বউবাজার নৃত্য ভবনের ঐতিহ্যপূর্ণ জগদ্ধাত্রী পুজো

মধ্য কলকাতার বউবাজার এলাকায় মুচিপাড়া থানার ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনের নৃত্য ভবনের (দত্ত পরিবার) জগদ্ধাত্রী পুজো কলকাতার বনেদি বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দত্ত পরিবারে জগদ্ধাত্রী পুজো কবে শুরু হয়েছিল, সঠিক জানা না গেলেও পুজোর বয়স যে সার্ধশতাধিক বছর অতিক্রান্ত, সেই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কেননা বর্তমান প্রজন্ম পাঁচ পুরুষ ধরে জগজ্জননী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করে আসছেন।
এই প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস জানতে হাজির হয়েছিলাম দত্ত পরিবারের প্রবীণতম সদস্য ৯৫ বছর বয়সি কাশীনাথ দত্ত মহাশয়ের কাছে। আলাপচারিতায় শ্রদ্ধেয় দত্ত জানালেন,দত্ত পরিবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত করেন পরিবারের আদিপুরুষ বলাইচাদ দত্ত। প্রথম কয়েক বছর পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩ নম্বর বাবুরামশীল লেনের বাড়িতে। বলাইচঁাদ দত্ত-র পরে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র নৃত্যলাল দত্ত জগদ্ধাত্রী পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অদূরে ১০ নম্বর বাবুরাম শীল লেনে তিন খিলানের ঠাকুরদালান-সহ বিশাল অট্টালিকা তৈরি করে পুজো সেখানে স্থানান্তরিত করেন। সেও দেড় শতাধিক বছর আগের কথা। তদবধি ওই বাসভবনে জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নৃত্যলালের নামাঙ্কিত এই বাসভবন (নৃত্য ভবন) তাঁর স্মৃতি বহন করছে। নৃত্যলাল দত্তের উত্তরসুরিরা বর্তমানে জগদ্ধাত্রী পুজোর দায়িত্বে ব্যাপৃত আছেন।
জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন সকাল থেকেই অতিথি-অভ্যাগতদের সমাগমে ‘নৃত্য ভবন’ মুখরিত হয়ে ওঠে। দত্ত পরিবারের যে সব সদস্য অন্যত্র বাস করেন, তারাও জগদ্ধাত্রী মাতার অমোঘ আকর্ষণে ‘নৃত্য ভবন’-এ উপস্থিত হন। জগদ্ধাত্রী পুজো এদের কাছে পারিবারিক মিলেনৎসবও। এই দিনটির জন্য দত্ত পরিবার সারা বছর সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে।
ডাকের সাজে সজ্জিতা স্বর্ণালংকারে ভূষিতা নয়নাভিরাম মাতৃমূর্তি। মায়ের শান্ত স্নিগ্ধ প্রসন্নময়ী রূপে হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। দেবী জগদ্ধাত্রী চতুর্ভুজা। চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। ডান পায়ের জানুর উপর বাম পা রেখে বাহন সিংহের উপর উপবিষ্টা। দেবীর বাহন শ্বেতবর্ণের সিংহ। সিংহের পদতলে হস্তিমুণ্ড । দেবীর দুই পাশে দুই সহচরী—জয়া ও বিজয়া।
জগদ্ধাত্রী পুজোর আগেরদিন সন্ধ্যায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। পুজোর দিন সকালে ৭ নম্বর বাবুরাম শীল লেনস্থ ঠাকুরবাড়ি থেকে নারায়ণ, মা মঙ্গলচণ্ডী, মা লক্ষ্মী-কে ‘নৃত্য ভবন’-এ নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও চক্ষু দান করে পুজোর অনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। ক্রমান্বয়ে সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপুজো ও নবমী একই দিনে নিষ্ঠা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধি পুজোয় ১০৮ প্রদীপ প্রজ্বলনে সমগ্র বাড়িতে এক পবিত্র ও ভাবগম্ভীর আবহ তৈরি হয়, চাক্ষুষ না করলে যা কল্পনা করা যাবে না। মৃন্ময়ী মা যেন তখন চিন্ময়ী রূপে প্রতিভাত হন।
অষ্টমী ও সন্ধিপুজোর মধ্যবর্তী সময়ে মহিলারা দু’হাতে দুটো সরা এবং মাথায় একটামালসানিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বসে কাঠ-কয়লার আগুনে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে ধুনো পেড়ান। এটি সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব রীতি। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে বলির প্রথা নেই। অন্নভোগ হয় না। সংকল্প হয় পালাদারের নামে। পুজোর ব্যয় নির্বাহ হয় ‘জগদ্ধাত্রী মাতা’র নির্দিষ্ট বাড়ির ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত আয় থেকে।
পরদিন সকালে দশমী পুজো সমাপনান্তে দর্পণে মায়ের চরণ দর্শনের পালা। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মায়ের বিদায় মুহূর্ত। সকলের মন তখন ভারাক্রান্ত। বিকেলে বেদি থেকে মা-কে উঠোনে নামানোর পরে মহিলারা বরণ করেন ও সিন্দুর খেলায় মেতে ওঠেন। সবশেষে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মা জগদ্ধাত্রীর পা ধুইয়ে দেন এবং মা-কে কানে কানে আগামীবছর আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। উল্লেখ্য, সেই সময় অন্য কেউ উপস্থিত থাকবে না। এরপর কণকাঞ্জলি দিয়ে মা জগদ্ধাত্রীকে বিদায় জানানো হয়।
পারিবারিক রীতি অনুযায়ী, বাবুঘাটে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। আগে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো নৌকায় করে মাঝ গঙ্গায়। বর্তমানে প্রশাসনিক অনুমতি না মেলায় বিসর্জনের সেই রীতি অনুসৃত হয় না।
ফিরে এসে শান্তিজল গ্রহণের মধ্যে দিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরিসমাপ্তি ঘটে। আবার এক বছরের প্রতীক্ষা। সকলের কণ্ঠে তখন একটাই প্রার্থনা— ‘আবার এসো মা।
সপ্তর্ষি ঘোষ
(এই প্রতিবেদককে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন দত্ত পরিবারের সদস্য অসিত দত্ত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.