পর্ব ২: ব্রতকথা ও অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়
অষ্ট পালনী মাতা সংসারের সার
জগত্ পালনে মাতা যারে অবতার।
খণ্ডিয়া পাপ দারিদ্র্য সকল
সকল বিপদে বন্ধন , হয়ে যায় রসাতল।
ইতু পূজায় বঙ্গের পুরনারীগন প্রার্থনা জানান, যে জ্যোতির দ্বারা তুমি অন্ধকার নষ্ট কর এবং যে কিরণের দ্বারা সমস্ত বিশ্ব জগৎ প্রকাশ কর, তার দ্বারা আমাদের সর্বপ্রকার দরিদ্রতা নষ্ট কর, আমাদের পাপ, রোগ ও দুঃস্বপ্ন দূর কর।
ইতুপুজো প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বাংলার ব্রতকথা গ্রন্থে বলেছেন “সূর্যব্রত ভারতের সকল নারী সমাজের একটি প্রধান ব্রত। সূর্য উর্বরা শক্তির আধার, সূর্যের আশীর্বাদে নারী সন্তান লাভ করে থাকে এবং সূর্যের অভিশাপেই নারী বন্ধ্যাত্বপাপ্ত হয়। সুতরাং সূর্যকে প্রসন্ন করতে না পারলে নারী কদাচ সন্তানের জননী হতে পারে না। সেজন্য সূর্যকে প্রসন্ন করার চেষ্টা।” ইতু যে, লক্ষ্মী, সূর্য না ঊষা সেই ব্যাখ্যার সাতকাহন আমি পূর্ব পর্বে আলোচনা করেছি।
উলু উলু উলু উলুধ্বনি , শঙ্খধ্বনি দিয়ে অঘ্রানের প্রতিদিন ভোরে গ্রামবাংলার ঘর মুখরিত হয়ে ওঠে। পুরনারীগন শুদ্ধ ভাবে সরা ভরে গাছগাছালি আর ঘটের সামনে বসে ইতু পূজা করেন। ইতু ব্রত ও পূজা স্পষ্টতই দানাশস্য ও মূল সঞ্চারিত গাছের চারা উদ্গমের প্রাথমিক পর্যায়ে অনুশীলন ক্ষেত্র এই টুকু উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয় না। প্রসঙ্গত , গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহুরে সভ্যতার দিকে চলে যাওয়া বেশ কিছু পরিবারও এই ব্রত এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তার সব থেকে বড় উদাহরণ আমি। আমার পিতা ও মাতার পরিবারে ফি বছর এই ব্রত ও পূজার চল এখনো আছে। আমি নিজে শৈশব থেকে এই পূজা করে এসেছি।
কিছু আধুনিক শহুরে পরিবার এই ব্রত ও ব্রতের উপাস্য মূর্তি ( যদিও তাকে মূর্তি বলা যায় না ) দেখে নিতান্তই অজ্ঞানতা প্রসূত চঞ্চল মানসিকতাকে প্রকাশ করে থাকেন। সাধারণত , আমরা দেবদেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি বা পট ইত্যাদিতে দেখতে অভ্যস্ত। তবে লৌকিক দেবদেবী এমন কি কুলীন দেবদেবীও কিন্তু পূজিত হন নুড়ি রূপে, এবং ঘট স্থাপন প্রতি পূজার প্রথম ও প্রধান অঙ্গ।