অভিজাত বালিগঞ্জ প্লেস। শেষ দুপুরের নিঝুম। গলি ক্রিকেট, বাচ্চাদের হইচই।
- বাবু, যামিনী রায়ের বাড়িটা কোথায় জানিস?
ওরা ঘাড় নাড়ে। কঠিন ছিল প্রশ্ন। একটু এগোতে চায়ের দোকান। ঝিমোচ্ছে। বেঞ্চে খদ্দের নয়, পাড়ার লোকজন, বোঝা যায়। জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দেন, সামনের বাঁদিকের গলি। ঘুরেই দ্বিতীয় বাড়িটা।
আশপাশের বড়ো বাড়ি আলো শুষে নিয়েছে। একটা ক্যানভাসের মতো আকাশ আর গাছপালা। তার ফাঁকে শিল্পীর বাড়ি। বসন্ত এসেছে। তার কোনো আতিশয্য নেই। কয়েকটা আউটলাইনের মধ্যে ঘষা ইটে রঙের দেওয়াল, পাঁচিল, ছাদের উঁকি। কোথাও কারো জন্য অপেক্ষা নেই বলেই মনে হল!
দক্ষিণ কলকাতার বন্ডেল রোডের কাছে রাস্তার নাম যামিনী রায় সরণি। এখানেই ১৮/৩৯ নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসে যামিনী রায়ের বাড়ি। এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা অনেকেই শিল্পীকে দেখেছেন। লাঠি হাতে বাড়ির সামনে পায়চারি করতেন তিনি। বাড়ির ভেতরেই চলত ঋষিকল্প মানুষটির কাজকর্ম।
বাড়ির ভেতরে তাঁর আপন মুলুকে কী কাজ চলত? পাড়া পড়শিরা জানতেন? এমনিতে বাঙালি বুঝদার। সৌরভ গাঙ্গুলির ক্রিকেট থেকে জ্যোতি বসুর রাজনীতি, কিংবা জলদাপাড়ার গণ্ডার থেকে কথামৃতের রামকৃষ্ণ – অতি স্বাভাবিকভাবে বাঙালি সব বোঝে। তবে চিত্রকর বা আঁকিয়েদের নিয়ে চিরকালই নীরব বাঙালি। তার বলার জায়গা কেবল যামিনী রায়। কারণ, যামিনী রায়ের ছবি অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে অল্প মূল্যে পাওয়া যেত।
শিল্পী ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ প্রবক্তাদের মতন গুরুতর বিষয় নিয়ে মধ্যবিত্ত আমজনতার কাছে দাঁড়াননি। বরং ভদ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে যখন পাশ্চাত্য শিল্পের অনুপ্রেরণায় আঁকা ছবির কদর শুরু হয়েছে, যখন রাফায়েল, মিকালেঞ্জেলো কিংবা পিকাসো, ভ্যান গঘ নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন, তখন ভূমিজ শিল্পের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছে যামিনী রায়ের ছবি।
তিনি নিজেকে বলতেন পটুয়া। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পোর্ট্রেট ড্রয়িং শুরু করা আর্ট কলেজের এক ছাত্রশিল্পী নিজেকে আবিষ্কার করলেন বাংলার লোকশিল্পে, মঙ্গলকাব্যে, আর পটুয়াপাড়ায়। সে এক রূপকথার গল্প। তাঁর গণেশজননী, ভারতমাতা, ক্রুশবিদ্ধ যিশু মধ্যবিত্ত বাঙালির দেওয়ালে ক্যালেন্ডারে, বিয়ের কার্ডে অথবা বইয়ের প্রচ্ছদে খুঁজে পাওয়া যাবেই। আর সেজন্যই যামিনী রায়ের খবর রাখতেন পাড়াপড়শিরা।
যামিনী রায় সরণির বিখ্যাত বাড়িটির সন্ধান পড়শিরা অনেকে বিক্ষিপ্তভাবে দিলেন। আর অশীতিপর কিছু মানুষ জুড়ে দিলেন শিল্পীকে নিয়ে টুকরো স্মৃতির কোলাজ। ১৯৫২ সালে শিল্পী যখন ৬৫, তখন সিগনেট প্রেসের ‘টুকরো কথা’য় কবি-সম্পাদক নরেশ গুহ লিখেছিলেন এক শিল্পী জীবনের আখ্যান। এক ছোট্ট মেয়ে বৃদ্ধ শিল্পীর ঘরে আশ্চর্য সব রঙিন ছবির সমাহার দেখে ভেবেছিল, এ বুঝি ঠাকুরঘর। নরেশ গুহের মতে, “মেয়েটি জানল না তার নিষ্পাপ শিশুমন যামিনী রায়ের আশ্চর্য রচনাকে যথার্থ মর্যাদা জানিয়ে অজ্ঞাতসারে সারা দেশের মুখরক্ষা করল।” যেন যামিনী রায়ের বাড়ি-ঘর এমনই হবে!
