প্রথম আদি তব শক্তি–

আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে

             গগনে গগনে ॥

তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,

জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে ॥

পৃথিবীর আদিম , প্রাচীন , সয়ম্ভূ  এবং এক ও অদ্বিতীয়ম্ ধর্ম হল সনাতন। সনাতন শব্দের অর্থ হল – যার না আদি আছে না অন্ত। সকল পৃথিবী প্রতিটি প্রাণী জন্মের প্রথম লগ্নে সনাতনীই হয়। সম্পূর্ণ অখন্ড ভারতের বহু স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যচালিয়ে বহু দেবদেবীর মূর্তি, মন্দির, প্রাসাদাদির প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সুদূর বিদেশেও সে সকল বস্তুর প্রাপ্তি ঘটেছে। এমন ঘটনা আমরা প্রায়ই জানতে পারি বা খবরে দেখতে পাই বিদেশে খনন কার্যে প্রাপ্ত বহু দেবদেবীর মূর্তি নিলাম করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এছাড়াও দেশীয় মূর্তি, ফলক ইত্যাদিও বিদেশে পাচার হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে, বিষয়টির কোনো সুরাহা হয় নি।

আজ আমি আপনাদের এমনই এক সনাতনী মূর্তির কথা বলব । সেই মূর্তির নাম কল্পবিগ্রহ, সেই মূর্তি রহস্যময়। এই কল্পবিগ্রহ মূর্তিটি আদিদেব মহাদেব শিবের এবং এই মূর্তিকে বিশ্বের সব থেকে প্রাচীন মূর্তি হিসাবে গন্য করা হয়। হ্যাঁ ,আপনি সঠিক পড়ছেন সব থেকে প্রাচীন , আদিম মূর্তি। এই মূর্তির ইতিহাস কোনো থ্রিলারের থেকে কম কিছু নয়। 

সালটা ১৯৫৯ , তখন সন্ন্যাসী তিব্বতে সাম্রাজ্যবাদী চীন তার আগ্রাসন চালাচ্ছিল। এই সময় মার্কিনি গুপ্তচর সংস্থার নিকট আদেশ আসে তিব্বতে Lo Manthang এলাকায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সাহায্য করতে হবে এবং তাঁর থেকে কিছু জরুরী তথ্য ও নথিপত্র প্রাপ্ত করতে হবে।

নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ১৯৬০ এর সূচনায় তিব্বতের সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা CIA সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করে। শুরু হয় এক গোপন মিশন…সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাঁর দেহরক্ষীদের তরফ থেকে আলোচিত কল্পবিগ্রহ শিব মূর্তি, কিছু সুপ্রাচীন পান্ডুলিপি এবং আরো কিছু নথিপত্র মার্কিনি গুপ্তচরদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই পুরো মিশনে CIA এর নির্দেশিক জন ম্যাককন ব্যক্তিগতভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

মার্কিনি গুপ্তচর সংস্থা সেই সকল পান্ডুলিপি, নথিপত্র এবং কল্পবিগ্রহটি আমেরিকা নিয়ে চলে যায়। সেই কল্পবিগ্রহটিকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যাবে কার্বন ১৪ ডেটিংয়ের মাধ্যেমে টেস্টিং করকে হয়। সেই পরীক্ষায় এক অদ্ভুত তথ্যঃ সামনে আসে। কি সেই তথ্যঃ ?