কশ্চিৎ যদি মূর্তি বা পট নাও থাকে দেব দেবীর নামে ঘটের স্থাপনা পূর্বক পূজা করা যায়। ঘটেই মূল দেবতার আবাহন হয়। মূর্তি তো ভাবের পূজা। যেমন , শালগ্রাম শীলা ও গিরি গোর্ব্ধন শীলা লাকে বিষ্ণু রূপে পূজা করা হয়, শিব তো নিজেই লিঙ্গ স্বরূপ নিরাকার রূপ ধারণ করেছেন, নর্মদা বক্ষে প্রাপ্ত বিশেষ শিলাও শিবের প্রতিভূ রূপে পূজিত হয়, যেকোনো দেবীর পূজায় যন্ত্র ও ঘট হল মূল, দুর্গা পূজার বোধন কালে বেল গাছ ও নবপত্রিকাই মূল…সে ব্যাখ্যা আমি বীরভূম ও পটের দুর্গা প্রবন্ধে লিখেছিলাম। মহাবিদ্যা বা সরস্বতী পূজায় কেবল বই বা বাদ্য যন্ত্র থাকলেই সেখানে ঘট বসিয়ে পূজা সম্পন্ন করা যায়, তেমন এক কুনকে ধানও দেবী লক্ষ্মীর প্রতিরূপ হিসাবে পূজা হয়।
এবার লৌকিক দেবদেবীর কথায় আসি। আজ অবধি সমগ্র ভারতের অধিকাংশ লৌকিক দেবদেবী বৃক্ষে, নুড়ি পাথরে, এমন কি পাহাড় রূপে বা বিগ্রহ হীন ভাঙা মন্দিরে পূজা পেয়ে আসছেন। যেমন – বন দুর্গা, ক্ষেত্রপাল, ধানশুয়ারী, চর্চিকা, ষষ্ঠী, ওলাই চন্ডী,ঘাঘর বুড়ি, পাহাড়সিনী, মারাংবুরু, জাহের এরা, রংকিনী …এমন কি সতী পীঠ গুলিতেও কিন্তু পবিত্র নানা শীলাখন্ড দেবী রূপে পূজিতা হন।
তবে মানুষ তো এখন এত ব্যাখ্যা বুঝবে না। তাঁরা চন্ময়ীকে মৃণ্ময়ী রূপে দেখতে চান। তাই গোবর ও তুষ মেশানো পিন্ডতে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা টুসু বা তুষ তুষালী ব্রত এখন টুসু প্রতিমায় পরিণত হয়েছেন।
এবার একটা ঘটনা বলি…আমি ২০১১ সালে দৈনিক স্টেটস ম্যানে সে খবর প্রকাশিত হয়।
আচ্ছা আমরা যাঁরা বাংলা মাধ্যমে পড়ে এসেছি তাঁরা ছোট বেলায় জীবন বিজ্ঞান বইতে একটি কথা পড়েছি , মনে আছে? মনে না থাকলে বলি:
” মনে রাখতে হন কেবল চকখড়ি – আশ্রিত বক্তৃতা পদ্ধতির মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ের পঠন পাঠন হলে শিক্ষার্থীদের কাছে পঠনপাঠন একঘেয়ে , ক্লান্তিকর এবং কখনো কখনো বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। আর এভাবে প্রকৃতি বিজ্ঞানের শিক্ষা হতে পারে না । সেজন্য পরিকল্পিত কাজকর্মে / সক্রিয়তার মাধ্যমে বিজ্ঞান শেখা ও শেখানো পদ্ধতি যতখানি সম্ভব অনুসরণ করতেই হবে।…”
প্রসঙ্গত বলে রাখি , ১৯৮১ সাল থেকে সরকার ও সরকার অনুমোদিত বিদ্যালয়গুলিতে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে জীবন বিজ্ঞান বা প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষাদান শুরু হয়।
যা হোক, সেই ছোট্ট বেলার জীবন বিজ্ঞান বইতে অঙ্কুরোদগম সম্পর্কে জীব ও জড় পরিচ্ছেদে আমাদের সামর্থ্য দেখতে চাওয়া হত। সেখানে বীজ থেকে যে চারা গাছ বের হয় তা পরীক্ষা করে দেখার কথা বলা হয়েছে। তার জন্য কি কি লাগবে?
