জাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য—নেশন একটি সজীব সত্ত্বা, একটি মানস পদার্থ। দুইটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠিত করিয়াছে। সেই দুইটি জিনিস বস্তুত একই। তাহার মধ্যে একটি অতীতে অবস্থিত, আর একটি বর্তমানে। একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতি সম্পদ, আর একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা। জাতি কখনই হাতে হাতে তৈরি হয় না। নেশনও সেইরূপ সুদীর্ঘ অতীতকালের প্রয়াস। ত্যাগ স্বীকার এবং নিষ্ঠা হইতে অভিব্যক্ত। আমরা অনেকটা পরিমাণে আমাদের পূর্বপুরুষের দ্বারা পূর্বেই গঠিত হইয়া আছি। অতীতের বীর্য, মহত্ব, কীর্তি, ইহার উপরেই ন্যাশানাল ভাবের মূল পত্তন। অতীতকালে সর্বসাধারণের এক গৌরব এবং বর্তমান কালে সর্বসাধারণের এক ইচ্ছা, একত্রে সেইরূপ কাজ করিবার সংকল্প—ইহাই জনসম্প্রদায় গঠনের ঐকান্তিক মূল। আমরা। যে পরিমাণে ত্যাগ স্বীকার করিতে সম্মত হইয়াছি এবং যে পরিমাণে কষ্ট সহ্য করিয়াছি আমাদের ভালোবাসা সেই পরিমাণে প্রবল হইবে। আমরা যে বাড়ি নিজেরা গড়িয়া তুলিয়াছি এবং উত্তরবংশীয়দের হস্তে সমর্পন করিব সে বাড়িকে আমরা ভালোবাসি। প্রাচীন স্পার্টার গানে আছে, তোমরা যাই ছিলে আমরা তাহাই, তোমরা যাহা আমরা তাহাই হইব।’ এই অতি সরল কথাটি সর্বদেশের ন্যাশানাল গাথা স্বরূপ। অতীতের গৌরবময় স্মৃতি এবং সেই স্মৃতির অনুরূপ ভবিষ্যতের আদর্শ একত্রে দুঃখ পাওয়া এবং আনন্দ আশা করা এই দুটিই আসল জিনিস যা দিয়ে ভাষার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মাহাত্ম বোঝা যায়। অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ স্বীকার এবং পুনরবার সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একিভূত নিবিড় (প্রবন্ধ নেশান কী) অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন। আজও ভারতবর্ষে কোটি কোটি লোকের নাম রাম ও কৃষ্ণ। আজও রামনবমী ও জন্মাষ্টমী কোটি কোটি লোক পালন করছে। অতএব আমরা যে বিসর্জন দিইনি সেই জন্য জাতি হিসাবে আমরা বিদ্যমান সেই জাতির নাম হচ্ছে হিন্দু। রবীন্দ্রনাথ আত্মপরিচয়ে সেটা বলদৃপ্ত ভাষায় বলেছেন- আমাদের পরিচয় হচ্ছে আমরা হিন্দু তারপর আমরা খ্রিস্টান, মুসলমান, ব্রহ্ম, আর্য ইত্যাদি হতে পারে। অতএব রবীন্দ্রনাথ যে পরিচিতির কথা বলেছেন, তাকেই বলা হচ্ছে হিন্দুত্ব। এর বৈশিষ্ট্যগুলি কী আমরা সেটা আলোচনা করতে পারি কিন্তু জাতি হিসাবে আমরা যদি নিজেদের এই পৃথিবীর বুকে দাঁড় করাতে চাই তাহলে হিন্দহই হচ্ছে একমাত্র গুণ যা আমাদেরকে জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে দাঁড় করিয়ে দেবে। অন্যকোনো পরিচয়ে সেটা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের ইন্ডোলজিস্ট বলা হয়। যারা সংস্কৃত জানে যারা বেদ উপনিষদ জানে এই ইন্ডোলজিস্ট কথাটা তাদের জন্যই ব্যবহৃত হয়। সারা পৃথিবীতে ইন্ডোলজিস্ট অর্থাৎ ভারততত্ত্ববিদ তাদেরকেই বলা হয় যারা সংস্কৃত জানে, যারা রামায়ণ-মহাভারত জানে যারা বেদ উপনিষদ জানে তাদেরকেই বলা হয়। আজকের বর্তমান পৃথিবীতে এই ইন্ডোলজিস্ট থেকে ক্রমশ ইন্ডিয়া কথাটা। এসেছে। ফরাসি উচ্চারণে হিন্ডিয়া থেকে ইন্ডিয়া এসেছে। হিন্দু কথাটা যদিও রামায়ণ মহাভারতে নেই। এই কথাটা এসেছে জেরুস্থিয়ান যারা পারসি তাদের জেন্দা-আবেস্তাতে হিন্দু কথাটার অর্থ সাহসী, পরাক্রমী। তাদেরকে হিন্দু বলা হচ্ছে, হিন্দু কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। এই শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বরং এটা আছে এবং আজকে এই হিন্দু কথাটার প্রচলন আছে, সেজন্য আমরা এই কথাটার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। আজকে হিন্দু বলতে সারা ভারতবর্ষে যারা হিন্দু ধর্মকে অনুসরণ করে, পালন করে তাদেরকে হিন্দু বলে। এখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচয়ে লিখেছেন, ব্রাহ্মধর্ম