কার্বন ১৪ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে সেই কল্পবিগ্রহ শিবমূর্তিটি ২৬৪৫০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের অর্থাৎ , আনুমানিক ২৮৪৫০ বর্ষ প্রাচীন । বর্তমান কাল থেকে হিসাব করলে যা, প্রায় ২৮৪৬৪ – ৬৫ বৎসর প্রাচীন। সেই প্রমাণ প্রাপ্তির পরে ল্যাব ও এজেন্সি গুলি এই মূর্তিকে পৃথিবীর সর্ব প্রাচীন মূর্তি বলে আখ্যায়িত করে। যদিও বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা হল মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতা । তার সমসায়িক সভ্যতাগুলি ছিল মিশরীয়, সুমারীয় এবং চৈনিক সভ্যতা।কিন্তু এই কল্পবিগ্রহটি তারও প্রায় ২০০০০ বৎসর প্রাচীন।

ত্রিকাল প্রাচীন এই মূর্তিকে আমেরিকার গুপ্তচর এজেন্সি CIA ওয়াশিংটনের কোনো এক স্থানে রেখে দেওয়া হয় এবং বহুকাল সেই মূর্তি অসূর্য্পৃষ্য হয়ে থাকে। কিন্তু হঠাৎই একদিন দেখায় সেই সুপ্রাচীন মূর্তিটি আর সেখানে নেই….বহু তল্লাশি চলার পরে জানা যায় যে, কোনো ভাবে সেই মূর্তি হারিয়ে গেছে । কি করে? তা প্রথম অবস্থায় প্রকাশিত হয় নি। পরে জানা যায় সেই মূর্তি গোপনে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল । কে বা কারা সে কাজ করেছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি এবং আদৌ মূর্তি ভারতে আছে কিনা তা নিয়েও বিতর্ক আছে।

কিছুজন মনে করেন সেই সুপ্রাচীন মূর্তি অন্ধ্রপ্রদেশ অথবা হায়দ্রাবাদের নিকটেই কোথাও আছে, কিন্তু কোথায় আছে তার কোনো প্রমাণ নেই।

সেই মূর্তিটি দৈর্ঘ্যে ৫.৩ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৪.৭ সেন্টিমিটার ছিল। ওজন ছিল ৪৭ গ্রাম। যে বাক্সে এই মূর্তিটি রক্ষিত হয়েছিল সেটি কোনো অদ্ভুত এবং বিশেষ প্রকার ধাতু অথবা কাঠের দ্বারা নির্মিত ছিল। মূর্তির নিচে স্বয়ম্ভূ শিব এবং আদি পরাশক্তি দেবী মহামায়ার অকর্তি খোদিত ছিল।

বাইবেলাদি গ্রন্থে বিগ ব্যাংকে ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্ব বলা হয়েছে। এই হিসাবে, উক্ত বিষয়কে সত্য প্রমাণ করার জন্য  নানা প্রত্নতাত্ত্বিক , ঐতিহাসিকরা সিন্ধু, সুমার, মিশরাদি পিরামিড ও অন্যান্য স্থাপত্যকে ওই সময়ের আসে পাশে বলে প্রচার করতে শুরু করে। কিন্তু মহাকালের অশেষ খেলায় যখন ২৮ হাজার বৎসর প্রাচীন মূর্তি আবিষ্কার হয় তখন সকল মত, তর্ক, বিতর্ক কোন অসীমে হারিয়ে যায়। 

এই মূর্তির সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষু যে পাণ্ডুলিপি প্রদান করেছিলেন , শোনা যায় , তাতে এই মূর্তির উপযোগিতা , ব্যবহার ও পূজা পদ্ধতি এবং মূর্তির নাম লিখিত ছিল।  পাণ্ডুলিপি অনুসারে সেই প্রাচীন বিগ্রহের নাম ছিল কল্প মহা – আয়ুষ রসায়ন বিগ্রা। এই কারনেই CIA এই মূর্তিকে কল্পবিগ্রহ বলে অভিহিত করে।

কিন্তু কেন এই মূর্তির জন্য এত পরীক্ষা , এত খরচ? কি ছিল সেই রহস্য ? তা নিয়ে আজও প্রশ্ন থেকে যায়।

