কাঁঠাল নিয়ে নানান বাগধারা (আসলে বাগাড়ম্বর) আছে বাংলায়। যেমন, “গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল”। আরে বাবা, গোঁফে আজকাল কেউ তেল দেয় না, জেল দেয়। কাঁঠালের সেই সুদিনও কি আর আছে! কেউ পোঁছে না। এইসব দিশি ফলের কদর হরেদরে কমেছে বিস্তর। এখন কিউই, ড্র্যাগন ফ্রুট, প্যাশন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাকবেরির কি ক্রেজ! নামেই যাকে বলে ঘ্যাম ছুটে যায়। দামে এ্যারিস্টোক্রেজি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। বসার ঘরের টেবিলে কাঁচের পেল্লায় বাটিতে তরিবত করে সাজিয়ে রাখলেই কেল্লাফতে। অদৃশ্য সেই সিঁড়ি, তাতে চড়বার জন্য কি যে হুড়োহুড়ি! কাঁঠালের মতো এমন বদখত বিদঘুটে কাঁটাওলা আঠাওলা গেঁয়ো ফলের আশিক তো কমবেই! তবে হ্যাঁ, যারা চেনে তারা আজও কাঁঠাল কেনে।
বাজারে কাঁঠাল আসে গাদিয়ে, ট্রাকবোঝাই হয়ে। রাস্তার ওপরেই গড়গড়িয়ে গড়িয়ে দেয় সব। এক একটি চেহারায় যেন সবুজ উলের নক্সাকাটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কচি খোকা! আহা! তা বলে ধুলোয় কাদায় গাদিয়ে রাখবে গা! বলি, আর আর যত ফল, তাদের বেলায় কত যত্নআত্তি! ফোমের জালি মুড়ে রাখো আপেল, নাসপাতি, কমলালেবু, বেদানা এমনকি আম! মোটা কাগজের ফুটোওয়ালা প্যাকেটে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে থোকা থোকা খোকা আঙুর! আর কাঁঠালের বেলায় যত অযত্ন, অনাদর! বলি কাঁঠাল কি সতীনের ছেলে গা!
তারপর কাঁঠালের নামে অযথা দোষ দেওয়া তো আছেই! ব্যঙ্গ বিদ্রূপও। “পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া”! বলি, কাঁঠাল কি কাঁচের চুড়ি না খটখটে শুখা কাঠ! কই একখান কাঁঠাল ভেঙে দেখান দিকি! রসে টইটম্বুর একটি ফলের নামে এ কি অন্যায্য অন্যায় বেরসিক অভিযোগ! দুটি হাতে সপসপে সর্ষের তেল মেখে কাঁঠাল ছাড়িয়ে খায় লোকে। হাতের কাছে জব্বর একখান ঝ্যাঁটা নিয়ে বসতে হয়। কাঁঠালের কি নেশা! গন্ধ পেয়েই মৌতাত জমাতে দৌড়ে আসে ডুমো ডুমো কালো মাছির দল! ভোঁ ভোঁ বোলের সাথে সাঁই সপাৎ ঠেকায় যুগলবন্দি জমে ওঠে গ্রীষ্মের দুপুরে। এর মাঝে “কারও মাথায় কাঁঠাল ভাঙা” র তুলনা! তওবা, তওবা! পেরেকের মতো বুকেই গিয়ে সেঁধিয়ে যেত মাথাখানা নির্ঘাত! অতঃপর পপাত ধরণীতলে। কি প্যাথেটিক ট্রাজিক ড্রামাটিক ইঙ্গিত। কোথায় প্রেমরস আর কোথায় অপযশ!
