বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের ঝরনাধারা যেন ধুইয়ে দিয়েছে দেশবাসীকে। ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের সকল ক্লান্তি সকল বিষাদ। পাঁচবছর পরে সংবিধান অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন হয়েছে। সেই পুনর্মূল্যায়নে এনডিএ জয়ী হয়েছে বিপুল ভাবে। আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক। নির্বাচনী পাটিগণিতে শাসনক্ষমতায় থাকা দলের ভোট কিছুটা হলেও কমে, কিন্তু এবারের নির্বাচন সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। শাসনক্ষমতায় থাকা দলের আসনসংখ্যা ও ভোট দুইই বেড়েছে। এই ব্যতিক্রমী বৃদ্ধির একটাই কারণ এনডিএ-এর জনহিতৈষী কার্যকলাপে দেশবাসী খুশি।
সাধারণ মানুষ খুশি হয়েছে। তাই তো ভোট বাক্সে এই প্রতিফলন। খুশি হয়েছেন সেই মানুষটি এতকাল গৃহহীন থাকার পর মোদী জমানায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় যিনি মাথার ওপর ছাদ পেয়েছেন। মুদ্রা যোজনায় ঋণ পেয়ে খুশি হয়েছেন সেই মানুষটি এতকাল পুজির অভাবে যিনি নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বাস্তুহারা হয়ে ভারতে পালিয়ে আসা সেই মানুষগুলিও এতদিন বাদে দেশের বৈধ নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেয়ে আনন্দে উদ্বাহু হয়ে ভোট দিয়েছেন বিজেপির ঝুলিতে। আবার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়মিত অত্যাচারে জর্জরিত সীমান্ত এলাকার আতঙ্কিত জনসাধারণও তাদের আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন বিজেপির প্রতি। খুশি হয়েছেন সেই দরিদ্র কৃষক যিনি চাষ শুরুর আগে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য পেয়েছেন সরকারের কাছে। খুশি হয়েছেন সেই মুসলমান মহিলারা এতদিন মধ্যযুগীয় তিন তালাক প্রথার জন্য যাদের জীবন ছিল খেলনার মতো। খুশি হয়েছেন সেই কাশ্মীরি পণ্ডিত যিনি দীর্ঘ তিন দশক পরে ফিরতে পেরেছেন নিজের বাড়িতে। সর্বোপরি খুশি হয়েছেন সেই কোটি কোটি দেশপ্রেমিক ভারতীয় যারা বিদেশের মাটিতে দেশের জয়পতাকা উড্ডীন হতে দেখে গর্বিত বোধ করেন, দেশের শত্রু সন্ত্রাসবাদীরা নিহত হলে যারা নিশ্চিন্ত হন।
শুধুমাত্র দেশময় খুশির পরিবেশ সৃষ্টি করাই নয়, এবারের নির্বাচনী ফলাফল আরও নানা কারণে যুগান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত থাকবে ইতিহাসে।
প্রথমত, স্বাধীনতার পর থেকে এতাবৎকাল পর্যন্ত জাতিভেদ প্রথার শৃঙ্খলে আবদ্ধ উত্তরপ্রদেশের ভোটারা এবার জাতপাতভিত্তিক জোটের অঙ্ককে নস্যাৎ করে বিকাশের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। শোষণকারী জাতভিত্তিক নেতাদের বিভেদ ও শাসন উপেক্ষা করে জাতিবিদ্বেষের কানাগলিকে পরিহার করে তারা এবার উন্নয়নের রাজপথকে আপন করেছেন।
দ্বিতীয়ত, সুবিধাবাদী জোট রাজনীতির জাল ছিন্ন করে স্থায়ী সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন দেশের সমস্ত প্রান্তের মানুষ।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন প্রদেশে বিধানসভা আর লোকসভার ভোটে আলাদা দলকে ভোট দিয়ে নিজেদের পরিণত রাজনৈতিক চিন্তাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন জনসাধারণ।
সর্বোপরি শ্যামাপ্রসাদের জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গেও এই নির্বাচনে প্রথমবার দেখা গেল বিজেপির এতখানি আধিপত্য। স্বাধীনতার পর থেকে এতাবৎকাল রাজনৈতিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের অপাংক্তেয় করে রেখে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই সর্বভারতীয় নিরিখে সমস্ত রকম মাপকাঠিতে নিজেকে পেছনের সারিতে নিয়ে ফেলেছিল। আজ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলকে বিজয়মাল্য দিয়ে বরণ করে সেই ঐতিহাসিক পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত পশ্চিমবঙ্গ করলো। এখন নিঃসংশয়ে এই আশা করাই যায় যে, জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনাধীনে পশ্চিমবঙ্গ নিজের পূর্বগৌরব ফিরে পাবে এবং পুনরায় গোটা দেশের পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করবে।
জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের পরে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিই দ্বিতীয় যারা নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে পাঁচ বছর সরকার চালানোর পরে পুনরায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলো। জনসাধারণ ভরসা করেছেন মোদীর ওপর, বিজেপির ওপর। জনগণের অনুগ্রহে সর্বাত্মক ক্ষমতা আজ বিজেপির করায়ত্ত। জনগণের এইভরসার মর্যাদা রক্ষা করা এখন মোদীর ও বিজেপির দায়িত্ব। পূজার উপাচার দেশবাসী সর্বাত্মকভাবে জোগাড় করে দিয়েছেন। এখন দেশমাতৃকার পূজা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা মোদীর ও বিজেপির অবশ্য কর্তব্য।
মোদীর নতুন ভারত গড়ার কাজে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আসমুদ্রহিমাচলের মানুষ। এখন নতুন ভারত গড়ার কাজ শেষ করতে হবে নতুন সরকারকে। প্রথম ইনিংসে অনেক কাজ করেছেন মোদী কিন্তু এখনও বাকি আছে অনেক কাজ। এবার দ্বিতীয় ইনিংসে করতে হবে সেই বাকি কাজগুলো।
