রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও কি করোনা পজিটিভ ??

১২ ই জুলাই খোদ রাজ্যের রাজধানী কোলকাতার বুকে ইছাপুরের মাত্র ১৮ বছর বয়সী তরতাজা যুবক হাসপাতালে বেডের অভাবে আর ঠিক তার পরদিনই ২৬ বছর বয়সের জয়নগর নিবাসী আর এক যুবকের কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামোর বেহাল দশাকে বেআব্রু করল। যে ৪১ টা উজ্জ্বল নীল সাদা রঙের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের মিথ তৈরি করে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বড় বড় কথা বলে মানুষকে ক্রমাগত ধোঁকা দেওয়া হয়েছে, সেই মিথ হালকা দমকা হাওয়াতেই তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়লো। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের বরাদ্দকৃত প্রায় ১১০০ কোটি টাকার ফান্ড ডাইভার্ট করে হাসাপাতাল পিছু ১০ কোটি টাকা বিল্ডিং উপলক্ষে খরচ করা হয়েছে, ঝাঁ চকচকে নীল সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল অথচ কোনো কোনো হাসপাতালে সামান্য EEG করার মেশিন পর্যন্ত নেই আবার কোনো হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার ও নেই। উজ্জ্বল নীল সাদা রঙের ঐ বিল্ডিং গুলো আসলে এক একটি স্টোর হাউস যেখানে কোটি কোটি টাকা মূল্যের মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট গুলিকে কাঠের বাক্স বন্দী অবস্থায় মজুত করে রাখা হয়েছে। প্যাকেট খোলার লোক নেই, ইনস্টলেশনের লোক নেই অথচ পেমেন্ট যথারীতি সম্পূর্ণ, যদিও নিয়ম মতো দামী সায়েন্টিফিক ইনস্ট্রুমেন্ট কিছু কেনা হলে, তা ইনস্টলেশনের পরেই পুরো পেমেন্ট দেওয়া হয়, কারন সাধারনত এর ইনভয়েসে সার্ভিস চার্জ/ ইনস্টলেশন চার্জ ও সার্ভিস ট্যাক্স নেওয়া হয়ে থাকে।

সারা রাজ্যে স্পেশালিষ্ট ডাক্তারের অনুমোদিত পদের সংখ্যা যেখানে ৩৪৫৩ জন, সেখানে প্রায় ২০০০ পদ খালি। প্রায় ১২৩৫ টি টেকনিশিয়ান পদেও বিগত কয়েক বছরে কোনো নিয়োগ হয়নি। ফলতঃ সুপার স্পেশালিটি নামাঙ্কিত হাসপাতালে মেডিকেল টেকনিশিয়ান না থাকার কারনে লক্ষ লক্ষ কখনো কোটি কোটি টাকা মূল্যের চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি গুলো কেনার পর প্যাকেট বন্দী অবস্থায় দিনের পর দিন পরে রয়েছে, যা আদতে ঐ হাসপাতাল গুলোকে ব্লক প্রাইমারি হেল্থ সেন্টারে পর্যবসিত করেছে। রাজ্যে এমনও মেডিকেল কলেজ আছে যেখানে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই অথচ নাম তার মেডিকেল কলেজ। বাস্তবিকই এ এক নিদারুণ পরিস্থিতি।

কোলকাতার নামী-দামী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলিতে মোট বেড সংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের একটু বেশি সংখ্যক ICU/ITU বেড রয়েছে। অর্থাৎ আমার আপনার আপনজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলির কোনো একটি তে পৌঁছাতে পারলেও তাকে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ICU/ITU তে না রেখে আমার আপনার হাতে ওয়েটিং লিস্টের চিরকুট ধরিয়ে দেওয়া হবে।

আজকের হিসেব অনুযায়ী সারা রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬,১১৭ জন, সুস্থ হয়েছেন ২১,৪১৫ জন এবং মৃত মোট ১,০২৩ জন। অর্থাৎ এইমুহূর্তে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত অ্যাকটিভ রোগীর সংখ্যা ১৩,৬৭৯ জন। সারাবিশ্বের মোটামুটি গড় হিসাব অনুযায়ী প্রতি পাঁচ জন করোনা আক্রান্তের মধ্যে একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। সুতরাং এই হিসাবে রাজ্যে আজকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো রোগীর সংখ্যা ১৩,৬৭৯ এর এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ সংখ্যাটি এইমুহূর্তে মাত্র ২৭৩৬ জন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে সারা রাজ্যে উজ্জ্বল নীল-সাদা রঙের এত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ঢক্কানিনাদ, এতগুলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তবুও সারা রাজ্যব্যাপী মাত্র ২৭৩৬ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব কেন হয়ে উঠছে না। কেনই বা হাসপাতালে বেডের অভাবে রেফারের জাঁতাকলে পরে সারাদিন ধরে এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি করে শেষে রাস্তায় বিনাচিকিৎসায় মৃত্যবরণ করতে হবে? তবে কি মাল্টিস্পেশালিটি/ সুপারস্পেশালিটি এই কথাগুলি সবই লোকদেখানো নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রচার? রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রী রাজ্যের নাগরিকদের সম্মুখে এর জবাব দেবেন তো? ঈশ্বর না করুন কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যাটা যদি আরো একটু বাড়ে, তাহলে যাদের ভোটে জিতে আপনি ক্ষমতায় এসেছেন সেই প্রতিটি সাধারন নাগরিককেই কি রাস্তায় পড়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.