প্রেমের কথায় ফ্রেমে আরেকটি কথা উঁকি দেয় দেখি! “পিরীতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না।” ফের কাঠগড়ায় কাঁঠালকে অকারণে টানা! সিকি আধুলি মার্কা একতরফা কিছু খুচরো প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ‘পিরীতির আঠা’ অতীব অশালীন শব্দ জোড়। প্রেম অতি পবিত্র এক অনুভূতি। ঐশ্বরিক। স্বার্থশূন্য, উদার, নৈসর্গিক সে অনুভব দয়িতের সুখে উল্লসিত হয়, দয়িতের দুখে বিমর্ষ। প্রকৃত প্রেম নৈকট্যাভিলাষী নয়, বরং দূরত্বে ঘন হয়। চিপকে থাকা অবাধ্য অশিষ্ট বেয়াদব বিরক্তিকর আঠার সাথে তুলনা! ছ্যা ছ্যা, ছিঃ! ধিক্কার জানানোর ভাষা নাই।
তবে হ্যাঁ, “কাঁঠালের আমসত্ত্ব” অতটা অন্যায় কিছু কথা নয়। আমসত্ত্ব নাই হোক, কাঁঠালসত্ত্ব চাইলেই করা যায়। খেতেও মন্দ নয়। খানিক ঘন করে ফুটোনো দুধ মিশিয়ে নিলে তো আর কথাই নেই।
কাঁচা কাঁঠালের দিওয়ানা অবশ্যি লাখো লাখো। ভালোবেসে লোকে যাকে বলে এঁচড়। কাঁঠাল কিন্তু খাঁটি দেশীয় ফল। এ দেশেরই আদিবাসী। দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলই কাঁঠালের আদি বাসভূমি। আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে কাঁঠাল। পশ্চিমে কাঁঠালের সব্জি ও ফল হিসেবে বিস্তর খাতির, কদর।
সে কিছুকাল আগের কথা।
আমার এক দূরসম্পর্কীয় দাদুর কথা। সদ্য সদ্য রিটায়ার করেছেন সেসময় সরকারি চাকুরি থেকে। এক অখ্যাত অথচ নিরিবিলি রেলস্টেশনের পাশে তাঁর সাধের আস্তানা। যাতায়াতের সুবিধে হবে বলে ওখানে টুকটুক করে জমি কিনে বাড়ি বাগান দিঘি সব বানিয়েছিলেন দাদু। বেশ খোলামেলা বিশাল বাগানবাড়িই হয়ে গেছে ততদিনে।
তো গেছি দাদুর বাড়ি গরমের ছুটিতে। বেড়াতে। মা ওখানে ছেড়ে দিয়ে কাছের আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন দু’দিন।
দাদুর আমার দুধেআলতা গায়ের রঙ। লম্বাচওড়া দশাশই চেহারা। মাথা ভর্তি চুল। তবে সব পেকে সাদা। অমন চেহারা রইলে কি হবে, তিনি একেবারে যাকে বলে মাটির মানুষ। পা দুটি ছুঁলেই কাদা। গমগমে গলায় দিলখোলা কথা আর প্রাণখোলা হাসিতে যে কারও মন আহ্লাদে খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠবেই উঠবে।
দিদুন সে তুলনায় বেশ মেজাজি মানুষ। জগতের নিয়মই বোধকরি তাই। একে অপরের পরিপুরক। ছোট্টখাট্টো বেঁটে গোলগাল মানুষটি বাইরে কঠিন কঠোর হলে কি হবে, ভেতরে একেবারে ক্ষীরের মতো নরম তরল আর মধুর মতো খাঁটি মিষ্টি।
“গরমে দিঘিতে নাইতে যাই, দিদুন?”
-“না, কখ্খনো না, ভাই। ওই দিঘি কত গভীর জানিস! বাব্বা, তারপর ইয়াব্বড় বড় সব গোসাপ আছে ঘাটের তলায়! আমি যতনকে বলে কুয়ো থেকে জল তুলে রেখেছি। তেল মেখে ঠাণ্ডা জলে স্নান করলে দেখবি, কি আরাম!”
