কাপড় খুলে উল’ঙ্গ করে দিয়েছে যাদবপুর-কে
একটু মনোযোগ দিয়ে পড়বেন…
আমি সায়ন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যবিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার যারা কাছের মানুষ,বন্ধুরা জানেন, ব্যক্তিগত কোনো অনুভূতি আমি খুব একটা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে পছন্দ করি না। কিন্তু আজ করতে হচ্ছে। কাল গভীর রাতে একটি খবর পাওয়ার পর থেকে প্রায় সিঁটিয়ে বসে আছি। দুঃখ, যন্ত্রণা, আতঙ্ক আর গ্লানি একসাথে অনুভব করছি। তার কারণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষে সদ্য ভর্তি হওয়া পড়ুয়া স্বপ্নদীপ কুন্ডু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছাত্রাবাসের তিনতলা থেকে ‘পতন’-এর ফলে মারা গেছে। মিডিয়া এইঘটনাকে ‘রহস্যমৃত্যু’ আখ্যা দিয়েছে। কেউ কেউ একে ‘আত্মহনন’ বা ‘সুইসাইড’ বলেছেন। আমি বলব এটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো দাবী নিয়ে অল ফ্যাকাল্টি জিবি চলছিল ক্যাম্পাসের বড় মাঠে। প্রবল অসুস্থ থাকায় মাঠে খুব বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। আর তাই, KMR এর সামনে একটি জায়গায় বসে পড়ি। সেখানে বসে, একদল ছাত্রের (আমার অচেনা) আলোচনায় কতগুলো চমকপ্রদ মন্তব্য, প্রশ্ন ইত্যাদি কানে আসে। একজন বলেন, “দু-দিন নিতে পারল না!?”। দ্বিতীয়জন, “দু-একদিনে কীই বা হয় তুই বল!”। আরেকজন, ” হ্যাঁ ভাই, দুদিনে আর কতটুকুই বা র্যাগিং করা যায়!”
এই বা এদের মতো ‘শুভবুদ্ধিসম্পন্ন’ যদুবংশীয় বন্ধুদের এইসব ‘সুন্দর’,’যুক্তিসম্মত’ প্রশ্নের উত্তরে দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
এক
স্বপ্নদীপের মতোই আমার বাড়ি নদীয়ায়। ওর বগুলা (মতান্তরে হাঁসখালি)। আমার শান্তিপুর। যাদবপুর যেখান থেকে ‘মাত্র’ তেত্রিশটা রেলস্টেশন দূরে। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় ষান্মাসিকে ইন পার্সন ক্লাস শুরু হওয়ার পর প্রায় দেড়মাস ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করে আমি যাদবপুরের হোস্টেল পাই। স্বপ্নদীপ ঠিক যে ব্লকটিতে ছিল, সেই ব্লকেই। ৯ এপ্রিল, ২০২২ এ আমি ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ সেরে লটবহর নিয়ে ছাত্রাবাসে উঠি। আমি যে ঘরটি পেয়েছিলাম(যেটি সুপার বা অন্য কোনো আধিকারিক নন, ঠিক করে দিয়েছিল হোস্টেলের মেস কমিটি), সেখানে ঢোকার পর ক্রমে জনা কুড়ি ছাত্র একে একে আসে, শিষ দিয়ে উঁকি মারেন এবং জিজ্ঞাসা করে, “নতুন?”, “আজ?”, কিংবা ” তোর ‘হোস্টেলের বাবা’ কে?”। ‘হোস্টেলের বাবা’ শব্দবন্ধটি আমার কাছে নতুন ছিল, জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি ছাত্রাবাসের বেশিরভাগ ছাত্রই আসে মেস কমিটির বিভিন্ন সিনিয়রের সুপারিশে। এই সিনিয়রটিই হলেন উক্ত নতুন ছাত্রটির ‘হোস্টেলের বাবা’। এখন খুব অল্প সংখ্যক যেসকল ছাত্রের সিনিয়রদের সুপারিশ ছাড়াই স্থান হয়, আমি তারমধ্যে একজন ছিলাম। ফলে, আমার কোনো হোস্টেল-পিতা ছিল না। এরপর খাওয়া দাওয়া মিটলে, আমার রুমমেট তথা একবছরের সিনিয়র এক ইঞ্জিনিয়ারিং এর দাদার ওপর নির্দেশ আসে আমাকে ‘ইন্ট্রো’ সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে। ‘ইন্ট্রো’ সে যা বোঝায়, সেই অনুযায়ী, প্রতিদিন রাত এগারোটা বা বারোটার পর অত্যন্ত স্বল্পবসনে বিল্ডিং এর একটি একটি করে দরজা নক করতে হবে আমায়। তারপর সেইঘরের সিনিয়ররা দরজা খুললে সাবধান পজিশনে দাঁড়িয়ে একটি ফর্ম্যাট মুখস্থ বলতে হবে আমায়। সেটি শুরু হবে আমার নাম, পিতার নাম, মাতার নাম দিয়ে। তারপর জন্মদিবস। তারপর ‘আনুমানিক প্রতিষ্ঠা দিবস(আমার জন্মের সময়ের ন’মাস দশদিন আগের দিনটি হলো এই