পরিবেশ দূষণ আজ সারা পৃথিবীকে মহা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ভারতের জাতীয় রাজধানী দিল্লি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দূষণযুক্ত শহরের তকমা পেয়েছে। দিল্লির পরেই নাকি কলকাতা শহরের বাতাসে বিষের পরিমাণ সর্বাধিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১২ সালের তথ্যানুযায়ী, সারা পৃথিবীতে ২৩ শতাংশ মৃত্যুর কারণ পরিবেশ দূষণ। পশ্চিমবঙ্গে দ্রুতগতিতে শিল্পবিকাশের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন বেশ কিছু শিল্প কারখানা রয়েছে যা বেশি মাত্রায় দূষণ ছড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই রাজ্যের হলদিয়া, হাওড়া ও আসানসোলকে মারাত্মক দূষণযুক্ত অঞ্চল এবং দুর্গাপুরকে উচ্চ মাত্রায় দূষণযুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ২০১২ সালে সংসদে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে দেখা গিয়েছে। যে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক সংখ্যায় ১২,৮১০টি দূষণ সৃষ্টিকারী (রেড ক্যাটাগরি) শিল্পক্ষেত্র রয়েছে। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন রূপায়ণ-সহ দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওপর বর্তায়। এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে শিল্পক্ষেত্রের দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ পর্ষদের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ খতিয়ে দেখে অডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ সময়কালে ‘স্টেট এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অথরিটি (এস ই আই এ এ)’-র পক্ষ থেকে ছাড়পত্র পাওয়া ৬৪টি রেড ক্যাটাগরি শিল্পের অডিট করা হয়। এছাড়া, আরও ৫১টি রেড ক্যাটাগরি শিল্পের দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়।
অডিটে দেখা গেছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্যে অমিল রয়েছে। ২০১৩-র জানুয়ারি মাসে ৬,১৩৫টি শিল্পকে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ৩,৫০০টি শিল্প ইউনিট পরিদর্শন করা হয়। কিন্তু, ২০১৭-র জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী ৯৫২টি শিল্প ইউনিট পরিদর্শন করা হয় এবং ২,৫৪৮টি শিল্প ইউনিট পরিদর্শন করা হয়নি। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬ সময়কালের কোনো কর্মপরিকল্পনা ২০১৭-র জুলাই মাস পর্যন্ত রচিত হয়নি। এমনকী ২০১৬-১৭ সময়কালের জন্যও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কোনো কর্মপরিকল্পনা রচিত হয়নি। দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের দূষণ মাত্রার নিরিখে মানচিত্র তৈরি করা। কলকাতা পুর অঞ্চল এবং দুর্গাপুর, আসানসোল ও হলদিয়ার মতো উচ্চমাত্রায় দুষিত স্থানেও অতিরিক্ত দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প গড়ে ওঠায়। শিল্প স্থাপনের নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া, পরিবেশগত দিক থেকে যেসব স্পর্শকাতর এলাকা রয়েছে, সেই স্থানগুলিকে শিল্প স্থাপনের আওতা থেকে বাদ রাখা হয়নি। ২০১৫ সালের মে মাসে ১৭০টি রেড ক্যাটাগরি শিল্পকে মহেশতলায় স্থানান্তরিত করার জন্য চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু দু’বছর পরেও তা কার্যকর হয়নি। ২০০৯ এবং ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তা করেনি। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ সালে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে পরিশ্রুত প্রযুক্তির প্রসার সম্বন্ধীয় রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। এজন্য ৯৬ লক্ষ। টাকা ব্যয় করা হয়, কিন্তু এটি এখনও রূপায়িত হয়নি।
এইইআইএএ কাজকর্মে পদ্ধতিগত গাফিলতি থাকার কারণে ‘বি’ শ্রেণীর শিল্পগুলির পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে অসুবিধা হয়। ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার সময় নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। বলে অডিট রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। ছ’টি খনির ক্ষেত্রে ২০১৫-র মার্চ থেকে ২০১৬-র জুলাই পর্যন্ত সময়ের জন্য এসইআইএএ পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে, কিন্তু ওই সময়কালে খনিগুলির লিজ শেষ হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের জানা ছিল না যে এমন বেশ কয়েকটি শিল্প আছে যারা শিল্প স্থাপনের ছাড়পত্র ছাড়াই পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছে। এর কারণ কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তাদের কাছে নেই।
২০১৭-র জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, ৫,৪৫২টি রেড ক্যাটাগরির শিল্পের মধ্যে এই রাজ্যে কেবল ১,৯০৮টি শিল্পের কাছে যথাযথ ছাড়পত্র রয়েছে। অন্যদিকে, ২৭৯৭ টি শিল্পের এই ধরনের ছাড়পত্রের মেয়াদ ইতিমধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
তিনটি অতিরিক্ত মাত্রায় দূষিত অঞ্চল-হলদিয়া, হাওড়া ও আসানসোলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা রূপায়ণ করা হয়নি। অতিমাত্রায় দূষিত অঞ্চল দুর্গাপুরের জন্য কোনো কর্মপরিকল্পনা এখনও তৈরি হয়নি। তাছাড়া, এইসব অতিরিক্ত দূষিত এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নীতি-নির্দেশিকা অনুযায়ী বায়ু ও জলের মান নির্ণয় সংক্রান্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। হাওড়া, আসানসোল ও দুর্গাপুরে বায়ু দূষণের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি বলে ধরা পড়েছে।
৬৪টি শিল্প যেগুলি ২০১২-১৭-র মধ্যে এসইআইএএ-এর কাছ থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে তারা কেউই মান্যতা সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দেয়নি। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ছ’টি বাতাসের মান নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ২০১৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে তা মাত্র দুটিতে নামিয়ে আনা হয় যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ প্রয়োজনীয় জায়গার সংস্থান করতে পারেনি।
বিশেষ সংবাদদাতা
2019-08-02