এতদিনে সবাই জেনে গেছেন যে, এই বিলের বিরুদ্ধে আসামে কিরকম বিক্ষোভ হচ্ছে। অনেকে বলছেন যে এই বিল পাশ হবার অর্থ হল তা আসাম অ্যাকর্ড ১৯৮৫ আইনের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়া। এই আসাম অ্যাকর্ড এবং আসামে মুসলিম অনুপ্রবেশের বিষচক্র বোঝার জন্য আসামের ভারতে অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস জানতে হবে। আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের ব্যর্থতা বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে যখন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভারত বিভাজনে সায় দিয়েছিল তখন তারা ভারতীয় রাজ্যগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করেছিল – ক, খ, গ। একান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আসামকে সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে ইচ্ছা করেই ‘গ’ শ্রেণীভুক্ত বাংলার সাথে এক জায়গায় রাখা হয়েছিল। ঐ সময়ে বাংলা ছিল মুসলিম সংখ্যাগুরু একটি রাজ্য। যাতে পূর্ব ভারতে পশ্চিম ভারতের মতই একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল গড়ে ওঠে সে দিকেই ষড়যন্ত্রের গতিমুখ ইঙ্গিত করছিল।
মুসলিম লিগ বরাবরই আসামের প্রতি লালায়িত দৃষ্টি রেখেছিল। ১৯৪০ সালে গুয়াহাটিতে একটি ভাষণে স্বয়ং মহম্মদ আলী জিন্না নিজেই বলেছিলেন পুরো আসামটাই নাকি তাঁর পকেটে আছে। তখনই আসামের নেতা গোপীনাথ বরদলুই জিন্নার অসৎ উদ্দেশ্য ধরে ফেলেন এবং অসমের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ সাদউল্লাহ নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ সরকারকে ফেলে দেন এদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে। আর তারপরই তিনি আসামের প্রধানমন্ত্রী হন এবং সাফ সাফ জানান ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব তাঁর পক্ষে মানা সম্ভব নয়। কেননা আসামের চরিত্র তাঁকে যেকোনো মূল্যে বজায় রাখতেই হবে। তিনি এভাবেই আসামকে পাকিস্তানের অংশ হতে দেন নি, অবশ্য়ই তাঁর সাথে ছিল মহাত্মা গান্ধীর আশীর্বাদ।
৮ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আসামের রাজ্যপাল লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস কে সিনহা বিশ্লেষণ করে দেখান সৈয়দ সাদউল্লাহের নেতৃত্বে কিভাবে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকিয়ে আসামের ডেমোগ্রাফি বদলে দেবার চক্রান্ত করেছিল। সে সময়কার ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল তাঁর জার্নালে লিখেছিলেন, “মুসলিম লিগের নেতারা আসামের ডেমোগ্রাফি বদলে দিয়ে আসামকে একটি মুসলিম প্রধান রাজ্যে রূপান্তরিত করে তাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার চক্রান্ত করছে। তারা যেসব জায়গায় চাষবাস হয় না, সেখানেও আরও আরও মুসলিম কৃষককে পাঠাচ্ছে। মুখে ‘আরও বেশী ফসল ফলাবার জন্য এদের পাঠানো হচ্ছে’ বললেও এদের উদ্দেশ্য মোটেই ফসল বৃদ্ধি নয়; মুসলমান সংখ্যা বৃদ্ধি।”
গোপীনাথ বরদলুইয়ের চেষ্টায় সে পরিকল্পনা সফল হয় নি বটে, কিন্তু কোনও কিছুতেই আসামে মুসলিমদের অনুপ্রবেশের স্রোত আটকানো গেল না। ১৯৪৯ সালেj ১২ই আগস্ট আসামের গণপরিষদের বিশিষ্ট অসমীয় সাংসদ রোহিণী কুমার চৌধুরী যেসব মুসলিমরা আসামে অনুপ্রবেশ করে চলেছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলেন। তিনি একটি বাংলা সংবাদপত্রকে উদ্ধৃত করে জানালেন কিভাবে মুসলিম লিগ নিজেই স্বীকার করেছে তারা কমপক্ষে ৩ লাখ মুসলিমকে আসামে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি আসামের ডেমোগ্রাফি যাতে না বদলায়, সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানান। একইদিনে পার্লামেন্টে আম্বেদকরও এই বলে আশ্বস্ত করলেন তিনি আসামের বাসিন্দাদের স্বার্থ অবশ্যই দেখবেন। এই প্রতিশ্রুতির পরিণাম হিসাবে অন্তর্বর্তী সংসদে অসমীয়াদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকারের সুরক্ষায় আসাম অনুপ্রবেশ আইন ১৯৫০ পাশ হল, এই আইন অনুসারে আসাম রাজ্যের যে কোনও অংশ থেকে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও অনুপ্রবেশকারীকে বহিষ্কৃত করার অধিকার প্রদত্ত হল যদি তাদের বসবাস ভারতের সাধারণ জনতার বা কোন উপজাতির পরিপন্থী হয়। এই আইন বিশেষ করে আসামের মধ্যে যেসব অঞ্চলে তফশিলী উপজাতিরা সংখ্যাগুরু, সেসব এলাকায় বিশেষভাবে কার্যকর হল। কিন্তু এই আইনের আওতা থেকে বাঙালি হিন্দুদের বাদ রাখা হল, যাঁরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্যাতিত হয়ে আসামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে আসামকে পেতে ব্যর্থ হবার পরেও পাকিস্তান কোনও সময়েই আসামকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেনি। তারা বরাবরই আসামকে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজের বই ‘দ্য মিথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ -এ উল্লেখ করেছেন, “এটা ভাবলে খুবই ভুল হবে যে, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে বিতর্কিত এলাকা শুধু মাত্র কাশ্মীরই আছে। নিঃসংশয়েই বলতে পারি কাশ্মীর ছাড়াও আসাম ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলাও পাকিস্তানের কাঙ্ক্ষিত বৈকি। পাকিস্তান ভবিষ্যতে এইসব জায়গা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে দাবি তুলবে।” পাকিস্তানের এই অসৎ প্রচেষ্টা বদলায় নি। মুসলিমরা ভুট্টোর ‘ঐতিহ্য’ বজায় রেখে শেষ পঞ্চাশ বছর ধরে অনুপ্রবেশ চালিয়ে এমন অবস্থা করেছে যে, বহু জেলাতে অসমীয়রাই ভয়াবহ ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। ঐসব জেলার সরকারী জমি, অর্থনীতি, কর্মজীবন সবকিছুই এখন অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে গেছে।
আসামকে এইভাবে দখল করে ব্যাপক হারে ইসলামীকরণের পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের। পূর্ব ভারতে আরেকটি কাশ্মীর বানানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। অনুপ্রবেশ বহির্শত্রুর আগ্রাসন মাত্র এবং অসমীয় প্রতিরোধ ছিল এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। আসাম নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কখনই নয়। সাধারণ অসমীয়রা আসামকে ইসলামীয় রাষ্ট্র বানানোর এই ষড়যন্ত্র অনুভব করছেন। তাঁরা এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে আজ সমর্থন গড়ে তুলেছেন। বাঙালী হিন্দু শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করে তাঁরা বুঝছেন আসামের কয়েকটি জেলায় যে জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তন হয়েছে তার প্রতিকার সম্ভব।