বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সাল। বারোটা দশ মিনিটে কবিগুরুর শেষ নিঃশ্বাস ক্রমে ক্রমে ধীর হতে হতে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল (নির্বাণ পৃ. ৪৬)। তিনি ছিলেন বিশ্বের কবি। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার সংস্পর্শে ছিলেন না তিনি। যে সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তার কাম্য ছিল তার মৃত্যুর পর তার অন্তিম যাত্রা হবে নীরবে শ্রদ্ধাবান শোকযাত্রা।নয় কোনো শব্দমুখর শোভাযাত্রা। নয় কোনো আড়ম্বর। তিনি চাননি তাঁর আত্মাহীন অসহায় দেহ যেন বহু মানুষের হস্তস্পর্শে কলুষিত হয়। কিন্তু কী হয়েছিল সেইদিন? কেমন করে অন্তিম যাত্রা হয়েছিল সেই ঋষিকল্প মানুষটির মরদেহ?
কলকাতার রাজপথে সেদিন জনতার আচরণ সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল। দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাদের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় সেই বীভৎস আর কুৎসিত আচরণ নথিভুক্ত করে গেছেন। প্রথমজন তপন রায়চৌধুরী তার বাঙালনামায় পৃষ্ঠা-৯৭ (অধ্যায়-গুরুকুলবাসপ্রথম পর্ব)-এ লিখছেন—“জোড়াসাঁকো গিয়ে এমন দ্বিধাহীন বর্বরতার দৃশ্য দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। প্রচণ্ড চেঁচামেচি ঠেলাঠেলি চলছিল। জনতার চাপে ঠাকুরবাড়ির লোহার গেট ভেঙে গেল। মানুষের ভিড় এত বেশি যে, আমাদের পা প্রকৃতপক্ষে যেন মাটি খুঁচ্ছিল
। এরই মধ্যে হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে মানুষের মাথায় মাথায় উপর দিয়ে খাটের উপর শোয়ানো ওঁর দেহ বেরিয়ে এল (ভিড়ের চাপে খাট বের করবার সামান্যতম জায়গা ছিল না)। আর অনেক লোক ওঁর চুল দাড়ি ছিড়ে নিচ্ছিল। কবির দেবদেহ শুধু মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম। বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে। শুধু জাতীয় শোকের দিন নয়, জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে। এই বর্বরতার নায়করা যতদুর দেখতে পেলাম তথাকথিত ভদ্র বাঙ্গালি ছাড়া আর কেউ নয়।”
দ্বিতীয়জন সত্যজিৎ রায়-জায়াবিজয়ারায় তাঁর ‘আমাদের কথা’ বইতে জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন এই ঘটনা। তিনি এই ষষ্ঠ অধ্যায়ের নামই দিয়েছেন ‘আমার জীবনের এই অধ্যায়টা আমি ভুলতে চাই। পৃষ্ঠা ৭০-এ তিনি লিখেছেন—“রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু এখন আমার চোখের সামনে ভাসে। যে মানুষটিকে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জিনিয়াস বলে আমি মনে করি, তিনি কিন্তু সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহটাকে নিয়ে যে তাণ্ডব নৃত্য হয়েছিল, সে কথা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। এখন যেমন ট্রাকে করে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়, তখনকার সময় তার চল ছিল না। শববাহীরা খাট বহন করে নিয়ে যেতেন, তার পরিণামটা যে কী ভয়ংকর হয়েছিল তা সকলেই জানেন। কাধের উপর খাট বহন করে যাচ্ছিলেন বহু বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে দেহটাকে পেয়ে যা কাণ্ড করেছিল, ভাবতে এখনও আমার মাথা লজ্জায় নুয়ে আসে। হাত-পা ধরে টানা, দাড়ি ছেড়া, চুলছেড়া, শোকে যেন সবাই পাগল হয়ে গিয়েছিল। এরকম একজন মানুষের প্রতি কোথায় শ্রদ্ধা জানাবে, তা না করে এরকম নারকীয় বর্বরতা যেন কল্পনা করা যায় না। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল। আর দেখতে পারলাম না। বললাম, এভাবে তো ওঁর দেহ শ্মশানে পৌঁছতেই পারবে না। পরে অবশ্য পুলিশের সাহায্যে দেহ অক্ষত অবস্থায় না হলেও শ্মশানে পৌঁছতে পেরেছিল।”
রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায় পুলিশের ডিউটিতে ছিলেন পুলিশ কমিশনার চার্লস। টেগার্ডের স্নেহভাজন বিশেষ পুলিশ অফিসার পঞ্চানন ঘোষাল। এই প্রসঙ্গে পঞ্চানন ঘোষাল সম্বন্ধে কিছু বিবরণ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সামাজিক উপন্যাস লেখক এই পঞ্চানন ঘোষালকেই সাক্ষাতে কবিগুরু বলেছিলেন— “তুমি পুলিশে ঢু কেছ। ভারতীয় ক্রিমিনোলোজিবিষয় গবেষণা কর। এর বাংলা হবে অপরাধ বিজ্ঞান। আর যদি উপন্যাস। লিখতে হয়, অপরাধীদের জীবন-চরিত্র ভিত্তিক ক্রাইম উপন্যাস লেখ।” পঞ্চানন ঘোষাল সে উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মান্য করেছিলেন। তার লেখা ‘পুলিশ কাহিনি— আমি যখন পুলিশ ছিলাম’ইত্যাদি গ্রন্থগুলি বাংলায় লেখা। অপরাধ বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। পঞ্চানন ঘোষাল পেশায় ছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের অফিসার কিন্তু মনটি স্বদেশিয়ানায় পূর্ণ ছিল।
যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুসারে জানা যায়, বেশ কিছু মানুষ কবির দাড়ি ও চুল ছিড়ে নিয়েছিল কিন্তু পঞ্চানন ঘোষাল রিপোর্টে জানালেন যে ঘটনাটি রটনামাত্র। মাত্র একজন যুবক ওইরকম বিভ্রান্তমূলক রটনার নায়ক। পরের অংশটুকু পঞ্চানন ঘোষালকেই উদ্ধৃত করা যাক। তিনি লিখলেন—“ওই ছোকরার বাড়ি তল্লাশি করে ওগুলো আমরা সংগ্রহ করি। আসল না নকল বোঝা গেল না। ইংরাজ ডেপুটি সাহেবের নির্দেশে তা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হলো, নইলে ওগুলি আরও জাল হতো এবং ভবিষ্যতে কবির যা দাড়ি পাওয়া যেত তার ওজন হতো কয়েক টন’ (আনন্দবাজার রবিবার ২০.৯.১৮)। কবিগুরুর ওই আসল অথবা নকল দাড়ি ও চুল সংগ্রহকারী যুবকের শেষ পর্যন্ত কোনো শাস্তি হয়েছিল কিনা অবশ্য জানা নেই।
বেদ মোহন ঘোষ
2019-08-02