অবিশ্বাস্য! কিন্তু এটাই সত্য যে ভারতবর্ষের নির্বাচনী ইতিহাসে ছাপ্পা ভোটের সূত্রপাত করেছিল কংগ্রেস এবং তা পশ্চিমবঙ্গেই– যার অন্যতম রূপকার ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
১৯৪৯-এর ১৮ জুন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের একটি মেমো এসে পোঁছল। মেমো নম্বর ৯৪৩৪ টি.পি. ৬০৫। মেমোর মোদ্দা বক্তব্য—ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ইনস্পেক্টররা এলগিন রোড পোস্ট অফিসে সূক্ষ্ম ভাবে অনুসন্ধান করে নেতাজীর বড় দা শরকুমার বসুর পুত্র অমিয়নাথ বসুকে লেখা একটি চিঠি হস্তগত করেছেন। চিঠির লেখক জনৈক মৃতুঞ্জয় মুখার্জি যাঁর ঠিকানা ২৪/৪, রসা রোড, কলকাতা। চিঠিটিতে শরৎ বসুর রাজনৈতিক উত্থানকে বানচাল করার জন্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একটি কৌশলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিটি এরকম : “এখন আমি কংগ্রেস অফিসে বসেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই চিঠিটি লিখছি। আমি জানি, এটা আমার অন্যায়। কিন্তু তথ্যটি আপনাকে না জানানোটা আরও বড়ো অন্যায় হবে বলেই আমি মনে কারি। আমি কংগ্রেস অফিসে দিনের একটা বড়ো অংশই কাটাই। এবং এখানে বসেই আমি জানতে পেরেছি, কংগ্রেস একটি গোপন সমীক্ষায় জানতে পেরেছে যে এবার ভোটে শরৎ বসু পাবেন ১৫০০০ ভোট। কংগ্রেস পাবে মাত্র ৬০০০। এর ফলে কংগ্রেস খুব চিন্তিত এবং তারা চাইছে যে কোনোভাবেই ভোটে জিততে। এজন্য তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে জয় হাতছাড়া না হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মতো নেতৃত্বের নির্দেশে একটা নতুন অফিস খোলা হয়েছে। এই অফিসের একটাই কাজ। মৃত ভোটারদের নামের তালিকা তৈরি করা। তাদের পরিকল্পনা হলো, ওই মৃত ভোটারদের নামে অন্য লোকজন ভোট দিয়ে যাবে। এছাড়া কলকাতায় বসবাস করছেন না, এমন ভোটারদের নামেও জাল ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে কংগ্রেস। ব্যালট বক্স এবং ভোটের কৃৎকৌশল সম্বন্ধে আপনি যথাযোগ্য কড়া পদক্ষেপ নিন।”
কেন্দ্রীয় প্রশাসন তৎক্ষণাৎ ওই চিঠির লেখককে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু খোঁজ করে দেখা যায়, ২৪/৪, রসা রোডে মৃত্যুঞ্জয় মুখার্জি নামে কেউ থাকেন না। আর ওই ঠিকানায় রয়েছে একটি কাগজ বই ইত্যাদির দোকানি এবং একটি গয়নার দোকান। কোন ভোটের কথা চিঠিতে বলা হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে।
নির্বাচন নিয়ে ধন্দ থাকলেও এটা স্পষ্ট যে ভারতে ছাপ্পা ভোটের চক্রান্তের ইতিহাস রচনা করেছিল সর্বপ্রথম কংগ্রেস। এবং ক্রমশই, রাজনীতি যত জটিল হয়েছে, রাজনৈতিক দল যেভাবে বেড়েছে এবং ভোটার সংখ্যাও যেভাবে বেড়েছে তার ফলে ভোটসন্ত্রাস, তা সে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যেমনই হোক না কেন, আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে।
নেতাজী কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরি করেছিলেন একটা উদ্দেশ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের তাঁবেদারি রাজনীতির বিরোধিতা করা। নেতাজী ছিলেন পুরোপুরি রাজতন্ত্র বিরোধী একজন রাজনীতিবিদ। নেতাজী নিরুদ্দেশ হবার পর তাঁর বড় দা শরৎচন্দ্র বসু গঠন করেছিলেন সোশ্যালিস্ট রিফর্মার পার্টি। ১৯৫২-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। ইংল্যান্ডে বসে তৈরি করছিলেন নির্বাচনী ইস্তেহার। সে কথাও তিনি চিঠিতে জানিয়েছিলেন অমিয়নাথ বসুকে। সে চিঠিও কেন্দ্রীয় সরকার হস্তগত করে এবং চেষ্টা করে, তার পালটা ইস্তেহার তৈরির। যদিও শরৎচন্দ্র বসুর আর নির্বাচনে অংশ নেওয়া হয়নি। কারণ তার আগেই তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য হন তার সুযোগ্য পুত্র অমিয়নাথ বসু। অর্থাৎ ছাপ্পা ভোট, ফলস ভোট, ভোটার তালিকায় গলদ এবং ভোট সন্ত্রাসের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল এই বাঙ্গলায় এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বেই। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের নেতৃত্বেই তা ফুলে ফেঁপে ওঠে। বামপন্থী এবং তৃণমূল কংগ্রেস শুধু তাদের অনুকরণই করেনি, বাড়িয়েছে অনেক বেশি মাত্রায়।