মূর্তির হাতে চক্রের ন্যায় অস্ত্র দেখা যায় । যুদ্ধ ক্ষেত্রে চক্রের ব্যবহারকে অন্তিম উপায় বলা হত। ঋগ্বেদ , পুরানাদিতে উল্লিখিত হয়েছে যে আইনব্যবস্থা, সংরক্ষণ ইত্যাদির জন্য এবং শত্রু বিনাশের জন্য চক্র হল অন্তিম অস্ত্র। চক্র শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মার উর্যায় সৃষ্টি হয়েছিল।

সুদর্শন চক্রকে সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। শ্রীবল্লভাচার্য কৃত সুদর্শন কবচ মন্ত্রে বলা হয়েছে , সুদর্শন চক্র ব্রহ্মাস্ত্র , অঘোরাস্ত্র , মৃড়াস্ত্র , যমদণ্ড ,কালপাশ আদি সমস্ত ভয়ংকর দিব্যাস্ত্রকে পরাভূত করতে সমর্থ । এই চক্রকে তিনি উগ্র-প্রলয়-কালাগ্নি-রৌদ্র-বীরভদ্রাবতার পূর্ণব্রহ্ম নামেও অাখ্যায়িত করেছেন ।

শোনা যায় মূর্তি এবং পাণ্ডুলিপি থেকে Scalar wave , zero point energy , ১০৮ সংখ্যা তত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছিল। কি ফলাফল পাওয়া যায় তা আজও রহস্যময় ঘটনা। তবে মূর্তিটি গবেষকদের কাছে কয়েক কোটি অর্বুদ মূল্যবান ছিল তা মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে যেতে বোঝা গিয়েছিল।

পরিশেষে বলি , আপনি গর্বিত বোধ করুন , আপনি সনাতনী । আমি গর্বিত বোধ করি। সনাতন এক প্রাচীন দর্শন, স্বয়ম্ভূ ধর্ম। তাই গীতায় আছে :“শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ”। 


ভৌতিক বস্তু মানুষের দেহের ক্ষুধা সাময়িক ভাবে মেটাতে পারে মাত্র, কিন্তু তার মনের ক্ষুধা, আত্মার ক্ষুধা থেকে যায় অতৃপ্ত। সে ভাবতে থাকে, “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে”। কোথায় গেলে যে মনের শান্তি পাবে সে তা বুঝতে পারে না। ভাবে এটা পেলে হয় তো মনের শান্তি পাবো কিন্তু পাবার পরে মনে হয়- না, ঠিক এটা তো চাইনি। সে তখন বলে ওঠে “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না”। কেননা এ ক্ষুধা তার মনের। আর মনের ক্ষুধা অনন্ত। এই অনন্ত ক্ষুধা সীমিত ভৌতিক বস্তুতে মিটতে পারে না। তাই তো সে অসীমের হাতছানিতে ছুটে চলতে চায় সসীমের বাঁধন ছিড়ে।


“থাকব না আর বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে,কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে”।
এটাই মানুষের অন্তরের চিরন্তন অভিলাষ। সে চায় অনন্ত সুখ। আর অনন্ত সুখই আনন্দ। আনন্দই ব্রহ্ম। তাই মানুষ জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক সেই আনন্দঘন সত্তা ব্রহ্মকে পেতে চায়। কেননা যদি সত্যি আনন্দ পেতে হয় তাহলে এমন জিনিস পেতে হবে যার আদি নেই, অন্ত নেই। যার থেকে সুখ পেয়েই চলেছি……পেয়েই চলেছি……. শেষ আর হচ্ছে না। এই অনন্ত সুখের আধার হলেন পরমপুরুষ, ব্রহ্ম। আর এই পরমপুরুষ বা ব্রহ্মকে পাবার এষণাই হ’ল মানুষের ধর্ম। সেই আদিকে , সেই ব্রহ্মকে প্রণাম করি।

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ 

১.Kalpa Vigraha Oldest Hindu Idol of Lord Siva (26450 BC)

২.KALPA VIGRAHA , VISHNU IDOL CARBON DATED TO 26450 BC, SUDARSHANA CHAKRA – CAPT AJIT VADAKAYIL

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.