মাটি, মাটির ভাঁড় বা খুঁড়ি বা কোনো ঐরকম পাত্র। এবার মটর, ছোলা ,মুগ, সর্ষে, সিম বীজ, তেঁতুল, কুমড়োর দানা ইত্যাদির কোনও একটিকে নিতে হবে।
এবার কি পরীক্ষা করতে বলা হত? বলা হত –
দুইটি পাত্রে একটিতে মাটি জল দিয়ে এবং অন্যটিতে সামান্য জল নিতে হবে।তারপর বীজ গুলিকে এক রাত্রি জলে ভিজিয়ে রেখে দুইটি আলাদা পাত্রে পুঁতে দাও। মাঝে মাঝে মাটি সমেত পাত্রতে জল সিঞ্চন কর।পাত্র গুলি এমন স্থানে রাখ যাতে রোদ ও বাতাস পায়।
তারপর কি করতে বলা হত? হ্যাঁ , একদম …..বীজের পরিবর্তন জীবন বিজ্ঞান খাতায় লিখতে বলা হত।একদিকে লেখা ও অন্য দিকে সেই পরিবর্তন এঁকে চিহ্নিত করা। এমন কি বীজের পরিবর্তনের নিমিত্ত কি কি প্রয়োজন হলে তাও লিখতে বলা হত। – আমি বাড়িতে মহা উৎসাহের সঙ্গে সে সব পরীক্ষা করতাম। সেসব সোনালী ছোটবেলা ছিল। দেখতাম যে – মাটি,জল, রোদ ও বাতাস পেয়েছে সে অঙ্কুরিত হয়েছে। যে কেবল জল পেয়েছে সে কয়েকদিন বাদে পচে গেছে। জীবিত চারা গুলি রৌদ্রালোকের দিকে ধাবিত হয়। যারা রোড পায় না তারা কয়েকদিন পরে হলুদ হয়ে যায়। আর জল না পেলে তো কথাই নেই…..
এবার দেখতে পাই লোকায়ত আয়জনে এই যে ইতু ব্রত পালন হচ্ছে , সেখানে যা যা রীতি পালন করা হচ্ছে সেখানে উপরোক্ত সবই করতে হচ্ছে। এছাড়াও ইতু ব্রতে পাই বীজ নয় মূল থেকেও গাছ জন্মায় ও ফসল ফলে সেই বিদ্যা কচু, হিংচে, কলমী ইত্যাদি রোপনের মাধ্যমে।
এবার এত কেন গৌরচন্দ্রিকা করলাম ? সেই কথাটাই বলি:
২০১১ সালে হাওড়া জেলা স্কুলের প্রাত বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের স্কুল দালানের সরায় ইতু স্থাপন করেছিলেন। সেই ইতু সার্থক হয়েছিল, যখন বাচ্চারা দলে দলে বীজ থেকে চারা বের হওয়ার পর্যায়ক্রম গুলি দেখতে আসছিল।দৈনিক স্টেটস ম্যান ও প্রাত্যহিক খবর সংবাদ পত্রে এই বিষয় লেখালিখি হয়। সেখানে ইতুর প্রাসঙ্গিকতার দিকটি জনসমক্ষে উদ্ভাসিত করা হয়।
বর্তমানা হাওড়া জেলায় ইতু কেবলমাত্র মেয়েলি ব্রত কথায় আটকে নেই। অঘ্রান মাসে অনেক স্থানেই মাটির বৃহৎ মাজলা বা গামলায় বৃহদকার ইতু শোভা পায়। ২০১১ সালে স্কুলে ইতুর সার্থকতার পরে অনেক ইতু স্থাপন হয়েছিল। তার মধ্যে অনেক বন্ধ হয়ে গেছে। তো এই ইতু পূজাকে সার্বজনীন ইতু বলা হয়। অনেক স্থানে হয়ত তিন চার বছর হল শুরু হয়েছে।
অতএব বলা চলে সার্বজনীন ইতুর গতি ও প্রবর্তনার সচল আছে। উলুবেড়িয়া থানার ” অভিরামপুর কালীমাতা সংঘ” ….এনারা ইতু বিসর্জনের দিন পংক্তি ভোজনের আয়োজন করা হয়। এক্ষেত্রে ইতুর বিস্তারের জন্য সংঘের সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন।