বিজেপির হাতে আজ এককভাবে ৩০১ লোকসভা সদস্য। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাও তারা লাভ করবে। আইনসভায় এই সংখ্যাধিক্যের জোরে এতদিন না করতে পারা অনেক সংস্কার এখন করতে পারবে সরকার। রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ করে শ্যামাপ্রসাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন— এই ত্রিবিধ কাজ তো সম্পন্ন করতে হবেই। এছাড়াও বেশ কিছু কাজকে রাখতে হবে অগ্রাধিকারের তালিকায়।
প্রথমত, দীর্ঘকালের ঘোষিত বাম ও অঘোষিত বাম (তৃণমূল) শাসনে বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গকে বর্তমান শাসনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে পূর্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করা এখন কেন্দ্রীয় সরকারেরই দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত, ভারতের সমগ্র পূর্ব সীমান্ত জুড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলেছে বিদেশি আগ্রাসন। কখনো অনুপ্রবেশ, কখনো উগ্রপন্থা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে অন্তর্লীন আগ্রাসন চালিয়ে ভারতের এই অংশটিকে নিজের দখলে আনতে মরিয়া বিদেশি শক্তিগুলি। এই কাজ তারা করতে চায় উত্তরবঙ্গ সংলগ্ন সীমানায় আক্রমণ করে এবং উত্তরবঙ্গকে বিপন্ন করার পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের। সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের যোগাযোগের একমাত্র পথটিকেও (উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং নিয়ে গঠিতচিকেনস্ নেক) নিজের অধিকারে এনে। কংগ্রেস আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতায় উত্তর-পূর্ব ভারত জাতীয় রাজনীতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের বাম ও তৃণমূল শাসনে উত্তরবঙ্গও ছিল অবহেলিত। ২০১৪-য় মোদী আসার পর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নতি শুরু হয়েছে। এই সুশাসনের ঢেউ চোখে পড়েছে উত্তরবঙ্গবাসীরও। সীমান্ত ও সুরক্ষিত। হয়েছে। এনআরসি-র ফলে স্থানীয় মানুষ পেয়েছেন সুরক্ষার আশ্বাস। ফলে সেখানকার মানুষ এবারে তাদের সমর্থন। উজাড় করে দিয়েছেন মোদীজীর প্রতি। এখন মোদীজীর প্রতিদানের পালা। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই অঞ্চলটি হিমালয়ের বরফ গলা জলে সমৃদ্ধ থাকে সারা বছর। পাহাড়ি ঢাল বরাবর সেই জল প্রচণ্ড গতিতে নিম্নমুখী হয়। ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অরণাচল প্রদেশ -সহ সমগ্র উত্তর -পূর্ব ভারত সোনার খনিসদৃশ। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র অরুণাচল প্রদেশেই বছরে এক লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত মিলিয়ে পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। আজ ক্ৰমক্ষয়িষ্ণু খনিজ তেলের ভাণ্ডারের ওপর এবং ক্রমক্ষয়িষ্ণু খনিজ কয়লাজাত তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল গোটা বিশ্বের শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র যখন বিকল্প শক্তির সন্ধানরত, তখন এই বিপুল। পরিমাণ জলবিদ্যুৎ ভারতীয় অর্থনীতির এক চিরস্থায়ী সম্পদে পরিণত হতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিকাঠামোগত উন্নতি ত্বরান্বিত করে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা ও উত্তরবঙ্গের তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তকে পাকিস্তান। সীমান্তের মতো রুদ্ধ করে ও সেনাবাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে অনুপ্রবেশ চিরতরে বন্ধ করাই এখন নতুন সরকারের অবশ্য কর্তব্য।
তৃতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ মোদী সরকার গত পাঁচ বছরে নিয়েছে। কিন্তু দেশ দুর্নীতিমুক্ত এখনো হয়নি। আরও কড়া ও দ্রুত পদক্ষেপ করে দুর্নীতির সম্পূর্ণ মুলোচ্ছেদ করা বর্তমান। সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথম দিকে থাক উচিত।
চতুর্থত, কর্মসংস্থান বাড়ানো বর্তমান সরকারের অর্থনীতির প্রধান মন্ত্র হওয়া উচিত। বেকারত্ব দূর করে দেশের সব হাতে কাজ দিয়ে দারিদ্র্য নামক শব্দটিকে দেশ থেকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়া আশু প্রয়োজন।
এতাবৎকাল অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে দেশকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক দিয়ে বিগত সরকারের কাজ খুব একটা আশাপ্রদ নয়। সেই ঘাটতি এবারে পূরণ করা জরুরি।
কাজ এখনও অনেক বাকি। মোদী জনগণের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবার সিংহতুল্য কার্যের দ্বারা দেশকে জগৎসভার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে সেই ভারতবর্ষকে যে ভারতবর্ষের প্রতিরূপ ধ্যানাসনে উপলব্ধি করেছিলেন স্বামীজী। যাত্রা শুরু হয়েছে সেই গৌরবময় ভারতের দিকে। সেই যাত্রাকে শেষ করতে হবে। বিরোধীরা নিঃশেষিত, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখন শুরু নতুন ভারত গড়ার যুদ্ধ। এখন শুরু দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাঁড়াতে হবে, দেশপ্রেমিক মানুষেদের।
অম্লান কুসুম ঘোষ
2019-05-31