স্বৈরাচারী মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিদিনই পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি ঘটছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজধর্ম ছেড়ে বেছে নিয়েছেন রাজনীতির পথ, সাম্প্রদায়িকতার পথ, প্রতিহিংসা নেওয়ার পথ। তৃণমূল নেত্রী ও তার দলের নেতা-কর্মীদের মুখের ভাষা ও আচরণ দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গবাসী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে বাস করছে। এখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলতে কিছুই নেই। পশ্চিমবঙ্গবাসী স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রায় সবক্ষেত্রেই এই ধর্মীয় মেরুকরণ করে দিচ্ছেন। শুধু ধর্মীয় নয়, এরই পাশাপাশি জাতিগত মেরুকরণ করেও রাজ্যজুড়ে একটা অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছেন। আর বিভেদের এই বীজ বপন করছেন স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি কোথায় সবদলের নেতা নেত্রীদের নিয়ে বৈঠক করে সমাধানসূত্র বের করবেন, তা না করে তাতে তিনি ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন। রাজ্যের যা পরিস্থিতি তা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আলগা হচ্ছে। এমতাবস্থায় এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মীদের ক্ষোভ, শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মীদের ক্ষোভ, আইনজীবীদের ক্ষোভ, ডাক্তারদের ক্ষোভ, বেকার যুবক যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষোভ। বিভিন্ন স্তরের মানুষ নানাভাবে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। এর প্রতিফলন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে পড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে মন্তব্য করছেন তাতে তাকে অনেকেই স্বৈরাচারী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ব্যাখ্যা করছেন।
সম্প্রতি এনআরএসে ডাক্তার পেটানোকে কেন্দ্র করে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন যেভাবে ব্যাপক আকার নিয়েছে, তার পিছনে মুখ্যমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব অনেকটাই দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। এস এস কে এম-এ গিয়ে যে ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী কার্যত হুমকি দিয়েছেন। তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। চিকিৎসকদের এই আন্দোলন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক পতাকার তলায় সংগঠিত হয়নি। আন্দোলনকারীরা তাদের ‘অরাজনৈতিক অবস্থানের কথা বার বার বলছেন। বিষয়টি সর্বভারতীয় স্তরেও আলোড়ন তৈরি করেছে। তির রাজ্য সরকারের দিকে।
আর এস এসের পক্ষ থেকে সাংবাদিক বৈঠক করে বলা হয়েছে এই ঘটনার জন্য দায়ী মুখ্যমন্ত্রী। তাদের আরও দাবি চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বাড়ালেই সমস্যা মিটে যেত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিজেপির চিকিৎসক সাংসদ সুভাষ সরকার বলেন, মমতা যে ভাষায় কথা বলেছেন তাতে সমস্যা বেড়েছে।
রাজ্যের চিকিৎসক ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলেন, এনআরএসে চিকিৎসক বিগ্রহের প্রায় ৬০ ঘণ্টা পরে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর এসএসকেএম হাসপতালে গিয়ে তিনি যা বললেন তাতে রাজ্যজুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্কট কাটার বদলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। আন্দোলনকারীদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তা কার্যত হুমকি এবং দুর্ব্যবহারের শামিল। ফলে কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা অনড় ছিলেন। জুনিয়র ডাক্তাররা ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী প্রকারান্তরে তাদের। শাসিয়েছেন বলে মনে করছেন প্রবীণ আমলারাও।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের আঁচ পড়ে আরজি কর, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। পাশাপাশি প্রবীণ। চিকৎসকদের অনেকেই বলেন, জুনিয়র ডাক্তারদের বহিরাগত আখ্যা দেওয়া, তাদের হস্টেল ছেড়ে চলে যেতে বলা, তাদের রাজনৈতিক দলের কর্মী তকমা দেওয়া, এন আর এসে জুনিয়র ডাক্তারদের মার খাওয়ার ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতার ছাপ দেগে দিয়ে ঠিক করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তার মন্তব্যের প্রতিবাদে প্রবীণ চিকিৎসকরাও মিছিল করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা পদত্যাগপত্র পাঠাতে শুরু করেন।
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের যেভাবে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলেন, তানাশাহি চলছে, হিটলার মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করুন। তিনি আরও বলেন, আহত ডাক্তারদের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই। উলটে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। এটা স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রকাশ। হিটলারকেও হার মানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেভাবে ২ ঘণ্টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের হস্টেল ছাড়তে বলেছেন, তা অনৈতিক। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নমনীয় হয়েছেন। জুনিয়ার ডাক্তারাও কর্মবিরতি তুলে নিয়েছেন।
