই অন্যায় ও অত্যাচারের পরিমাণ উত্তোরোত্তর বাড়বে। হিন্দু নিধনের কোনোদিন কোনো সুরাহা হবে না। এই ধ্রুব সত্য উপলব্ধি করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন ব্যক্তি কোথায় যিনি ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে লোকসভার অভ্যন্তরে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন আবার সচ্ছাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখবেন? এমন সময়ে এগিয়ে এলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
তখনকার পরিস্থিতিতে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি, দেশভাগে অত্যাচারিত, নিপীড়িত, কপর্দকশূন্য হিন্দু জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে উন্নাসিকতা ও কেন্দ্রীয় বঞ্চনায় গর্জে উঠলেন বঙ্গজনক, শিক্ষামহারথী, ভারত সরকারের প্রথম সার্থক ভারী শিল্পমন্ত্রী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাংলা, অসম ও পশ্চিমবঙ্গকে ইতিপূর্বেই তিনি ঐতিহাসিক ক্রিপটস কমিশনের মাধ্যমে মহম্মদ আলি জিন্নার করাল পাকিস্তানি গ্রাস থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। তিনি পদত্যাগ করলেন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী সভা থেকে। নিজেকে নিয়োজিত করলেন জনসেবায়, প্রত্যক্ষভাবে হয়ে উঠলেন উদ্বাস্তু মানুষের পরিত্রাতা হিসেবে।
শ্যামাপ্রসাদের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবোধ থেকে বিচ্যুত কংগ্রেস কার্যত হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িকতার তোষক, দেশের দুর্ভাগ্যবাহী একটি মঞ্চে। প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতি ও সম্মানের প্রতি ভাবলেশহীন শ্যামাপ্রসাদের লক্ষ্য কেবলমাত্র জনসেবা। তথাকথিত সমাজতন্ত্রী বা প্রজাতন্ত্রী দল যারা বিদেশিনীতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, এরা বেশিরভাগই স্বঘোষিত সাম্যবাদী, রাশিয়ার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ, বাস্তবে মুসলমান তোষক ভিন্ন কিছুই নয়। শ্যামাপ্রসাদ উপলব্ধি করলেন এমন এক মাৎস্যন্যায় অবস্থায়। প্রয়োজন এক নতুন দল গঠনের যা ভারতীয় ভাবধারাকে অগ্রসর করবে। রাষ্ট্রীয় হিত হবে এই দলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ব্যক্তির চেয়ে দল হবে বড়ো, আবার রাষ্ট্রের হিতে দল তার সমস্ত সত্তাকে তৎক্ষণাৎ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকবে। সুতরাং এই দুই ভাবধারার মেলবন্ধন আবশ্যিক হয়ে উঠল। ভারতকেশরী শরণাপন্ন হলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্চালক শ্রীগুরুজী (মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর)-র। শ্রীগুরুজী তাঁকে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যার মূল আদর্শ হলো ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ও পূর্ণবিকাশ সাধন। কিন্তু স্বয়ংসেবকরা কোনো দলের দাসত্ব করবেন না। এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মঞ্চ, তাই কোনো রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে এটিকে যেন কোনো প্রকারে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত না করা হয়। শ্যামাপ্রসাদ সহমত পোষণ করলেন এবং শ্রীগুরুজীকে আশ্বস্ত করলেন যে নতুন দল গঠিত হবে এবং আর এস এস-এর স্বয়ংসেবকরা রাষ্ট্রনির্মাণে ও এই দলের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দল সঙ্রে ভূমিকা বা কর্মসূচিকে প্রভাবিত করবে না প্রত্যক্ষভাবে। শ্রীগুরুজী অনুমতি দিলেন। এরপর শুরু হলো ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নবউন্মেষে পথচলা। অকৃত্রিম রাষ্ট্রভাবনা, বিকেন্দ্রীকৃত অর্থনীতি, সর্বধর্ম সমভাব ও ভারতীয় সংস্কৃতির পুনরুন্মেষের মাধ্যমে রাষ্ট্রনির্মাণের জন্য নতুনযুগের সূচনা হলো। ‘ব্যক্তির ঊর্বে দল এবং দলের ঊর্ধ্বে দেশ’—এই মহান ভাবনাকে সম্বল করে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অগ্রসর হলেন। রাষ্ট্রের সম্মানকে রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যেই। গঠিত হলো ভারতীয় জনসঙ্ঘ।
ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাপর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল সভাপতি নির্বাচন। যদিও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। ১৯৫১ সালের ১১ অক্টোবর দলের একটি প্রতিনিধি দল সকাল ৮টা নাগাদ দিল্লির ১০ নম্বর পুসারোডে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাসভবনে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন লালা হংসরাজ গুপ্তা, পণ্ডিত মৌলিচন্দ্র শর্মা, প্রফেসর মহাবীর এবং শ্যামলেশ দাশ।
