ভারতের সংসদে সপ্তদশ অধিবেশনের প্রথম দিনে পশ্চিমবঙ্গের কিছু সাংসদ লোকসভায় ধ্বনি দিলেন ‘জয় বাংলা’। এই ধ্বনিটি ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবর রহমানের তোলা বাংলাদেশের ওয়ার ক্রাই এবং আজও এটি সে দেশে আওয়ামী লীগ পার্টির স্লোগান। সেই স্লোগান ইদানিং প্রায়শঃই উঠছে পশ্চিমবঙ্গেও এবং উঠল ভারতের সংসদেও। একদল ফেরিওয়ালা পশ্চিমবঙ্গের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একীকরণের স্বপ্ন ফেরি করে এবং পশ্চিমবঙ্গের বুকে তাদেরই প্রিয় স্লোগান হল ‘জয় বাংলা’। এদের বার্তা নিয়েই কি পশ্চিমবঙ্গের একদল সাংসদ পার্লামেন্টে তুললেন সেই স্লোগান? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরাই দিয়েছেন এই ধ্বনি।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশের স্লোগান তোলাকে যদি কারুর দেশদ্রোহ বলে মনে হয়, তবে তার সেই নেতিবাচক অনুভূতিকে কি খুব নিন্দা করা যায়? বোধ হয় না। আমাদের দেশের সংসদে অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওয়ার ক্রাই হাঁকবার স্বাধীনতা বাক্ স্বাধীনতার এক্তিয়ারভুক্ত হওয়াও উচিত নয়।
হয়ত কেউ ভাবতে পারেন যে আমাদের রাজ্যের বর্তমান নামও যেখানে ‘বাংলা’, সেক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ বলতে আমরাই বা পারব না কেন? তাঁদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে কিছুদিন পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সে নাম অনুমোদন করেন নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যুক্তি অনুসারে, আমাদের রাজ্যের পার্শ্ববর্তী স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের নামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রস্তাবিত নতুন নাম ‘বাংলা’র অবিমিশ্র সাদৃশ্য নানা রাজনৈতিক ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, তাই ‘বাংলা’ নামটি অনুমোদনযোগ্য নয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমোদন না পাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সমস্ত বিজ্ঞাপনে ‘বাংলা’ শব্দটিই প্রকটভাবে ব্যবহার করে চলেছেন। একেও কি দেশদ্রোহী আচরণ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না? ভারত সরকারের আপত্তির তোয়াক্কা না করা কি সাংবিধানিকভাবে সমর্থনযোগ্য? অবশ্যই না। অর্থাৎ বাস্তব হল, মুখ্যমন্ত্রী যতই ‘বাংলা’, ‘বাংলা’ করুন, পশ্চিমবঙ্গের নাম আজও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ই, ‘বাংলা’ নয়। অর্থাৎ তৃণমূল-সাংসদরা যদি সওয়াল করতে চান যে পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’, সেই কারণেই তাঁরা দেশের সংসদে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলেছেন, তবে সে যুক্তিও ধোপে টিঁকবে না।
অনেকে হয়ত একথাও বলতে পারেন যে মহারাষ্ট্রীয়রা যদি ‘জয় মহারাষ্ট্র’ স্লোগান তুলতে পারেন, তবে আমাদের রাজ্যের নাম যা-ই হোক, আমাদের ভাষা যেহেতু বাংলা, আমাদের এথনিক আইডেন্টিটির সঙ্গে যেহেতু মিশে আছে বাংলা, আমরাই বা ‘জয় বাংলা’ বলতে পারব না কেন? বাধা কোথায়? বাধা মাত্র একটি। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটিকে ইতিমধ্যেই অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের নিজেদের ওয়ার ক্রাই হিসেবে আপন করে নিয়েছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির লোগো বা রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক অন্য কোনো কোম্পানি আইনগত বা নীতিগতভাবে ব্যবহার করতে পারে না। যদি করে, তবে বিষয়টি প্রথম কোম্পানির গোচরে এলে প্রথম কোম্পানি দ্বিতীয় কোম্পানির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করতে পারে। নীতিগত দিক থেকে সেরকমই একটি স্বাধীন দেশ অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্লোগানকে ব্যবহার করলে তা অনৈতিক ও গূঢ় রাজনৈতিক প্রণোদনার বার্তা বহনকারী