অন্যদিকে ‘জয় শ্রীরাম’ নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠল মুর্শিদাবাদের কান্দি। কান্দি থানার লাহার পাড়া গ্রামে জয় শ্রীরাম ব্যানার, ফ্লেক্স। লাগানোর ‘অপরাধে’ এক পরিবারের সাত সদস্যকে মারধরের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আরামবাগ থানার কালীপুর কলেজ এলাকায় জয় শ্রীরাম ধ্বনি উচ্চারণ করায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হামলা চালায়। ক্যানিংয়ে বিজেপি করার অপরাধে দম্পতিকে মারধর করা হয়। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় রাতের অন্ধকারে বিজেপি কর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর ও মারধর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। এক্ষেত্রে পুলিশ এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে আক্রান্তদেরই নানাভাবে কেস দিয়ে গ্রেপ্তার করছে। এই রাজনৈতিক হিংসায় প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে।
লোকসভা নির্বাচন পরবর্তীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিকল্পনামাফিক দুটি তাস খেলে পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করতে চাইছেন। একটি হল ধর্মীয় মেরুকরণের তাস ও অন্যটি হলো জাতিগত মেরুকরণের তাস। তৃণমূল নেত্রী চাইছেন পশ্চিমবঙ্গে যদি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানো যায়, তাহলে তার দায় বিজেপির ঘাড়ে ঠেলা যাবে। পাশাপাশি বাঙ্গালি-অবাঙ্গালিদের মধ্যেও যদি দাঙ্গা লাগানো যায়, তাহলেও ফায়দা তুলবে তৃণমূল। এসবেরই দায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে বিজেপি নেতৃত্বের উপর। বাঙ্গলায় বিহার থেকে অবাঙ্গালি এনে ঝামেলা পাকানোর তত্ত্ব তুলে বাঙ্গালিয়ানার প্রচার করতে চাইছেন। বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। তিনি বলেন, বিহারিদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে তৃণমূল। তাই এবার। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচারে নামতে চলেছে জেডিইউ-এর বাংলা শাখা।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে কিছুদিন আগে আইনজীবীদের উপর হামলা হয়। তার প্রতিবাদে আইনজীবীরা আন্দোলনে যায়। সম্প্রতি চিকিৎসকদের উপর হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এর ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা শিকেয় উঠে গিয়েছে। এরও কিছুদিন আগে স্কুলে দু’মাস ছুটি ঘোষণা করে দিয়ে রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে লাটে তুলতে চেয়েছিল রাজ্য সরকার। এ নিয়ে রাজ্যের মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। প্রশ্ন ওঠে এই দু’মাসের মিডডে মিলের এত টাকা কোথায় গেল? বিরোধীরা অভিযোগ করেন সেই টাকার একটা অংশ তৃণমূল সরকার নির্বাচনের কাজে লাগিয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের উপর চলছে ব্যাপক হামলা, আক্রমণ, হিংসা, প্রতিহিংসা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে গ্রামবাংলার বাসিন্দারা। অসহায় মানুষ পুলিস প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে হচ্ছেন চরম অপদস্থ ও হেনস্তার শিকার। পশ্চিমবঙ্গে তাই আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কি মনে করছেন স্বৈরাচারী শাসন চলবে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্ধত্য ও অহংকার দেখার জন্য বাংলার মানুষ বসে নেই। রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা নেই বলে এই ঘটনা ঘটছে। দিদির স্বৈরাচারী মানসিকতা আজকে আইনশৃঙ্খলা অবনতির প্রধান কারণ।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে হাহাকার চলছে, তেমনি গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অরাজকতা, হুমকি, ধমকি, হিংসা আর প্রতিহিংসার খেলায় শাসকদলের নেতা-কর্মীরা মেতে উঠেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ভদ্রতার মুখোশ এবার খুলে গিয়েছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর এখন আর তার মুখে নেই। লোকসভা ভোটে হেরে যাওয়ার গ্লানিতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট নাবিকের মতো অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। তার এই মানসিকতা অস্থিরতাও বাঙ্গলার আইনশৃঙ্খলা অবনতির জন্য দায়ী। তিনি বাঙ্গলার মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন, নিজের দলের কর্মীদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাই শিক্ষাসংস্কার আইন ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। বাঙ্গলার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাঙ্গলার মানুষ শান্তি চাইছেন। একজন বিচক্ষণ প্রশাসক চাইছেন, সুশাসন চাইছেন। মুখ্যমন্ত্রী কি সেই সুশাসন দিতে পারবেন?
সরোজ চক্রবর্তী
2019-06-29