প্রাতঃ স্মরণীয় সমাজ সংস্কারক শিক্ষাবিদ বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬.৯.১৮২০ – ২৯.৭.১৮৯১) এর দ্বিশতবর্ষ জন্ম জয়ন্তীর সূচনা হচ্ছে আর চার পাঁচ মাস পরে । তাঁর বসত বাটিতে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যপূর্ণ মহাবিদ্যালয় বিদ্যাসাগর কলেজ। সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি ছিল মূল ফটকের ভিতরে একটি দরজার পরে কাঁচের শোকেসে। মূল ফটক আর ওই দরজায় তালা ঝোলানো থাকে – প্রহরীরা অষ্টপ্রহর দায়িত্ব সামলান।

গত (১৪.৫.২০১৯) তারিখ বিকেলে ভারতীয় জনতা দলের একটি বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বিধান সরণী দিয়ে যাওয়ার পর এই ঐতিহ্যপূর্ণ বিদ্যায়তনের ভিতরে বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। এই ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা স্তব্ধ, হতবাক, বিহ্বল। বাংলার নবজাগরণের প্রাণ পুরুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার তীব্র প্রতিবাদ করছি। সমস্ত বঙ্গবাসীর সঙ্গে তীব্র ধিক্কার জানাতে আমার কন্ঠ কিছুমাত্র দ্বিধান্বিত নয়। শুধু প্রতিবাদ নয় আমাদের দাবি এই জঘন্য ঘটনার পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ তদন্ত করা উচিৎ। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

বিপুল বিশাল একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করার সময় ভারতের (সম্ভবত বিশ্বের) বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় পেলাম আমরা। এই দৃষ্টি নন্দন শোভাযাত্রা যারা পরিচালনা করেছেন, তারা কেন পথের প্রান্তে গোলযোগ করে অপকর্মের মালিন্য যেচে চেয়ে নেবেন? সুতরাং ঘটনাটির পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করি। বিদ্যাসাগর মশাইকে বিজেপি অশ্রদ্ধা করে এমন কোন প্রমাণ আমাদের চোখে পড়েনি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম জলে শিলা ভেঙ্গেছে। তাহলে শোভাযাত্রায় আসা তরুণরা কি পথে বিদ্যাসাগরের মূর্তি খুঁজে পাননি? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই তো কলেজ স্কোয়ারের পশ্চিমে বিদ্যাসাগরের চমৎকার মূর্তি রয়েছে। যেভাবেই ধরি, এই অন্যায় জঘন্য ঘটনার জন্য আমাদের যুক্তি বিবেচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করছে। ঘটনাটি সাজানো । তা যদি না হয় অবিলম্বে কলেজের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করা হোক। ভয় কোথায়? ঝুলি থেকে বেড়াল বের হয়ে যাবার ভয়?

প্রতিবাদের নামে একমাত্র বিজেপিকে দায়ী করে হইচই করতে শুরু করেছেন নানারকম নেতা-প্রণেতা, বিচিত্রকর্মা বুদ্ধিজীবীর দল। এদের মধ্যে ১৯৭১ এর আগুনখোর বিপ্লবীরাও আছেন। তাদের আমরা চিনি গোলদিঘির বিদ্যাসাগর মূর্তির মাথা কেটে ফেলে দেওয়ার অপকর্ম তারা করেছিলেন। শুধু তাই নয় কেন ভাঙ্গা হল তার ব্যাখ্যাও তারা দিয়েছেন। আজ তাদের এই বিদ্যাসাগরের তর্পণ দেখে আশ্চর্য হতে হয়।

বিচার হোক, তদন্ত হোক, তার আগে এই ব্যাপক হুল্লোড় আসলে ভারতীয় জনতা দলের উল্কার গতিতে বিবর্ধমান জনসমর্থন সহ্য করতে না পারা বিভিন্ন দল, উপদলের নেতৃবৃন্দের ভয়কেই স্পষ্ট করছে বলে মনে করি। এ নিয়ে সবথেকে অপপ্রচার করছে সেই গণমাধ্যম, যার কর্তা বাংলার কয়েক লক্ষ সরকারি কর্মচারীর মহার্ঘ ভাতা না দেবার কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। ইনি মহার্ঘ ভাতা সংক্রান্ত কমিশনের প্রধান। আরও বিচিত্র কথা কদিন আগে এই সংস্থার প্রবক্তা চিকন বুদ্ধির ভদ্রলোক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নির্বাচনী পদযাত্রায় পাশে পাশে হেঁটে নিজের আনুগত্যের নিদর্শন রেখেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন রাজনৈতিক বিরোধীরা তো কালো পতাকা দেখিয়ে, আওয়াজ তুলে আপত্তি জানাতেই পারে। এই ভদ্রমহিলার স্মরণ শক্তি কি কমে গেছে? সারের দাম নিয়ে কথা বলা মাত্র যিনি সাধারণ কৃষিজীবী তরুণটিকে যিনি ‘মাওবাদী’ বলে জেলে পুরে দেন তাঁর মুখে এই কথা কি মানায়? যিনি কামদুনীর নিহত ধর্ষিতার হয়ে কথা বলতে আসা দুই সাহসিনীকে সঙ্গে সঙ্গে ‘মাওবাদী’ বলে আক্রমণ করেন তাঁর মুখে গণতন্ত্রের কথা? চন্দ্রকোণার মোটর যাত্রাকালে এই মহিলা ‘জয় শ্রী রাম’ শুনে তিন তরুণকে বলেছেন, ওরা গালাগাল দিয়েছে। তাদের পুলিশ পাকড়াও করেছে। এই মহিলার কন্ঠে গণতন্ত্রের কথা শুনে উচ্চ হাস্য ছাড়া আর কিই বা করা যায়।

শেষ পর্বের নির্বাচন বাকি। সাতগেছিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের বহু গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছেন। ঘর বাড়ি পুড়ছে। মানুষ প্রাণ ভয়ে গ্রাম ত্যাগ করছেন। নারীরা অত্যাচারিত লাঞ্ছিত হচ্ছেন। সর্বত্র এমনকী শাসক দলের সমর্থকরাও বাঁচছেন না। উদ্দেশ্য পরিষ্কার হিজাব পরে মোনাজাত করা আমাদের সভানেত্রী সংখ্যালঘুদের সমর্থনে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা উত্তরাধিকারীকে জিতিয়ে আনতে চান। গ্রামের পর গ্রামের মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন জিহাদি আক্রমণে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাম রাজনীতির সমর্থক থেকে আরম্ভ করে সব দল উপদলের সমর্থকরা এসে দাঁড়াচ্ছেন বিজেপির পিছনে। দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে অন্য উপায় তারা দেখছেন না। এই অবস্থায় বিদ্যাসাগরের মূর্তির পিছনে দাঁড়িয়ে বাংলার সংখ্যাগুরু জনতার মনে বিভ্রান্তি ছড়াতে লেগেছেন। এরা আসলে প্রাতঃ স্মরণীয় মহাপুরুষের বিশাল মূর্তির আড়ালে থেকে যা করতে চাইছেন তা স্পষ্ট। তাঁদের লক্ষ্য সংকীর্ণ রাজনীতি। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার যথার্থ তদন্ত হোক সবাই চাই। সংখ্যাগুরু মানুষের বিরুদ্ধে শাসক দলের সীমাহীন অত্যাচার বর্বরতার বিরুদ্ধে শাসক দলের সীমাহীন অত্যাচার বর্বরতার বিরুদ্ধেও আমাদের কণ্ঠস্বর যেন স্তব্ধ না হয়।

অচিন্ত্য বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.