স্মরণাতীত কালের মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে সরাসরি সন্ত্রাসের কোনো ঘটনার খবর জানা যায় না। তবে ১৯৫৯-এর জুন মাসে জনৈক মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের চিঠিটিকে যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে একথা অনুমান করা বোধহয় ধৃষ্টতা হবে না যে, ১৯৫২ সাল এবং তার পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে কংগ্রেস ভোটার তালিকায় মৃত ব্যক্তি এবং রাজ্যের অনাবাসী ভোটারদের নামও যুক্ত করেছিল এবং কংগ্রেসের নিরবচ্ছিন্ন জয়ের পিছনে অবধারিতভাবে ভূমিকা ছিল ভূতুড়ে ভোটারদের।
তবে বেয়াদব এবং সৌজন্যবর্জিত রাজনীতির প্রকোপ প্রথম দেখা গেল ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-এর নির্বাচনে যখন কংগ্রেসকে হারিয়ে রাজ্যের প্রশাসনে এল যুক্তফ্রন্ট। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়কে সামনে খাড়া করে যা কিছু রাজনৈতিক কৌশল সবই করত কমিউনিস্টরা মূলত সিপিআই (এম)। সত্যিটা হলো— ভোটার তালিকায় গলদ সৃষ্টির কৌশলটা কংগ্রেসের কাছ থেকে শিখলেও সিপিআই (এম) সেটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১৯৬৬ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় সিপিআই (এম)-এর চরম আগ্রাসী আন্দোলন রাজ্যের বুকে গড়ে তোলে এক অদূরদর্শী রাজনীতি। ১৯৬৭-র নির্বাচনে তারই প্রকাশ ঘটল অসৌজন্যতার মাধ্যমে। অতুল্য ঘোষ এবং প্রফুলচন্দ্র সেনের মতো সজ্জন নেতাদের যুক্তফ্রন্ট ভূলুণ্ঠিত করল রাস্তার মোড়ে মোড়ে কাঁচাকলা ও কানা বেগুন ঝুলিয়ে। কারণ খাদ্য আন্দোলনের সময় প্রফুল্ল সেন পরামর্শ দিয়েছিলেন, চালের অভাব, তাই কাচকলা খান, পুষ্টিগুণ একই। আর রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ একটি চোখ ছিল অন্ধ। এ ধরনের অসৌজন্যের রাজনীতি এর আগে দেখা যায়নি। হয়তো তারই বৃহত্তর প্রকাশ দেখা গেল ১৯৭১-এ যখন ১৯৬৯-এর নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সরিয়ে রাজ্যপাল ধরমবীর রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী পিডিএফ দলনেতা প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে রাজ্যের নয়া মুখ্যমন্ত্রী করলেন সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং সিপিআই (এম) তার প্রতিশোধ তুলল রাজ্য বিধানসভায় প্রবীণ গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে পচা ডিম, পচা টম্যাটো এবং দোয়াতের কালিতে কলঙ্কিত করে। এখান থেকেই সূত্রপাত। মাঝখানে ঘটে গেলে নকশালপন্থীদের উত্থান যাঁরা মনে করতেন, নির্বাচন পদ্ধতিটাই ভুল। অতএব খুন এবং সন্ত্রাস শুরু হয়ে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ফের আসরে নামল কংগ্রেস সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বে। ১৯৭২-র নির্বাচনে রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীরা দেখিয়ে দিলেন, ভোটসন্ত্রাস কাকে বলে। শুধু কলকাতায় নয়, রাজ্যের সর্বত্র ভোটের বুথগুলি থেকে ভোটকর্মীদের হটিয়ে দিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে অবাধে ছাপ্পা ভোট করেছিল কংগ্রেস। তার ফলে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল বিপুল ভোটে। এ ধরনের অবাধ ছাপ্পা এযাবৎ দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি বঙ্গবাসীর।