দক্ষিণ কলকাতার বন্ডেল রোডের কাছে রাস্তার নাম যামিনী রায় সরণি। এখানেই ১৮/৩৯ নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসে যামিনী রায়ের বাড়ি। এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা অনেকেই শিল্পীকে দেখেছেন। লাঠি হাতে বাড়ির সামনে পায়চারি করতেন তিনি। বাড়ির ভেতরেই চলত ঋষিকল্প মানুষটির কাজকর্ম।
১৯৭২ সালে বন্ডেল রোডের কাছে এই বাড়িতেই শিল্পী প্রয়াত হন। তখন কবি বিষ্ণু দের নেতৃত্বে কলকাতার কিছু বুদ্ধিজীবী যামিনী রায়ের ছবি নিয়ে সংগ্রহশালা করার উদ্যোগ নেন। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ জানান, সরকার যেন শিল্পীর বাড়িতে রাখা ছবিগুলি কিনে নিয়ে কলকাতায় সাধারণের জন্য সংগ্রহশালা তৈরি করেন। তবে কেন্দ্র সে সব ছবি কিনে তা পাঠিয়ে দেয় দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এ। কারণ কলকাতায় তখন ভালো সংগ্রহশালা নেই। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের দু-লক্ষ টাকায় কেনা যামিনী রায়ের প্রায় ২০০ ছবি ঠাঁই পেল দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট-এ।
তাহলে বাঙালিরা যামিনী রায়ের ছবির সংগ্রহশালা কি কলকাতায় দেখতে পাবে না? সেটা ১৯৭৮ সাল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবার যামিনী রায়ের ২২৫ খানি ছবি কিনে নিতে রাজি হল। আড়াই লক্ষ টাকায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছবি কিনে নিল। যদিও কলকাতায় তখনও শিল্পীর ছবির স্থায়ী মিউজিয়াম নেই। তাই পরবর্তীতে শিল্পীর বালিগঞ্জে ডিহি শ্রীরামপুর লেনের বাড়ির একতলায় স্টুডিওর ঘরগুলি নিয়ে যামিনী রায় স্মারক সংগ্রহালয় গড়ে উঠল।
সূত্রের খবর, দিল্লি আর্ট গ্যালারি যামিনী রায়ের বাড়ি কিনে নিচ্ছে। সেখানেই গড়ে উঠবে শিল্পীর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালা। এই বাড়ি তার পরিবাবের কাছ থেকে নিচ্ছে দিল্লির সংস্থাটি।
উল্লেখ্য যে, কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যামিনী রায়ের ছবি রয়েছে। এবং রাজ্য চারুকলা পর্ষদের সংগ্রহে যামিনী রায়ের অনেকগুলি ছবি রয়েছে।
১৯৮৪ সালে যামিনী রায় সরণির যে বাড়ির নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে শিল্পীর ২৭২টি ছবি সংগৃহীত হয়, সেই বাড়িতেই আমৃত্যু শিল্পী মগ্ন থেকেছেন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে। শহরের আনাচে কানাচে এমন অনেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি রয়েছে, যেগুলিকে ঐতিহ্যশালী তকমা দিলেও কোনো গ্রেড দেওয়া হয়নি। যামিনী রায়ের এই বাড়িটিকেও গ্রেডভুক্ত করা হয়ে ওঠেনি।
তবে এবার এই ঐতিহাসিক বাড়ি কিনে নিচ্ছে দিল্লির একটি সংস্থা। সূত্রের খবর, দিল্লি আর্ট গ্যালারি যামিনী রায়ের বাড়ি কিনে নিচ্ছে। সেখানেই গড়ে উঠবে শিল্পীর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালা। এই বাড়ি তার পরিবাবের কাছ থেকে নিচ্ছে দিল্লির সংস্থাটি। সূত্রের খবর, অনেক আগেই এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত এবার কার্যকর হতে চলেছে। বাড়ি হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি।
রাজ্য হেরিটেজ কমিটির দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান ছিলেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। বঙ্গদর্শন.কমকে তিনি বলেন, “দিল্লি আর্ট গ্যালারি যদি বাড়িটাকে কিনে নিয়ে মিউজিয়াম করে, তবে সেটা যামিনী রায়ের নামেই হবে। সেটা দেশের একটা অন্যতম সম্পদ হবে বলে মনে করি।” যামিনী রায়ের মতো মহীরুহের শিল্প সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে দরকার নিয়মিত নজরদারি। সঙ্গে হাল আমলের বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ। তাই দিল্লি আর্ট গ্যালারির এই উদ্যোগ সাধুবাদ যোগ্য। শুভাপ্রসন্ন বলেন, “দিল্লি আর্ট গ্যালারির যে প্রতিষ্ঠা এবং দক্ষতা রয়েছে, তা মোটামুটিভাবে আমাদের সকলের কাছেই প্রতিষ্ঠিত। আশা করি, সংরক্ষণের কাজ যথার্থ এবং উপযুক্ত হবে।”
দিল্লি আর্ট গ্যালারির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন কলকাতা হেরিটেজ ওয়াকের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ড. তথাগত নিয়োগী। তিনি বলেন, “হেরিটেজ আমাদের সকলের দায়িত্ব। সরকারের পক্ষেও সমস্ত হেরিটেজ অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের পাশাপাশি সমষ্টিগত এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ দরকার।”
পায়েল সামন্ত