বেদের যে অপৌরসিত তত্ত্বকে স্বীকার করেছে তারা মুর্তি পূজা করে না ইত্যাদির জন্য তারা ব্রাহ্ম হয়েছেন রাজা রামমোহন রায় আরম্ভ করেছেন মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর সেটাকে বিস্তার করেছেন। তারপর শিবনাথ শাস্ত্রী এবং অন্যান্যরা মিলে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা যখন বলল আমরা ব্রাহ্ম হিন্দু নই এবং রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিবাদ করে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ আত্মপরিচয়ে লিখলেন, আমাদের নিজস্ব পরিচয় হচ্ছে আমরা হিন্দু তারপর আমরা অন্যকিছু। আজকে যেটা বলা হচ্ছে হিন্দু মানে সাম্প্রদায়িকতা রবীন্দ্রনাথ তা মনে করেননি। সেজন্য তিনি বলেছেন যারা মুসলমান, যারা খ্রিস্টান তারা হিন্দু-মুসলমান তারা হিন্দু-খ্রিস্টান এটা জাতীয় পরিচয়। আজকে আমাদের যে জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতের সঙ্গে এগুলো মিলছে না; রবীন্দ্রনাথ এই মত পোষণ করতেন না। শান্তিনিকেতন উনি যখন আরম্ভ করেছিলেন তখন কিছু মুসলমান ছাত্র হিসাবে যোগদান করে। যেমন উদাহরণস্বরূপ মুস্তফা। আলি এবং তার ভাই। সৈয়দ মুস্তফা আলি লিখেছেন যে আমরা সকালে ধুতি পরতাম পরে প্রার্থনা সভায় যেতাম এবং উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করতাম। রবীন্দ্রনাথ একথা মনে করেননি যেহেতু মুসলমান সেজন্য তোমাদের জন্য আলাদা নিয়ম আজকে যেটা বলা হচ্ছে মুসলমানদের জন্য আলাদা নিয়ম। তা নয় উপনিষদ সবাইকেই পড়তে হবে। সংস্কৃত সবাইকেই পড়তে হবে এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃত থাকবে কী থাকবে না এনিয়ে আলোচনা চলছে। তখন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় বলেছিলেন সংস্কৃত থাকবে। কেননা কবিগুরু বলেছেন সংস্কৃত প্রত্যেকের পড়া উচিত। এজন্য বিধান রায় সংস্কৃতকে স্কুলেতে অবশ্য পাঠ্য রেখেছেন। আজকে বর্তমান সরকার সেটা রাখেনি। কেননা সংস্কৃত না জানলে আমাদের হিন্দু ধর্মে যে সমস্ত গ্রন্থ আছে তার কিছুই জানতে পারব না। আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। অতএব সংস্কৃতের কিছু জ্ঞান থাকা দরকার এবং এটা না জানতে পারলে জাতি হিসাবে আমরা আমাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। অতএব রবীন্দ্রনাথ এই সমস্ত জিনিসগুলো জানতেন। বুঝতেন সেইজন্য শান্তিনিকেতনে তিনি যে বিদ্যালয় গড়েছো তাতে সকালবেলা ঠিক ঋষির আশ্রমে যেরকম প্রার্থনা হয় সেখানে উপনিষদের, বেদের মন্ত্র উচ্চারণ। করা হত। এখন কলকাতার স্কুল কলেজে এগুলি পড়ানো হয় না। সেন্ট জেভিয়ার্স কিংবা লরেটোতে এগুলি পড়ানো হয় না। রবীন্দ্রনাথ পড়াতেন যেরকম নরেন্দ্রপুরেতে পড়ানো হয়। অতএব সেই দিক থেকে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তা এবং রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মধ্যে সাজুয্য আছে, কেননা, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়েতেও তিনি যে পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণ মিশনও তাদের নরেন্দ্রপুর এবং অন্যান্য সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করেছিলেন। সেই দিক থেকে এই দুই মহাপুরুষের চিন্তায় যথেষ্ট সাজুয্য আছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে আসা যাক; তার জন্ম। জোড়াসাঁকোতে। বাল্যকাল এবং প্রথম যৌবন তিনি ওখানেই কাটিয়েছেন। জোড়াসাঁকোর ওই রকম এক রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে তিনি থাকতেন। যেখানে চাকর-দারোয়ান-ঠাকুর পরিবৃত অবস্থায় থাকতেন। তার বাল্যস্মৃতিতে তিনি তার বর্ণনাও করেছেন। এই রকম পরিবেশ থেকে উনি ১৯০২ সালে স্ত্রী মৃণালীনি দেবী। এবং পুত্র-কন্যাদেরকে নিয়ে সোজা গিয়ে শান্তিনিকেতনে ঘাঁটি গাড়লেন। সেখানে কী ছিল তার জন্য। পাকাবাড়ি ছিল? মাটির ঘর, কোনো ইলেকট্রিক লাইট ছিল না। ওই কেরাসিন