ড. মুখোপাধ্যায় বারান্দায় হাস্যমুখে অতিথিদের অভ্যর্থনা করে তার ছোটোপড়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে রোজকার অভ্যাস মতো ভোর সাড়ে ৬টায় প্রাতঃভ্রমণ সেরে তিনি অধ্যয়নের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মোটা কাপড়ের ধুতি-পঞ্জাবি, তুসের চাদর ও সাধারণ চটি পরে তিনি জনসমক্ষে উপস্থিত হন। চেয়ার অপর্যাপ্ত থাকায় নিজেই পাশের ঘর থেকে চেয়ার নিয়ে আসেন ও সকলের বসার পর নিজে বসেন। তারপর লালা হংসরাজ প্রথম ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করলেন দলের সভাপতি হিসেবে। তিনি আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। অবশেষে তিনি ভারতমাতার সেবায় এই গুরদায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি জানালেন। লাগাতার কুৎসা, অপপ্রচার, নিন্দা ও টিপ্পনীকে উপেক্ষা করে নির্ভীক চিত্তে তার এগিয়ে চলা শুরু হলো। তার দিল্লিতে রামলীলা ময়দানের জনসভা যে বিপুল জনসমুদ্রের আকার নিয়েছিল, তা দেখে ভীত তৎকালীন শাসক তাকে ‘সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদ আখ্যা দিয়েছিল। ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী তথা অবিসংবাদী জননেতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক জ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ পুরষ শ্যামাপ্রসাদ হয়ে গেলেন সাম্প্রদায়িক নেতা! উদ্বাস্তু মানুষের রক্ষাকর্তা, পশ্চিমবঙ্গের জনক শিকার হলেন গভীর রাজনৈতিক ঘৃণ্য চক্রান্তের। কিন্তু প্রবহমান গঙ্গার মতো বৃহৎ ও পবিত্র শ্যামাপ্রসাদ সিংহবিক্রমে উপেক্ষা করলেন এই চক্রান্তকারীদের।
১৯৫২ সাল। প্রথম লোকসভা নির্বাচন। জনসঙ্ঘের ৩ জন প্রার্থী নির্বাচিত হলেন সারাদেশের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে : কলকাতা দক্ষিণ পূর্ব (ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), মেদিনীপুর -ঝাড় গ্রাম (দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং রাজস্থানের চিতোর (উত্তমশঙ্কর মুলটিভাই ত্রিবেদী)। মাত্র তিনজন সাংসদ থাকা সত্ত্বেও অপরিসীম। প্রজ্ঞা, অসাধারণ বাগ্মিতা, প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা তাকে অকংগ্রেসি দলগুলির সমর্থনে বিরোধী দলনেতার পদে আসীন করেছিল। শ্রীগুরুজী কর্তৃক প্রেরিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের থেকে নিষ্ঠাবান, সৎ, পরিশ্রমী ও দেশমাতৃকার সেবায় সংকল্পিত স্বয়ংসেবকরা শ্যামাপ্রসাদের ভাবনাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার যে মহৎকাজটি নিজেদের কঁাধে তুলে নিয়েছিলেন, তারই মূর্ত প্রতিফলন আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি নামক মহীরূপ। চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে পিছনে ফেলে আজ ১১ কোটির বেশি সদস্য নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে। আজ একজন বাঙ্গালি হিসেবে ভাবতে গর্ববোধ হয়, শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে যায়, এই বাঙ্গলার গর্ব, আপামর বাঙ্গালির রক্ষাকর্তা, ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদর্শ আজ রাজনৈতিক ভাবে শুধুমাত্র এই পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশের পরিধি অতিক্রম করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ আজ শ্যামাপ্রসাদের অনুগামী।
এই জাতীয় নেতা শ্যামাপ্রসাদ সেদিন জম্মু প্রজাপরিষদের ডাকে কাশ্মীরে সমস্যা সমাধানে নেহরুকে বারবার অনুরোধ করা। সত্ত্বেও তাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উদাসীন ছিলেন। বাধ্য হয়ে তিনি কাশ্মীর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীগুরুজীর মনে আশঙ্কা ছিল কোনো বিপদ ঘটতে পারে। তাই তিনি ও পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় বহু চেষ্টা করেছিলেন তাকে আটকাতে। কিন্তু বিধি বাম। শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মীরে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জম্মু হাসপাতালের নারী ও প্রসূতি বিভাগে এক রহস্যজনক পরিস্থিতিতে ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন। ভোররাতে মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মতো মহৎ ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় না। শ্যামাপ্রসাদ কোনো ব্যক্তিত্ব নয়, এক সুবিশাল প্রতিষ্ঠান, মৃত্যু যার কাছে অতি তুচ্ছ ঘটনা। তার চলার পথের পাথেয় আজও ভারতীয় জনতা পার্টি বহন করে চলেছে। প্রদীপের শিখার আলোয় পদ্মফুল বিকশিত হয়েছে সারাদেশ জুড়ে। তাই আমাদের। চলতে হবে তার দেখানো পথে।তিনি বিশ্বাস করতেন অন্য দেশকে অনুকরণ করে নয়; একতা, সংগঠিত জাতিগঠন, সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ ও প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে, রক্ষণশীলতা ও আধুনিক চিন্তার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। ভারতীয় সংস্কৃতিই হলো জাতির মেরুদণ্ড। তাই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হলে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। রাষ্ট্রের বিকাশে হিন্দুত্বের জাগরণ ছাড়া কোনো বিকল্প চিন্তা বাতুলতা মাত্র। কারণ হিন্দুত্বই ভারতের রাষ্ট্রীয়ত্ব। হিন্দুরাষ্ট্র বলতে। বোঝায় ভারতীয় সংস্কৃতি যা পরধর্ম সহিষ্ণুতার নামান্তরমাত্র। নির্দিষ্ট ধর্মের ভোট আদায়ের নামে বাকি রাজনৈতিক দলগুলি তোষণের যে নির্লজ্জতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ধিক্কার যোগ্য। হিন্দুত্বের যদি জাগরণ না হয়, অচিরেই এই মাতৃভূমির কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। পরিশেষে, শ্যামাপ্রসাদের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে :
“কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ
কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ—
কাতরে কাঁদিবে মায়ের পায়ে দিবে
সকল প্রাণের কামনা”
ড. শুভদীপ গাঙ্গুলী
(২৩ জুন, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বলিদান দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.