বলে সন্দেহ করার অবকাশ থেকে যায়। মহারাষ্ট্র কোনোদিন বিভক্ত হয় নি। মহারাষ্ট্রীয়দের কোনো অস্তিত্ব সংকট নেই, যা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালীর আছে। সমগ্র বঙ্গদেশের ইসলামিকরণ ঠেকাতে বঙ্গভূমির হিন্দু বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার্থেই সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির। সে আত্মরক্ষণযজ্ঞের পৌরোহিত্য করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা আজও অপরিহার্য। বাংলাদেশের ওয়ার ক্রাই বলেই ‘জয় বাংলা’ পশ্চিমবঙ্গবাসীর স্লোগান হতে পারে না।
আজকাল পশ্চিমবঙ্গের কিছু সংগঠন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক সুবৃহৎ অংশ, দুই বাংলা এক হোক্, এমন অতিপরিচিত সেই প্রাচীন ধুয়োটি তুলছেন। তাঁদের প্রচারধারা দেখে বোধ হয় যে তাঁরা যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই পশ্চিমবঙ্গের স্লোগানকে যেন তেন প্রকারেণ বাংলাদেশের স্লোগানের সঙ্গে এক করার চেষ্টায় মরিয়া। ইদানিং তাঁরা প্রচার করছেন যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নাকি নেওয়া হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা থেকে এবং নিয়েছিলেন মুজিবর রহমান। এই দাবীর মাধ্যমে তাঁদের মূল প্রতিপাদ্য হল, নজরুল যেহেতু দুই বাংলা’রই কবি, নজরুল যেহেতু বাঙালীর কবি, তাই ‘জয় বাংলা’ বলতে এপার বাংলা, ওপার বাংলা, কারুরই নাকি কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়।
তাঁরা তথ্য দিয়েছেন যে, মুজিবর রহমান এই স্লোগানটি গ্রহন করেছিলেন নজরুল ইসলামের একটি কবিতা থেকে, যার নাম, ‘পূর্ণ অভিনন্দন’। তথ্যসূত্র:
https://www.kalerkantho.com/print-edition/doshdik/2015/08/28/261655
এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে বলতে হয় যে একথা সত্য যে “পূর্ণ অভিনন্দন” নামে কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা সত্যই আছে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান সত্যই ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু নজরুলের উক্ত কবিতা থেকেই যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধটি নেওয়া হয়েছিল তার কোনো প্রামাণ্য রেফারেন্স কি আছে? কেবলমাত্র ‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকার রেফারেন্স নিঃসন্দেহে যথেষ্ট নয়। শেখ মুজিবর রহমান নিজে কি কোথাও কোনোদিন একথা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি কাজী নজরুলের “পূর্ণ অভিনন্দন” কবিতাটি থেকেই নিয়েছেন? বা কাজী নজরুল ইসলাম কি কোথাও একথা বলেছেন (মনে রাখতে হবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যখন প্রথম ব্যবহৃত হয়, তখন নজরুল জীবিত)? আমি যতদূর জানি, সেরকম কোনো প্রত্যক্ষ প্রামাণ্য নথি সম্ভবতঃ নেই। তবুও, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিতে হয় যে উক্ত স্লোগান নজরুলের উক্ত কবিতা থেকেই নেওয়া, তাহলে এই নেওয়া আদৌ সুপ্রযুক্ত কিনা, নাকি অর্থহীন, তা যথার্থ অনুধাবন করতে গেলে, আগে কবিতাটি পড়তে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে, মুজিবর রহমান যে এই কবিতা থেকে দুইটি মাত্র শব্দের একটি শব্দবন্ধ তুলে নিয়ে তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান বানিয়েছিলেন, (যদি মুজিব আদৌ তা করে থাকেন) তবে তা আদতে নজরুলের কবিতায় ঐ শব্দ দুইটি যেভাবে, যে উদ্দেশ্যে এবং যে স্পিরিটে ব্যবহৃত হয়েছে তাকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করেছে। কবিতাটি নিম্নরূপ:
https://www.bangla-kobita.com/nazrulislam/purnoovinondon/
