সদ্য এসটিএফ-এর হাতে ধরা পড়েছে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত জামাত উল মুজাহিদ্দিন বাংলাদেশ বা জেএমবি জঙ্গি আসাদুল্লা শেখ। পাঁচ বছর ধরে মরিয়া চেষ্টা চালানোর পর চেন্নাই থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। আর তারপরেই জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের হাতে উঠে আসছে একের পর এক খবর। চোখ কপালে তুলছেন গোয়েন্দারা। রাজ্যে জেএবি শাখা ছড়িয়ে ফেলার জন্য বড় পরিকল্পনা ছিল তাদের। অনেকটাই এগিয়েছিল সেই পরিকল্পনা। কিন্তু খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণে তাদের সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়, এমনটাই জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরের দিনেই মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসার সঙ্গে যোগসূত্র জেনে যান তদন্তকারী আধিকারিকরা। শিমুলিয়া মাদ্রাসায় তদন্ত করতে গিয়ে এনআইএ আধিকারিকরা খবর পান যে নিগনের তামিলপুকুরপাড়ের কাছে ২৫ কাঠা জমি কিনে ইউসুফ, বোরহান ও আসাদুল্লা শেখদের হাত ধরে তৈরি হচ্ছে একটি মাদ্রাসা।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন ২০১৩ সালের মার্চ মাসে কৃষ্ণবাটি গ্রামের বাসিন্দা মধূসুদন ঘোষ, বৃন্দাবন ঘোষ এবং বুদ্ধদেব ঘোষ নামে তিন কৃষকের কাছে ওই ২৫ কাঠা জমি কেনা হয়েছিল। কৃষ্ণবাটি গ্রামেই বাড়ি জেএমবির অন্যতম মাথা ইউসুফের। কিন্তু তার মধ্যস্থতায় জমিটি কেনা হলেও তামিলপুকুরপাড়ের কাছে ওই জমির মালিকানা ইউসুফের নামে নেই বলে জানা গিয়েছে। তদন্তকারী আধিকারিকরা জানতে পেরেছেন ২০১৩ সালের ৩ মার্চ নতুনহাট সাবরেজেস্ট্রি অফিসে ২৫ কাঠা জমি কেনা হয়েছিল তিনজনের নামে। তিন মালিকের মধ্যে আসাদুল্লার অংশ ৫ কাঠা, ইউসুফের বন্ধু কাঠমিস্ত্রি বোরহানের অংশ ৫ কাঠা এবং বাকি ১৫ কাঠা কেনা হয়েছিল বহরমপুরের উপরডিহি গ্রামের বাসিন্দা কেতুগ্রামের মউগ্রাম হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক বদরুজ্জামান শেখের নামে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ওই শিক্ষককে একাধিকবার তলব করেছিল এনআইএ। যদিও তদন্তকারীদের কাছে ওই শিক্ষক তখন জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে শিমুলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। সেই সুবাদেই ইউসুফ ও বোরহানের সঙ্গে পরিচয়ের পর যৌথভাবে জমি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিগনের তামিলপুকুরপাড়ে নির্মীয়মান মাদ্রাসার খোঁজ পাওয়ার পরেই ভাতারের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আসাদুল্লাকে তলব করে একাধিকবার নোটিস পাঠিয়েছিল এনআইএ। নোটিস পাঠানো হয়েছিল বোরহানের বাড়িতেও। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনার পরেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় আসাদুল্লা, বোরহানরা। স্বামী পালিয়ে যাওয়ার পরেই দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় আসাদুল্লার দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা বিবিও। তারপর থেকে আসাদুল্লার হদিশ পাননি তদন্তকারী আধিকারিকরা।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, খাগড়াগড় কাণ্ডের ৬ – ৭ বছর আগেই প্রথম স্ত্রী নূর নিহারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আসাদুল্লার। তারপর সে কুলসোনা গ্রামের মেয়ে হালিমাকে বিয়ে করে। মঙ্গলকোটের কুলসোনা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম সম্প্রতি খাগডাগড়কাণ্ডে সাজা পেয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই আসাদুল্লার সঙ্গে জেএমবির সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
বর্ধমান কাটোয়া রাজ্যসড়কের গায়েই তামিলপুকুর। তার চারপাশে ঘন জনবসতি। পুকুরের পশ্চিমদিকে ২০০ ফুটের মধ্যেই কয়েকটা জমি পেরিয়ে এখনও দাড়িয়ে রয়েছে অসমাপ্ত মাদ্রাসার কাঠামো। প্লাস্টার ছাড়া ইঁটের দেওয়ালে স্থানীয়রা কেউ ঘুঁটে দেন। মাদ্রাসার জমিতে গরু চড়ে। তবে সেখানে ঘেঁষতে দেখা যায় না বোরহান, আসাদুল্লা বা আরবি শিক্ষকের পরিবারের কাউকেই। খাগডাগড় বিস্ফোরণকাণ্ড না ঘটলে হয়তো এতদিনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যেত তামিলপুকুরপাড়ের জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। আর তাকে ঘিরে জেএমবির জাল এতদিনে বিছিয়ে ফেলতে পারত আসাদুল্লা, ইউসুফরা। আসাদুল্লা ধরা পড়ার পর এটাই ভেবে শিউরে উঠছেন স্থানীয়রা।