ইতুর বিস্তারের জন্য বাগনান থানাএ হারপ, বাঙালপুর , পানিত্রাস, আমতা গ্রামে সার্বজনীন ভাবে ইতুর আয়োজন করা হয়। হাওড়ার বিখ্যাত হাজার হাত কালীমন্দিরের ওলাবিবিতলা লেনের বোস পুকুর মাঠে পল্লীবাসী আয়োজিত ইতু দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে প্রতি সদস্যদের অসম্ভব শিল্প সম্মত নিষ্ঠা ইতুকে করেছে বিখ্যাত। বাঁশ দিয়ে তৈরি ইতুর মঞ্চ , কাপড় ও কাঁচা মাটির আস্তরণ , অপূর্ব আল্পনা অলঙ্করণ পল্লীবাসীর রুচিবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং ইতু সংস্কৃতির স্থানকে উচ্চে অধিষ্ঠান করেছেন।
পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর “পূজা পার্বণের উৎস কথা” গ্রন্থে বলেছেন ঋতু শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে ইতু হয়েছে।তাঁর মতে ইতু হলেন প্রজননের দেবী।তাঁর উপাসনা, মাতৃকা উপাসনা।
ডক্টর সত্যনারায়ণ দাশ প্রণীত ” বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ ” গ্রন্থটিতে #ইতু শব্দের বিষয় আলোক পাত করেছেন। কন্নড় ভাষায় ইতু অর্থে জন্মানো, তামিল ভাষায় ইতু অর্থে শিশু বা জন্ম দেওয়া। তাই প্রশ্ন ওঠে ইতু কি তবে প্রজননের দেবীর পূজা? মহিলারা এই পূজার মাধ্যমে উর্বরতা বা ফার্টিলিটির প্রার্থনা করে থাকেন? মা ষষ্ঠীর কৃপাধন্য হওয়া ও ইতু পুজোর মাধ্যমে নিজের শস্যধারণ ক্ষমতা বজায় রাখা বঙ্গ রমণীর হৃদয়ের আকাঙ্খা হিসাবে পরিগণিত হয়।
ইতু দিলেন বর
পুত্রকন্যা পৌত্র ধনধান্যে বাড়ুক তাদের ঘর।।
শিশুর মুখ দেখতে হলে ইতু পূজা অবশ্য কর্তব্য….
এই বঙ্গে যেটি ইতু পূজা , ওই বঙ্গে সেটি চুঙী বা চুঙ্গির ব্রত। দ্রাবিড় ভাষাভাষীতে চুঙী মানে কি?
চুনক ― ছোট , চুন ― শিশু, চিন্না – ছোট। অর্থাৎ চুঙী প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষার উক্ত শব্দের অপভ্রংশ। এরম আরো বাংলা শব্দ আছে যেমন – চুঁনোপুঁটি, চুনি গুলি, চিনাবাজার। ….শিশু বা বাচ্চা।ইতু ব্রত বা চুঙী ব্রত তাই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ ।
পরিশেষে নিবেদন এই যে, আমাদের পরিকল্পিত বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতু গবেষণা প্রকল্পে যাঁরা তথ্যঃ ও ছবি দিয়ে সাহায্য করতে অগ্রহি তাঁরা আমার কমেন্ট বক্সে বা ঋতম বাংলাকে লিখে জানাতে পারেন।যদি কোনো বিদ্যালয় বা কেউ সার্বজনীন ভাবে ইতু করতে চান তাঁরাও বলবেন। বৃক্ষই তো শস্য দেয়, ফল দান করে। এই উষ্ণ পৃথিবীর বুকে তো আজ সত্য করে সবুজায়ন দরকার…..
ইতুব্রত কথা হেথা হৈল সমাপন ।
সকলে মিলিয়া দাও জয়ধ্বনি ,মন্ত্র বল
ঘটঘটায় নমঃ
আলদুগ্গায় নমঃ
ইতুলক্ষ্মী দেব্যায়ঃ নমঃ….
সমাপ্ত
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্য : ১. লোকায়ত হাওড়া
২. বাংলার মুখ
৩. হাওড়া জেলার লোক উৎসব
৪. মেয়েদের ব্রতকথা