আমরা যারা গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের পল্লীগ্রামে বড়ো হয়েছি, তাদের মনে আছে পল্লীজীবনে দুঃখকষ্ট, ঝগড়াঝাটি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব, কৃষি, কুটির শিল্পের বিকাশের দুরবস্থা সবই ছিল—কিন্তু এতসব কিছু সত্ত্বেও গ্রামজীবনে একটা স্বাভাবিক চলন ছিল। ছিল একটা বহমান স্বতঃস্ফুর্ত গতি। অনেক খেলার মাঠ ছিল, সাঁতারের পুকুর ছিল। ছিল যাত্রা-থিয়েটারআবৃত্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা ও বন্দোবস্ত। এখন পিছন ফিরে ভাবলে মনে হয়—ছিল নাদুটো বিষয় : ‘রাজনীতি’ এবং ‘উন্নয়ন। ‘রাজনীতি’ব্যাপারটা এখনকার পরিচয়ে না থাকার মূল কারণটা ছিল কংগ্রেস পার্টির একাধিপত্য এবং উন্নয়ন প্রসঙ্গে তাই আলোচনাও ছিল না।
একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের আধিপত্য থেকে স্বভাবতই চলে এসেছিল প্রশাসনিক জাড্য এবং ব্যর্থতা। বিধানচন্দ্র রায়ের মতো দক্ষ প্রশাসকের পরিচালনা সত্ত্বেও প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতি জনগণের গোচরে আনার প্রথম সফল প্রচেষ্টা করেন বামপন্থীরাই এবং তাদের উদ্যোগের পিছনে ছিল দেশভাগের বলি উদ্বাস্তুদের অসহায় অবস্থার উদ্বেগ। এই উদ্যোগের প্রথম দুটি ফসল ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালের দু’দুটো যুক্তফ্রন্ট সরকার চরম ব্যর্থ হলো নেতৃবৃন্দের তাড়াহুড়ো, অনভিজ্ঞতা এবং খেয়োখেয়ির কারণে। মাঝে রাষ্ট্রপতির শাসন এবং একটা খোঁড়া সরকারের স্বল্পকালীন শাসনের পরে এল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার—সেটা ১৯৭২ সাল। সিদ্ধার্থশঙ্কর উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত এবং দক্ষ রাজনীতিক হলেও তার শাসনকাল নানান প্রশ্নচিহ্নে বাঙ্গালিজীবনকে অনেকখানিই ব্যতিব্যস্ত করেছিল। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার আঘাতে গোটা ভারতবর্ষের সঙ্গে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকারও তাই পেল নিষ্ঠুর ঘাড়ধাক্কা।
১৯৭৭-এ রাজ্যে এল এক ঝাক দল নিয়ে গঠিত বামফ্রন্টের সরকার—আসলে কিন্তু সিপিএম দলেরই সরকার। প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙারদের মত চতুর বামপন্থী নেতৃবৃন্দ হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন যে দুটো যুক্তফ্রন্ট আমলের অরাজকতা সম্পূর্ণ পরিহার করে নতুন পদ্ধতিতে রাজ্য শাসন করতে হবে। সেই কৌশলের মূল ভাবনাটাই ছিল ধীরেসুস্থে স্লো পয়জনিঙের ঢঙে গোটা বঙ্গসমাজকেই নতুন করে গড়ে পিঠে নবআঙ্গিকের প্রচলন।
কিন্তু অচিরেই বামপন্থীরা নখদাঁত প্রকট করতে শুরু করল। সমাজের বুদ্ধিমান অংশ বুঝতে শুরু করলবামপন্থার উদ্দেশ্য হলো সমাজকে মুঠোয় পোরা এবং তারপর তাকে দানাপানি খাইয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে সাহায্য করা। অনেক প্রকৃত কৃষক চাষের জমি পেল, তৃণমূল স্তরে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলো—কিন্তু সব কিছুই চলে এল নেতৃত্বের দৃষ্টিপাতে। বেতনভুক সরকারি কর্মচারীরা কৌটিল্যের আমল থেকেই ‘ঘুষখোর’ বদনামের ভাগী—কিন্তু জনগণ মনে করত থানার বড়বাবু বা ডি এম সাহেবের কেরানি পয়সা চান বটে, কিন্তু তারা সকলেই নিরপেক্ষ। সেই সরকারি কর্মচারিরাই ক্রমে ‘কমরেড’ তকমা পেতে শুরু করলেন—সাধারণ কর্মচারী থেকে শুরু করে ছোট-সেজ-মেজ হয়ে শেষ পর্যন্ত গেরম্ভারি বড় সাহেবরাও কমরেডের গোয়ালে খোঁটাবদ্ধ হলেন। এই পর্যায়ে শেষ এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ লালঝান্ডাধারীরা হলেন ডাক্তারবাবুরা। এই সর্বনাশা অকাজটা করতে সিপিএমকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তৃতীয় বামফ্রন্টের আমলে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরিষেবাবিধির উদ্দেশ্যমূলক এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পরিবর্তন সাধন করে তাদের কবজা করতে হলো। বিজয় উৎসবের ঢঙে মৌলালি যুবকেন্দ্রে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার দুই সিপিএম মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গোড়াপত্তন হলো সরকারি ডাক্তারদের প্রথম ধামাধরা সংগঠন।
পৃথিবীর ইতিহাসই দেখিয়ে দিয়েছে কোনও জনগোষ্ঠীই বন্দি জীবনযাপনে রাজি হয় না। স্বাভাবিক নিয়মেই বঙ্গসমাজও আনল পরিবর্তন। কিন্তু অচিরেই উপলব্ধি হল—পথভ্রষ্ট শাসকের পরিবর্তে এসে হাজির হয়েছে দুবৃত্তবাহিনী। আজকের। পশ্চিমবঙ্গ যে দুবৃত্তবাহিনীর হাতে বন্দি তাদের নেত্রী সম্পর্কে যথাযথ পরিচিতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তীক্ষ্ণ লেখক, অর্থনীতির সফল অধ্যাপক এবং প্রথম দিকের বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র।
বতর্মানে বাঙ্গালি এই দুর্বৃত্ত শাসনেই বন্দি। শাসনব্যবস্থার অন্য কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী আসবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গভীরে। কিন্তু বর্তমান অবস্থাতেও গ্রামবাঙ্গলায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে কিছু সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং সভ্যতার ইতিহাসেই পেয়েছি। গ্রামেই সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল। এই প্রচেষ্টাটা হতে পারে দ্বিমুখী—পল্লীজীবনের সমাজের সেই পুরোনো ছন্দকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন। কিন্তু এতসব কিছু করতে গেলে ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সমাজ উন্নয়নে নিয়োজিত কোনও সুসংবদ্ধ জনগোষ্ঠী হয়তো এমন উদ্যোগ ভবিষ্যতে গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস রাখাই একমাত্র সদর্থক প্রার্থনা।
বলাইচন্দ্র চক্রবর্তী
2019-08-22