“দিদুন, আজ কিন্তু মাংস খাবো।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাবো তো। আজ মাংস করব বলেই তো তোর দাদুকে সকাল থেকে তাড়া লাগাচ্ছি। বাবুর কি সেসব দিকে খেয়াল আছে। শুধু গপ্পের বই! চশমাটি চড়িয়ে, মুখ ঢুকিয়ে বসে আছেন কেদারায়! বলি, ঢের ঢের লোক দেখিছি, এর’ম একটি পিস আজ অব্দি দুটি দেখলুম না। বোধহয় গরমিল টের পেয়েই সাথে সাথে তিনি ছাঁচখান ভেঙে দিয়েছেন গো। বলি, ওগো শুনছো…”
আমি যারপরনাই উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত, আহ্লাদিত, হ্যাপিত, খুশিত হয়ে ভাবতে লেগেছি, আরে বেটা, কেমন হল এটা! আসলে দাদু দিদা দুজনেই কোনও গুরুদেবের দীক্ষিত ভক্ত। মাছ, মাংস, ডিম, রসুন, পেঁয়াজ কিস্যুটি মুখে তোলেন না। এ বাড়িতে এসে তক্কো ছানার তরকারি, দই, দুধ টুধ আর শাক সব্জি খেয়ে খেয়ে নিজেকে কেমন একটা গৌ গাবৌ গাবঃ টাইপের ফিলিং হচ্ছে। আজ এককথায় মাংসের আর্জি মঞ্জুর শুনে দিল ইডেন গার্ডেন বিবাদীবাগ হইং গেল। মুখে তো জল নয়, পাঁঠাভর্তি বাটির চেহারা ভেবেই পুরো নায়াগ্রা জলপ্রপাত নামতে লেগেছে।
বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি দাদু একখানি ছিটে বন্দুক নিয়ে কসরত করছেন। এয়ারগান। এটার ওপর আমার বেজায় আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কোথায় যে লুকিয়ে রাখে! আজ দেখছি দিনটা একেবারে যাকে বলে দাগা দিন!
“দাদু, বন্দুক নিয়ে কি করবে গো!”
“আহা! বন্দুক দিয়ে কি করে লোকে! শিকার করব রে বাবু, শিকার।”
“শিকার? কি শিকার করবে? পাখি?” পাঁঠার বাটি আবছা হয়ে আসছে ক্রমশ। পাখি! ছ্যা, ছ্যা! পাখি কে খাবে?
“সে দেখবি ‘খন। তোর দিদুনকে কথা যখন দিইছি। আচ্ছা, তুই যাবি নাকি সাথে! চল। দিঘির পেছনটা ছোটখাটো একটা জঙ্গলই হয়ে গেছে। চপ্পল পরে আয়।” দাদুর আহ্বান উপেক্ষা করার সাধ্য কি আমার। বেশ একটা রোমহর্ষক রোমাঞ্চকর শিকারের গন্ধ পাচ্ছি তখন। দাদু পড়ে শুনিয়েছেন ক’দিন আগেই, জিম করবেট, জয় এ্যাডামসন।
“বলিহারি যাই বাপু, তোমার আক্কেলকে! বলি বই পড়ে পড়ে নিজের মাথাটি তো গেছেই। বন্দুক নিয়ে ‘শিকারে’ চল্লেন উনি! ঢং দেখে আর বাঁচিনে। বলি রান্নাটা তো আমাকেই করতে হবে, নাকি! বন্দুক রাখো, এই দা’টা নিয়ে যাও। আমারই হয়েছে যত জ্বালা।
এ্যাই, তুই এক পা’ও ওদিকে যাবি না। সাপ খোপ কত কি আছে! এই বড় বড় ঘাস! চলে আয় বলছি। আয় বাবা, কথা শুনতে হয়। মা কি বলে গেছল মনে নেই?”