প্রথমতঃ নজরুল এই কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯২২ সালে, যখন ভারতবর্ষ ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্ম হয় নি। অবিভক্ত বঙ্গদেশসহ ভারতবর্ষ তখন অখণ্ড। দ্বিতীয়তঃ, কবিতাটিতে নজরুলের লেখা ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র’—এই পংক্তির মাধ্যমে নজরুল জয়ধ্বনি দিয়েছেন পূর্ণচন্দ্র দাস নামক অবিভক্ত ভারতের তথা অবিভক্ত বঙ্গের মাদারিপুরের এক আগ্নেয় বিপ্লবীর নামে। ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র’ পংক্তিটির অর্থ পূর্ণচন্দ্র দাসের জয়জয়কার। অর্থাৎ, এই কবিতায় ‘জয় বাংলা’ বলে কোনো শব্দবন্ধের অস্তিত্বই নেই। যা আছে তা হল, “বাংলার পূর্ণচন্দ্র”- র জয় ঘোষণা। “বাংলার” আর “বাংলা” শব্দদুটি এক নয়। শেখ মুজিবর রহমান তো স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলার’ বলেন নি। তাই তা থেকে শুধু ‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধটি তুলে নিয়ে তাকে ভারতবিভাগের পর অবিভক্ত ভারতের টুকরো হিসেবে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান মুজিবর রহমান যদি বানিয়েও থাকেন (যদিও আমি বিশ্বাস করি তা তিনি করেন নি), তাহলে বলতে হবে নজরুলের এই কবিতাটির অর্থ মুজিব আদৌ বুঝতেই পারেন নি। মুজিবর রহমানকে অপমান করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, কিন্তু কিছু মানুষ যখন তাঁকে এতখানি সাহিত্যবোধহীন ও অগভীর বলে প্রচার করতে চাইছেন, তখন আমি নিরুপায়। একথা কোনোমতেই বিশ্বাস্য নয় যে নজরুলের “পূর্ণ অভিনন্দন” কবিতার সম্পূর্ণ ভিন্নার্থক একটি পংক্তির একটি অংশ মাত্র গ্রহন করে তাকে সম্পূর্ণ অন্য অর্থে ব্যবহার করার মত উপলব্ধিহীন, সাহিত্যবোধহীন, অর্বাচীন মুজিব ছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ‘কালের কন্ঠ’এর তথ্যকে যদি সত্য বলে গণ্য করতে হয়, তাহলে এ কথা না বলে উপায় নেই যে নজরুলের পংক্তি, ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র’ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বানানো মুজিবর রহমানের দিক থেকেই ছিল হয় আবেগ, নয়ত রাজনৈতিক চাল, নয়ত দুই-ই। মোটের উপর নজরুলের কবিতার স্পিরিট আর স্লোগানের স্পিরিট, দুইয়ের মধ্যে কোনো মিলই নেই।
অর্থাৎ যদি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎস নজরুলের “পূর্ণ অভিনন্দন” কবিতা হয়, তাহলে একথা অনস্বীকার্য যে তা হয়েছে নজরুলের উক্ত কবিতার অপব্যাখ্যার দ্বারা। এবং সম্ভবতঃ সে অপব্যাখ্যা মুজিবর রহমান কোনোদিন করেনই নি। বাস্তবিক ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎস হয়ত অন্য কোথাও। হয়ত তা মুজিবের নিজেরই আবেগের ফসল অথবা অন্য কোনোখানে। বর্তমানে বোধ হয় অধিকতর গ্রহনযোগ্যতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুজিবের নাম দিয়ে তা চালিয়ে দিতে চাইছেন অন্য কোনো লবি। কিন্তু যিনি বা যাঁরাই করে থাকুন না কেন, অতীতেই হোক বা বর্তমানে, অপব্যাখ্যা অপব্যাখ্যাই। এবং সন্দেহ হয় যে এই অপব্যাখ্যার আদত উদ্দেশ্য হল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালীর নজরুল অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়া যাতে, দুই বাংলার একীকরণের নামে পশ্চিমবঙ্গকেও ইসলামের এক্তিয়ারের মধ্যে ঢোকানো যায়। এই উদ্দেশ্যে যে সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাত ও আগ্রাসনের ঘৃণ্য ও বিপজ্জনক চক্রান্ত চলছে, তার স্বরূপ উপলব্ধি করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।
‘জয় বাংলা’ বলতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তা আমরা কখনোই আমাদের মাতৃভূমি এই পশ্চিমবঙ্গের জয় ঘোষণার জন্য বলতে পারি না। একথা মনে রাখতে হবে যে যতবার আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করব, ততবারই আমরা জয় ঘোষণা করব আমাদের প্রতিবেশী সার্বভৌম বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের। তাই ভারতের সংসদে দাঁড়িয়ে অন্য কোনো দেশের জয় ঘোষণাকারী এই স্লোগান তোলা অবশ্যই ঘোর অনুচিত, তা সে বন্ধুরাষ্ট্র যত বড় বন্ধুই হোক না কেন।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য