দিনটি; আশা করি সবাই ইঙ্গিতটি বুঝতে পারছেন)। তারপর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিকের গোটা CV । এই ফর্ম্যাটটি শেষ হবে শারীরিক বর্ণনায়। গোটা বক্তব্যে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে হয় উঠবোস, নয় খিলের আঘাত সহ্য করতে হবে হাঁটুর পেছনে। এই ‘ইন্ট্রো’টি চলবে রাত আড়াইটে অবধি। ‘ইন্ট্রো’ কতদিন দিতে হবে? হোস্টেলের জনৈক সিনিয়রের কথায় যতদিন না আমার পুরু*ষাঙ্গের দৈর্ঘ্যটি পর্যন্ত সমস্ত আবাসিক ছাত্রের মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত। এছাড়া সপ্তাহে একদিন সবঘরের সব সিনিয়রের জলের বোতলে জল ভরে দিতে হবে। চুলে থাকবে মিলিটারি ছাঁট। সন্ধ্যে ছ’টার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকে যেতে হবে। এবং ক্লাসের সমস্ত ‘মামণির’ গল্প তাদের বলতে হবে।
পরদিন সন্ধ্যেবেলা আমি হোস্টেল ছাড়ি এই বুঝে যে এইসব আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না। বাবার আর্থিক সঙ্গতি বিশেষ না থাকলেও যে করে হোক, যত কষ্টেই হোক একটি মেস/পিজি খুঁজতে হবে আমায়। কসবায় একটি পিজিতে এখন থাকি আমি।
দুই
১৩ই জানুয়ারি, ২০২৩। সেম ব্রেক চলছে। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ হচ্ছে গান্ধীভবনের ভেতরে। প্রবেশ নিয়ে কড়াকড়ি ছিল না, তাই ঢুকি অনুষ্ঠান দেখতে। সঙ্গে দু-চারজন সহপাঠী এবং জুনিয়রও ছিল। গান, নাচ, হুল্লোড় ভালোই চলছিল। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হয় এবার ‘ইন্ট্রো’ হবে। সেই ‘ইন্ট্রো’য় জনা পনেরো ছাত্রকে মঞ্চে তোলা হয়। তারপর একটি লম্বা বেলুন এবং তার পাশে বাঁধা দুটি গোল বেলুন (প্রতীকী পুরু*ষাঙ্গ) তাদের দিয়ে বলা হয় তলপেটের নীচে ধরে থাকতে। তারপর একটি গান চালিয়ে কুৎসিত নাচতে বাধ্য করা হয় তাদের। তারপর একটু আগে যে ফর্ম্যাটটি বললাম, সেই ফর্ম্যাটে ‘ইন্ট্রো’ দিতে হয় তাদের।
আসলে ‘র্যাগিং’ একটি বহুলালিত ‘Sadistic pleasure’। র্যাগিং একটি সিস্টেম যাকে ‘ঐতিহ্য’ বলে চালানো হয়। আর এই সিস্টেমটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থেকেও এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই এই নিয়ে। ফলে গ্রাম, মফঃস্বল বা শহরতলি থেকে এই পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের, যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের এই পরিস্থিতিতে দুটি রাস্তা খোলা থাকে – এক, আত্মরক্ষার্থে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করা, যা অনেকের দ্বারাই সম্ভব হয় না। আর দুই, আত্মহত্যা। ঠিক এইকারণেই আমি বা আরও অনেকে স্বপ্নদীপের এই চলে যাওয়াকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’ বলতে চাই।
তরতাজা প্রাণটি ফিরে আসবে না জানি। তবু চাই, নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। অভিযুক্তরা চিহ্নিত হোক, শাস্তি পাক। কিন্তু তারচেয়েও বেশি করে চাই, এই অমানবিক ‘প্রথা’ বন্ধ হোক। “হোস্টেলে একটুআধটু এসব হবে না!?”, কিংবা “র্যাগিং আসলে জীবনের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা” -এরকম মানসিকতা বা কথাবার্তা বন্ধ হোক। একটি নতুন শহরের বিশ্বমানের এক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে এই ঘৃণ্য সিস্টেমের বলি হয়ে মা-বাবার কোল খালি করে কতগুলো অসহায় তরুণ-তরুণীর অকালে ঝরে পড়া বন্ধ হোক।
খুব কষ্ট হচ্ছে। সেদিন ফেসবুকটি ছিল না। সেদিন বলবার জোর ছিল না। থাকলে হয়তো একটু হলেও সচেতনতা গড়ে তোলা যেত। হয়তো এভাবে একটা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা জুনিয়র কে হারাতে হত না।
আর স্বপ্ন না ভাঙুক। আর দীপ না নিভুক। এটুকুই।