ঠিক, মা বলে গেছিলেন দিদুনের কথা শুনতে। অগত্যা। দাদু লম্বা লম্বা পা ফেলে দিঘির পারের সারি সারি নারকেল গাছগুলি পেরিয়ে বন্দুক কাঁধে চলে গেলেন শিকারে। সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট বুকে দীর্ঘশ্বাস পাক খেয়ে ঘোঁত করে ডুবে গেল।
“আচ্ছা, দিদুন, দাদু মাছ মাংস ডিম খায় না, তবুও শিকার করে! এটা কি ঠিক হল?” পায়ের চটি দুটি সামনে ছুঁড়তে ছুঁড়তে আর ধরতে ধরতে গোমড়া মুখে বলি আমি।
“হো হো হো… বেড়ে বলেছিস তো বাবু! আরে ধুর, তোর দাদুর যত খেয়াল। ঐ বই পড়ে পড়েই ওঁর শিকারের নেশা চেপেছে। দুপুরে দুপুরে বগলে বন্দুক চেপে পেছনের বাগানে ঘুরে বেড়ায়। যতন তো দেখেছে হামাগুড়ি অব্দি দিতে। বয়সে মাথাটা গেছে, বাবা। চিন্তা হয় রে বাবু। চিন্তা হয়।”
ঘন্টা খানেক পরে দাদু ফিরলেন। ততক্ষণে দিদুনের মশলাপাতি সব রেডি। শশার বীজ, কুমড়োর বীজ, তরমুজের বীজ, পোস্ত সব একসাথে বেটে ইয়াব্বড় একতাল বানিয়েছেন। আমি একটি আমসত্ত্বের ডেলা চাটতে চাটতে সব লক্ষ্য রাখছি।
“কই রে, দেখ কেমন নধর পাঁঠা মেরে এনেছি!” এ তো দাদুর গলা! তাকিয়ে দেখি দুই হাতে দুইটি এ্যাত্ত বড় বড় কাঁঠাল, মানে এঁচড় তখন, ঝুলিয়ে সহাস্য বদনে দাদু দাঁড়িয়ে। যত্রতত্র এঁচড়ের গা বেয়ে ঠসঠস করে সাদা আঠা ঝরছে।
“আচ্ছা, আক্কেল বলে কিছুই কি নেই তোমার! মেঝেটায় যে আঠা পড়ছে সে খেয়াল নেই? সেই সদর থেকে উনি আঠা ফেলে ফেলে আসছেন। এখন একটি ঘন্টা যাবে আমার আঠা মুছতে। আর পারি না বাপু। যাও, ওখানে কলের পাশে রেখে এসো দেখি। কি শিকারি পুরুষ এলেন গো বিশ্বজয় করে!”
“গিন্নি, ও কথা বললে হবে না, বুঝলে। টিপ করে একবারে মগডালের ওপর থেকে নামিয়েছি, বুঝলে। করবেট সাহেব বেঁচে থাকলে নির্ঘাত প্রাইজ টাইজ দিতেন জানো। গর্ব হয় না তোমার। বিশ্বের এক এবং অদ্বিতীয় নিরামিষ শিকারি তোমারই বিয়ে করা স্বামী। গর্ব করো, বুঝলে গর্ব করো।”
সামরিক কায়দায় লম্বা লম্বা মাপা পা ফেলে শিকার দুটিকে কলের কাছে রেখে আমার দিকে চেয়ে এবার দাদু বললেন, “গাছপাঁঠা বুঝলি, একে বলে গাছপাঁঠা। কোথায় লাগে এর কাছে পাঁঠার মাংস! আজ খাস আমার শিকার। মাংস খাবি বলেছিলি না! এই হল শ্রেষ্ঠ মাংস।”
দিদুন তখন ওদিকে তেলে চুবোনো ন্যাতা দিয়ে মেঝে ঘষতে ঘষতে গজগজ করতে লেগেছেন, “হুঁ, নিরামিষ শিকারি! আজ ধুন্দুল, কাল আমড়া, এঁচড় এই সব ওনার শিকার! পারও বটে! বুড়ো বয়সে যত ভীমরতি!”
আমার ঘোর তখনও কাটেনি। তবে দাদুর টিপের নমুনা দেখে আমারও হাত নিশপিশ করছিল বটে!
সুপ্রীতি মাইতি