অবশ্যম্ভাবীভাবেই কংগ্রেস আর ফিরতে পারেনি ক্ষমতায় কখনই এককভাবে। ১৯৭৭-এই পাশা পালটে দিয়ে ক্ষমতায় পা রাখে বামফ্রন্ট। নেতৃত্বে সিপিআইএমের অবিসংবাদী নেতা জ্যোতি বসু। টানা ৩৪ বছর ধরে বাঙ্গলা। দেখেছে— ভোটসন্ত্রাস কাকে বলে। না, কংগ্রেসের মতো বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট করার মতো বোকামি বামফ্রন্ট বিশেষ একটা করেনি। কিন্তু গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় লাল পতাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছিল— ভোটটা বামপ্রার্থীকেই দিতে হবে। না হলে। গ্রামছাড়া পাড়াছাড়া হতে হবে। বামফ্রন্টের আমলেই প্রথম দেখা যায় যে কোথাও কোথাও ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং সব ভোটটাই পেয়েছেন বামপ্রার্থী। এও সম্ভব! অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিল বামদলগুলির ভোটলুটেরা কর্মীবাহিনী যারা বছরভর লাল দলের শাসন অপ্রতিহত রেখেছিল কখনও রক্তচক্ষু দেখিয়ে, কখনও বা সাইবাড়ি হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে।
বাঙ্গলা এখনও সেই ঐতিহ্যেরই ধ্বজা বহন করে চলেছে আরও নিলজ্জভাবে। ভোট সন্ত্রাসে কংগ্রেসকে অনুকরণ করেছিল বামফ্রন্ট ওরফে সিপিআই (এম)। সিপিআই (এম)-কে এখন অনুসরণ করছে তৃণমূল কংগ্রেস সেই অতি পরিচিত প্রবাদবাক্যকে আপ্তবাক্য হিসেবে মেনে নিয়ে—মহাজনো গতঃ স পন্থাইতি। মহাজনের পথই পথ। ভোটার তালিকায় গোঁজামিল এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বিরোধীদের প্রার্থীপদ জমা না দিতে দেওয়া, বিরোধীদের নির্বাচনী সভা করতে অনুমতি না দেওয়া এবং সরাসরি বুথের সামনে গিয়ে তর্জনী তুলে শাসানো, লাঠি, বোমা, পিস্তল নিয়ে বিরোধীদের ওপর আক্রমণের মতো ভোটসন্ত্রাস তৃণমূল কংগ্রেসের মতো এত নির্লজ্জভাবে কোনো রাজনৈতিক দলই করেনি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচন—তিনটি নির্বাচনেই শাসক দল শুধুনয়, সরকারি প্রশাসন সরাসরি নেমেছে ভোটসন্ত্রাসে এবং সর্বত্র যে অনাবিল এবং অবিরাম সন্ত্রাস হয়ে গেছে, তার প্রতিবাদ করেননি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় এই সন্ত্রাসে তারও মদত আছে, বিশেষ করে তারই ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবারে ভোট-পূর্ববর্তী সন্ত্রাস যখন সবচেয়ে বেশি যেখানে বাম প্রার্থী ডাঃ ফুয়াদ হালিমকে বারবার তিনবার তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণণের শিকার হতে হয়।
বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে পালটা মার দেবার মতো কোনও রাজনৈতিক শক্তি বাঙ্গলার বুকে ছিল না। কিন্তু এখন বিজেপি এসেছে অনেক বেশি শক্তিধর হয়ে। মানুষ সাহস পেয়েছে। শাসক দল ভোট দিতে বাধা দিলে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে। রক্তপাত ঘটেছে। মাথা ফেটেছে। হাত ভেঙেছে। পাঁজর ভেঙেছে কিন্তু প্রতিবাদের পতাকাটা মাথা নত করেনি। হয়তো এখান থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জন্ম নেবে রাজনৈতিক চেতনার নব বোধোদয়। রাজনৈতিক দলগুলি যারা ভোট-সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করেই ক্ষমতায় টিকেছিল কিংবা টিকে থাকতে চায়, তারা হয়তো এবার বুঝতে পারবে— গণতন্ত্রের শক্তি জনগণের সমর্থন। পয়সা দিয়ে কেনা গুন্ডাবাহিনীর রক্তচক্ষু নয়। গণতন্ত্র মানে জনগণের ভালোবাসা। কোনও রাজনৈতিক দলেরই কুম্ভীরাশ্রু সেই ভালোবাসায় ভাগ বসাতে পারে না যতক্ষণ না কোনও দল জনগণের দল হয়ে উঠতে পারে।
শৈবাল মৈত্র
2019-05-17