তেলের বাতি আর কিছু সাঁওতাল এবং মোষ এই নিয়ে আরম্ভ করলেন। উনি গেলেন কেন? শান্তিনিকেতনে প্রাণের তৃপ্তি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার শান্তিনিকেতনে এক গাছতলায় গিয়ে শান্তি পেয়েছিলেন। পিতৃস্মৃতিকে মনে রেখে উনি সেই একটা অজ গ্রামে গিয়ে ঘাঁটি গড়লেন। এর পেছনে যুক্তিটা কী? যুক্তিটা হল এটাই— ভারতবর্ষের তখনকার দিনে ৮০ শতাংশ লোক গ্রামে থাকে। এবং ভারতবর্যের অন্তরআত্মা যেটাকে আমরা বলি সেটা গ্রামের দিকেই। এটা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, আমি কলকাতা শহরে বসে ভারতবর্ষের অন্তরআত্মাকে উপলব্ধি করতে পারব না। সেজন্য তিনি কলকাতা ত্যাগ করে একদম স্বপরিবারে শান্তিনিকেতনে গেলেন এবং তিনি সেখানে ওই সাঁওতালদের সঙ্গে নিরক্ষরদের মধ্যে তাঁর জীবন আরম্ভ করলেন। সেখান থেকেই তিনি নোবেলবিজয়ী হয়েছিলেন | এই যে কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত এই সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে যে তিনি ভারতবর্ষের আন্তরআত্মাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতবর্যের ৮০ শতাংশ লোক যেখানে থাকে আমিও
সেখানেই থাকব, আমি তাদের সঙ্গেই থাকব এবং সেখানেই থেকে উনি যে শুধু শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী গঠন পর্যন্ত নিজেকে ব্যপ্ত রাখলেন তা নয়, স্থানীয়। লোকেদের উন্নতি করবার জন্য উনি শ্রীনিকেতন বলে একটি সংস্থা দাঁড় করিয়েছিলেন বিখ্যাত গায়ক শান্তিনাথ বোসের বাবা কালিমোহন বোসকে কেন্দ্র করে। কালিমোহন বোসের দ্বারা উনি শ্রীনিকেতন তৈরি করেছিলেন। আজকে যে আমরা দেখতে পাই এটা কালি মোহন বোস শান্তিনাথ বসুর বাবা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে এই সব করেছিলেন। কেন করেছিলেন? উনি জানতেন যে এই গ্রামাঞ্চলে যারা আছে তাদেরকে যদি একটু লেখাপড়া শিখিয়ে কাছে টেনে নেওয়া যায়, তাদের সঙ্গে যদি একটু অন্তরঙ্গ হওয়া যায় তাহলে আমিও উপকৃত হব তারাও উপকৃত হবে। কলকাতা শহরে বসে আমি মেধার দিক থেকে হয়তো অনুভব করেছি এরা আমার কিন্তু তা নয় শুধু মেধা দিয়ে নয় হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। যেজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন তুমি মেধার দ্বারা দুই এক পা অগ্রসর হতে পার কিন্তু এই সংসার সমুদ্র যদি অতিক্রম করিতে হয় তাহলে হৃদয় চাই। রবীন্দ্রনাথ হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জন্য তাদের মাঝে গিয়েছিলেন। কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকোতে শুধু মেধার দ্বারা একাত্মতা অনুভুতি নয়; তিনি তার জীবন দিয়ে এটা করেছেন। সেজন্য তিনি আমাদের কাছে প্রাতস্মরণীয়। আজকে যে কথা আমাদেরকে বোঝানো হচ্ছে বিশেষ করে সরকারী তরফ থেকে বোঝানো হচ্ছে যে হিন্দু এই কথাটা বললে বিভেদ সৃষ্টি হবে। এটা অহেতু ভয়ের কথা। রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দ তারা কিন্তু এই ভয়ে ভীত ছিলেন না। তারা সেই চিরন্তন সনাতন সত্যের পূজারী। এই কথা জোর গলায় বলেছেন। আজকে নির্বাচনে ভোট আমি পাব কি পাব না। এটাই যদি একমাত্র বিচারের বিষয় হয় তাহলে বুঝতে হবে যে জাতি হিসাবে আমাদের সংকট খুব নিকটে এসে গেছে। আমাদের এই দেশের ইতিহাসের সত্যকার পরিচয় জানতে হবে এবং হিন্দুত্বের যে ব্যাপকতা, হিন্দুত্বের যে বৈশিষ্ট্য যার জন্য ভারতবর্ষ, সেটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। আমাদের কর্মে, ব্যবহারে আলাপ আলোচনায়, আচরণে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আজ সেটাই সময়ের আহ্বান। এই যে হিন্দুত্ব এটা ভারতবর্ষের চিরন্তন পরিচয়, সনাতন পরিচয় এবং একমাত্র পরিচয়। তাকে ব্যক্তি জীবনেতে, সমাজ জীবনেতে এবং সারা বিশ্বের কাছে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী
(লেখক চাটার্ড একাউন্টেন্ট ও চিন্তাবিদ)
অনুলিখন : সোমেন নস্কর